রাজনৈতিক ক্ষমতার বণ্টনে মুষ্ঠিমেয় ব্যক্তির প্রাধান্যের বা এলিট তত্ত্ব আলোচনা কর।

admin


ভূমিকা : রাজনৈতিক ক্ষমতার বণ্টন ক্ষেত্রে মুষ্ঠিমেয় বা অল্প কিছু লোকের বা বাছাই করা গোষ্ঠীর শাসন বা এলিটের শাসন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষকগণ দেখানোর চেষ্টা করেছেন যে, মূল শাসন ক্ষমতা সবসময় অল্প কিছু বাছাইকৃত লোক দ্বারা পরিচালিত হয়। সেক্ষেত্রে প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে, প্রভাবের ভিত্তিতে, উত্তরাধিকারের ভিত্তিতে এ বাছাইকৃত অংশটি সৃষ্টি হয়। ক্ষমতার প্রকাশ্যে অথবা অন্তরালে অল্পসংখ্যক লোকই সবকিছু পরিচালনা করেন। মূলত এলিটবাদী বিশ্লেষকগণ এ তত্ত্ব প্রচার করেন। প্যারেটো (Pareto), মস্কা (Mosca) মিশেলস ( Mitchels), সি রাইট মিলস (C.Wright Mills), জেমস বার্নহাম (James Burnham) প্রমুখ সমাজতত্ত্ববিদ ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মুষ্ঠিমেয় লোকের প্রাধান্যে তত্ত্ব প্রচার করেছেন।


রাজনৈতিক ক্ষমতার বণ্টনে মুষ্ঠিমেয় ব্যক্তির প্রাধান্যের বা এলিট তত্ত্ব আলোচনা কর।


ব্যাখ্যা : এলিটতত্ত্ববিদগণ রাজনৈতিক ক্ষমতার বণ্টনের প্রকৃতি ও তার চূড়ান্ত নিয়ন্ত্রণকারী শক্তি হিসেবে। অর্থনৈতিক শক্তির প্রাধান্যে বিশ্বাস করেন না। তারা ঐকমত্য পোষণ করেন যে, রাজনৈতিক ক্ষমতা অসমভাবে বণ্টিত। তবে তারা ক্ষমতার বণ্টনে মার্কসবাদ বিরোধী। তারা সামাজিক-অর্থনৈতিক শক্তির বিন্যাসের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত 'শাসক শ্রেণির' তত্ত্ব প্রত্যক্ষণ করেছেন। এর পরিবর্তে তারা রাজনৈতিক ক্ষেত্রে 'বাছাই করা' মুষ্ঠিমেয় ব্যক্তির প্রাধান্যের তত্ত্ব (Political elite) প্রচার করেছেন। তারা মনে করেন যে, রাজনৈতিক ব্যবস্থা কেবল সামাজিক-অর্থনৈতিক সম্পর্ক দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নয়। ক্ষমতা বণ্টনের ক্ষেত্রে নিরপেক্ষ আলোচনা সম্ভব। তারা এ ধারণা ব্যক্ত করেছেন যে, রাজনৈতিক ক্ষমতা বাছাই করা কিছু মুষ্ঠিমেয় ব্যক্তি প্রয়োগ করলেও তাদের ক্ষমতার উৎস এক নয়। সামরিক, ধর্মীয় বা অর্থনৈতিক উপাদান ক্ষমতার উৎসরূপে কাজ করে। তারা সকলে একমত যে, সংখ্যালঘু শাসকদের নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের হাতে থাকা উচিত নয়। তবে তাদের চিন্তা-চেতনার মতবিরোধও আছে। নিম্নে প্রত্যেকের আলাদা মতবাদ তুলে ধরা হলো :


ক. পায়েটানো মস্কার (Gaetano Mosca) মতবাদ : মস্কা তাঁর The Ruling Class বইতে এ অভিমত ব্যক্ত করেছেন যে, প্রত্যেক সমাজেই দু'শ্রেণির মানুষ দেখতে পাওয়া যায়- একটি শাসক শ্রেণি অন্যটি শাসিত শ্রেণি। বাহ্যিকভাবে মার্কসের শ্রেণি তত্ত্বের সাথে সামঞ্জস্য থাকলেও দুটি তত্ত্ব এক নয়। কারণ, মস্কা মনে করেন শাসক শ্রেণি একটি সংগঠিত সংখ্যালঘু শ্রেণি হিসেবে আইনানুগ এবং বাস্তবসম্মত কর্তৃত্বের অধিকারী। এ শ্রেণি অসংগঠিত সংখ্যাগরিষ্ঠ শাসিত শ্রেণিকে শাসন করে। এটিই প্রত্যেক সমাজের শাসকের প্রকৃত বৈশিষ্ট্য।

আরো দেখুন : রাজনৈতিক তত্ত্ব ও রাজনৈতিক দর্শনের সম্পর্ক বিশ্লেষণ কর।

খ. ভিলফ্রেডো প্যারেটো'র (Villedo Federico Damaso Pareto) মতবাদ : প্যারেটো তাঁর The Mind and Society' গ্রন্থে এলিটকে দুটি ভাগে ভাগ করেছেন। যেমন- ১. শাসনকারী এলিট (Governing Elite) এবং ২. অশাসনকারী এলিট (Non-governing Elite)। অর্থাৎ প্যারোটোর তত্ত্বানুযায়ী সমাজের সদস্যদের শাসক এবং শাসিত এ দু'ভাগে ভাগ করা যায়। তিনি 'শাসনকারী এলিট' বা শাসন ক্ষমতাধিকারী বাছাই করা ব্যক্তি সমন্বয় এবং 'অশাসনকারী এলিট' বা শাসন ক্ষমতাহীন বাছাই করা ব্যক্তি সম্বন্বয়ের ধারণা উপস্থাপন করেছেন। তার মতে, শাসন ক্ষমতাধিকারী মুষ্ঠিমেয় বাছাই করা ব্যক্তি সমন্বয় সর্বদাই একটি ধীরগতি অথচ নিরন্তর প্রক্রিয়ার মধ্যে থাকে। নদীর মতো তারা প্রবহমান। ক্ষমতাহীনরা আজীবন শাসিত হয়ে থাকে। তার মতে, যখন 'শাসনকারী এলিট' ক্ষমতাচ্যুত হয় তখন অন্য এলিটরা এর স্থলাভিষিক্ত হয়। শাসনকারী এলিট ও অশাসনকারী এলিটদের এ উত্থান-পতন 'এলিট আবর্তন' বা Circulation of elite নামে অভিহিত। তাঁর মতে এটি চিরন্তন প্রক্রিয়া।


গ. রবার্ট মিশেলস (Robert Mitchels) এর অভিমত : রবার্ট মিশেলস তাঁর Political Parties বইতে মুষ্ঠিমেয় লোকের হাতে ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ তত্ত্ব (Contratization of power) প্রচার করেছেন। তিনি 'লৌহ শাসনের কঠোরবিধি' বা 'মুষ্ঠিমেয় ব্যক্তির শাসনের লৌহবিধি'র (Iron law of orligarchey) মাধ্যমে উপস্থাপন করেছেন যে, প্রত্যেক সংগঠনেই মুষ্ঠিমেয় ব্যক্তির শাসন অপরিহার্য। কোন সংগঠনের আদর্শ যতই গণতন্ত্রমনা হোক না কেন, চূড়ান্তভাবে তা আমলাতান্ত্রিক এবং মুষ্ঠিমেয় ব্যক্তির শাসনে পরিণত হতে বাধ্য। এর জন্যই প্রত্যেক সংগঠনেই মুষ্ঠিমেয় কিছু ব্যক্তি সকল ক্ষমতা পরিচালনা করে এবং সংখ্যাগরিষ্ঠরা তাদের দ্বারা পরিচালিত হয়। এ তত্ত্বানুসারে কর্তৃত্ব বেতনভোগী পদস্থ কর্মকর্তাদের ক্ষমতার স্তর বিন্যাস তথা 'পদসোপান' নীতির উপর নির্ভরশীল। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রেও আমলাতন্ত্র জনপ্রতিনিধিদের উপর প্রভাব বিস্তার করে।

রাজনৈতিক তত্ত্ব ও রাজনৈতিক দর্শনের সম্পর্ক বিশ্লেষণ কর


ঘ. সি. রাইট মিস (C. Wright Mill) এর অভিমত : তিনি তাঁর "The Power elite' গ্রন্থে মুষ্ঠিমেয়র শাসন তত্ত্ব প্রচার করেছেন। তিনি বলেন যে, মুষ্ঠিমেয় ব্যক্তির প্রাধান্যের ব্যবস্থা সমাজের প্রতিষ্ঠানগত অবস্থার ফল। আধুনিক সমাজে ক্ষমতা একটি প্রতিষ্ঠানিক আকার ধারণ করেছে। এর ফলে সমাজে কতিপয় প্রতিষ্ঠান এবং সেসব প্রতিষ্ঠানে উচ্চপদে আসীন ব্যক্তিবর্গই সামাজিক কাঠামোর গুরুত্বপূর্ণ পদ দখল করে রাখে। সুতরাং রাজনৈতিক ক্ষমতা কোনভাবেই ব্যক্তি বা শ্রেণির সাথে জড়িত নয়, বরং সামাজিক প্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িত। মুষ্ঠিমেয় ব্যক্তিই রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রয়োগ করে। মুষ্টিমেয় ব্যক্তি বলতে তাদেরকে বুঝায়, যারা ক্ষমতার স্তরবিন্যাস কাঠামোর উচ্চস্তরে আসীন, গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে সংগঠনকে পরিচালনা করে। সি. রাইট মিলস বাছাইকৃত ব্যক্তিসমন্বয়কে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক ব্যক্তিদের বিন্যাস নামে অভিহিত করেছেন। এ তত্ত্বের আরেক নাম হচ্ছে 'প্রতিষ্ঠান-কেন্দ্রিক তত্ত্ব"। পারস্পরিক সংশ্লিষ্ট চক্রের মাধ্যমে তারা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে থাকে।


ঙ. জেমস বার্নহাম'র (James Burnham) মতামত : তিনি তার The Managerial Revolution' গ্রন্থে মুষ্ঠিমেয় ব্যক্তির শাসনের পক্ষে অর্থনৈতিক যুক্তি উপস্থাপন করেছেন। তার মতে, মুষ্ঠিমেয় ব্যক্তির ক্ষমতা উৎপাদন এবং বণ্টনের প্রধান উপাদানসমূহের নিয়ন্ত্রণের উপর নির্ভরশীল। উৎপাদন এবং বণ্টনের উপর প্রাধান্য বিস্তার করার ফলে সমাজে মুষ্ঠিমেয় ব্যক্তিরা একটা সুবিধাজনক অবস্থান তৈরি করে এবং বিশেষ অগ্রাধিকারপূর্ণ ব্যবহার আদায় করে নেয়। ফলে তারা অন্যদের ক্ষমতা অর্জনের সুবিধা থেকে বঞ্চিত করতে পারে। কাজেই সমাজে যে গোষ্ঠীর আয় যত বেশি তারাই ক্ষমতা ভোগ এবং প্রয়োগ করে থাকে। বার্নহামের মূল লক্ষ্য সামাজিক পরিবর্তন নয়। পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থা ও বণ্টনের উপর মুষ্ঠিমেয় ব্যক্তির প্রাধান্য বজায় রাখাই তার তত্ত্বের মুখ্য উদ্দেশ্য।

রাজনৈতিক ক্ষমতা পরিমাপ করা কী সম্ভব? আলোচনা কর ।

চ. অন্যদের অভিমত : যোসেক সুম্পিটার সামাজিক জীবনে 'প্রাকৃতিক মনোনয়নের (Natural selection) ধারণা প্রয়োগ করে এলিট শাসনের তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করেছেন। জৈবিক প্রজাতি (Biological species) যেমন নতুন পরিবেশের সাথে সঙ্গতিবিধান করে বেঁচে থাকে, শাসন ক্ষমতাধর ব্যক্তিরাও তেমনি নতুন অবস্থায় অস্তিত্ব বজায় রাখতে ও শাসন করতে সক্ষম।


উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনা প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, গণতান্ত্রিক, স্বৈরতান্ত্রিক, সমাজতান্ত্রিক যে পদ্ধতির শাসন ব্যবস্থাই হোক না কেন প্রকৃতপক্ষে কোন রাষ্ট্রের কেবল ক্ষুদ্র একটি অংশই রাষ্ট্র শাসন করে থাকে। হয় তারা জনগণের প্রতিনিধি হয়ে নতুবা নিজেরাই রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে শাসনকার্য চালাতে থাকেন। রাষ্ট্রের স্থায়ী কাঠামোতে আমলাতন্ত্র (সামরিক ও বেসামরিক) সব সময় ক্ষমতা পরিচালনায় সহায়তাকারী। তবে উত্থান-পতন যাই হোক না কেন জনগণের শাসন প্রকৃত অর্থে কখনোই প্রতিষ্ঠিত হয় না। ঘুরে ফিরে এলিটরাই শাসন করে যারা ক্ষুদ্র একটি বাছাই করা মুষ্ঠিমেয় লোকের সমষ্টি।


#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Now
Ok, Go it!