বৈধতার সংকট কী? উন্নয়নশীল রাষ্ট্রে বৈধতার সংকটের কারণগুলো আলোচনা কর।

admin


ভূমিকা : উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলোর শাসনব্যবস্থার একটি বড় সমস্যা হলো বৈধতার সঙ্কট। এ রাষ্ট্রগুলোতে বৈধতার সঙ্কট মূলত এক প্রকার সাংবিধানিক সমস্যারূপে দেখা দেয়। ফলে সর্বদা রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বিরাজ করে এবং রাষ্ট্রসমূহের আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক উন্নয়নের প্রধান অন্তরায় হিসেবে কাজ করে ।


বৈধতার সংকট কী?


বৈধতার সঙ্কট : বর্তমানে অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলো বৈধতার সঙ্কটে পড়ছে। লুসিয়ান পাই এর মতে, “সরকারি কর্তৃত্বের বৈধ প্রকৃতি এবং সরকারের যথাযথ দায়িত্ব সম্পর্কে ঐকমত্য অর্জনজনিত সমস্যাই বৈধতার সমস্যা।” অর্থাৎ সরকারের আবির্ভাব, ক্ষমতারোহণ, শাসন পরিচালনা, গণসমর্থন, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অনুসরণ, আইনের শাসনের প্রকৃতি, সংবিধান ও সাংবিধানিকতার অনুসরণ এ সব কিছুর বিচার বিশ্লেষণের মাধ্যমে সরকার বা শাসনের বৈধতা নির্ধারণ করা হয়। এ সকল ক্ষেত্রে কোন ব্যতিক্রম হলে এবং তা জনগণের নিকট বিরূপ রূপে পরিলক্ষিত হলে বৈধতার সমস্যা বা সঙ্কট তৈরি হয়।


বৈধতার সঙ্কটের কারণ : উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলোতে শিক্ষার অভাব, দরিদ্রতা, রাষ্ট্রীয় বিধিবিধানের প্রতি অবজ্ঞা বা অজ্ঞতার কারণে রাজনৈতিক দালগুলো ছল-চাতুরীর আশ্রয় নিয়ে যেনতেন প্রকারে ক্ষমতায় থেকে যাওয়ার চেষ্টা করে। আবার এ সুযোগে প্রভাবশালী অরাজনৈতিক গোষ্ঠীও ক্ষমতা দখল করে নিয়ে জবরদস্তিমূলক শাসন চাপিয়ে দেয়। অধিকার ও সংবিধান অহরহ ভঙ্গ করা হয়। ফলে বৈধতার সমস্যা দেখা দেয়। বৈধতার সঙ্কটের কারণগুলো নিম্নরূপ :


১. সাংবিধানিক সমস্যা : সংবিধানের অন্তর্নিহিত দোষ-ত্রুটি এবং অপব্যাখ্যা থেকে শাসনের বৈধতা প্রশ্নের সম্মুখীন হয়। সংবিধান সাধারণত জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন হিসেবে কাজ করে। কিন্তু ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার লক্ষ্যে সংবিধানকে পরিবর্তন করে রাজনৈতিক পরিবেশকে নিজেদের অনুকূলে নেয়ার চেষ্টা থেকে সংকটের শুরু। আবার সংবিধানকে অলঙ্ঘনীয় করে জনসাধারণকে জিম্মী করা হয়। ফলে রাজনৈতিক সঙ্কটের পাশাপাশি বৈধতার সঙ্কটও দেখা দেয়।

আরো পড়ুন : “ক্ষমতাই রাজনৈতিক মূল ধারণা'-আলোচনা কর।

২. আমলাতান্ত্রিক জটিলতা : আমলারা আইনগত কর্তৃত্বের অধিকারী। এ কর্তৃত্ব যৌক্তিকতার সাথে ব্যবহার করার কথা থাকলেও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে রাজনৈতিক নেতৃত্বের দুর্বলতার কারণে আমলারা রাষ্ট্রীয় সেবকের বদলে জনগণের প্রভুর মতো আচরণ করে। ঘুরীয় কাজ করার প্রবণতার কারণে এরা যেমন জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করে তেমনি রাজনৈতিক কর্তৃত্ব ও নেতৃত্বকেও জনগণের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করিয়ে দেয়। ফলে সরকার অমানবিক, অন্যায্য ও অসাংবিধানিক কার্যকলাপ শুরু করে বৈধতার সঙ্কটে পড়ে।


৩. সশস্ত্র বাহিনীর ভূমিকা : সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান দায়িত্ব দেশের ভৌগোলিক অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা। কিন্তু রাজনৈতিক নেতৃত্বের ভুল এবং ক্ষমতা লিপ্সায় সশস্ত্র বাহিনীকে ব্যবহার প্রক্রিয়ায় সশস্ত্র বাহিনীও ক্ষমতালিপ্সু হয়ে উঠে। এক পর্যায় সরাসরি ক্ষমতা দখল করে নেয়। এরপর ধীর প্রক্রিয়ায় রাজনীতি চালু করে নিজেদের জন্য রাজনৈতিক দলগঠন করে নেয়। অথবা সশস্ত্র বাহিনী চাপ সৃষ্টি করে বেসামরিক প্রশাসনকে নিজেদের মতো করে সাজিয়ে নেয়। উভয়বিধ প্রক্রিয়ায় বৈধতার সঙ্কট দেখা দেয় তীব্র আকারে।


৪. রাষ্ট্রপরিচালনার নীতি ও আদর্শ : সাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্রপরিচালনার নীতি ও আদর্শ গ্রহণ করা হয়ে থাকে। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের স্বার্থে সরকারে থাকলে যে আদর্শ গ্রহণ ও বাস্তবায়নে উদ্যোগী হয় বিরোধী দলে গেলে তা ভুলে যায়। আবার নিজেদের মতো করে আদর্শ ও নীতি ঠিক করে নেয়। রাষ্ট্রীয় কার্যাবলি সঠিকভাবে নির্বাহের জন্য যোগ্য, দক্ষ, শিক্ষিত লোকবলের প্রয়োজনীয়তা থাকলে সকল ন্যায়-নীতি আদর্শ ত্যাগ করে স্বজনপ্রীতি, দলপ্রীতি ও গোষ্ঠীপ্রীতির মাধ্যমে অপেক্ষাকৃত দুর্বলদের প্রশাসনে জায়গা করে দেয়। প্রশাসন ধুকে ধুকে চলে। বৈধতার সঙ্কট দেখা দেয় ।


৫. স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রশ্ন থেকে : উন্নয়নশীল দেশগুলো বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ঔপনিবেশিক বা অভ্যন্তরীণ উপনিবেশ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় দলমত নির্বিশেষে সকলে অংশ নিলেও স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে এ যুদ্ধ নিয়ে, যুদ্ধের উদ্দেশ্য নিয়ে, নেতৃত্ব নিয়ে নানাবিধ জটিলতা সৃষ্টি হয়। কোন একটি দল বা গোষ্ঠী বাকিদের কোণঠাসা করে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করে। অনেকসময় বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো নিষিদ্ধ করে অথবা প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করে দল অবলুপ্ত করতে বাধ্য করে এক দলীয় শাসন বা একদল প্রাধান্য শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে। এতে দেশে-বিদেশে বৈধতার সঙ্কট দেখা দেয়। জিম্বাবুয়ে এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ।


৬. অস্বচ্ছ ও জবাবদিহিতা বিহীন শাসন : সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা মৌলিক বিষয়। কিন্তু উন্নয়নশীল দেশগুলোতে শাসন ও রাষ্ট্রীয় কার্যাবলির ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা লক্ষ করা যায় না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সরকারি কাজে ‘দায়মুক্তি দেয়া হয়। জবাবদিহিতার জায়গা পার্লামেন্ট থাকে আজ্ঞাবহ। জবাবদিহিতার আরেক জায়গা নির্বাচন তাও প্রশ্নবিদ্ধ। ফলে শাসকদল সবসময়ে বিরোধী দলকে দায়ী করে। আর বিরোধী দল সরকারি কোন কাজেকে ভালো বলে না। ফলে কর্তৃত্বের বৈধতা প্রশ্নের সম্মুখীন হয়।

আরো পড়ুন : রাজনৈতিক তত্ত্ব ও রাজনৈতিক দর্শনের সম্পর্ক বিশ্লেষণ কর।

৭. জনবিচ্ছিন্নতা : উপরের কারণগুলো ধারাবাহিকভাবে ঘটতে থাকলে এসময় সরকার জনবিচ্ছিন্ন হয়ে জনগণকেই প্রতিপক্ষ মনে করে প্রচণ্ড দমনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে। এরূপ ব্যবস্থাকে সরকার অত্যাবশ্যক মনে করে এবং প্রায়শই সন্ত্রাসী কার্যকলাপ বলে প্রচার করে। বিরোধী গোষ্ঠীকে নির্মূল করতে চায়। বিরোধীরাও নতুন করে আন্দোলন শুরু করে। জনজীবন হয়ে পড়ে অসহায়। সরকার এবং বিরোধী উভয় জায়গা থেকে টার্গেটে হতে হয়। তখন জনগণের কাছে সরকারের বৈধতা চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়। সরকার সঙ্কটে পড়ে।


উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, উল্লিখিত বিষয়গুলো ছাড়াও দুর্নীতি, সাম্প্রদায়িকতা ইত্যাদি বিষয়ও শাসন বা কর্তৃত্বের বা ক্ষমতার বৈধতার সঙ্কট তৈরি করে। উল্লিখিত ব্যবস্থাগুলো সংঘটিত হতে না দিলেই বৈধতার সংকট থেকে মুক্তি পাওয়া যেতে পারে।


#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Now
Ok, Go it!