ভূমিকা :
ফরাসি বিপ্লবের মহান নায়ক ও দার্শনিক, সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতার প্রবক্তা গণসার্বভৌমত্বের অকুণ্ঠ | সমর্থনকারী জ্যা জ্যাক রুশো ১৭২২ খ্রিস্টাব্দে জেনেভার এক মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। জ্যা জ্যাক রুশোর- "The Social contract গ্রন্থে তিনি যে সামাজিক চুক্তির কথা উল্লেখ করেছেন তার ভিত্তি হলো সাধারণ ইচ্ছা এবং এই সাধারণ ইচ্ছাই হলো রাষ্ট্র ও সার্বভৌমত্বের প্রতীক। রুশোর এই গ্রন্থটি রাষ্ট্রচিন্তার জগতে এক অমূল্য সম্পদ। এই গ্রন্থে বর্ণিত সাধারণ ইচ্ছা তত্ত্বটি রাজনৈতিক ক্ষেত্রে রুশোর সর্বশ্রেষ্ঠ অবদান হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। তাঁর মতে, ব্যক্তি সাধারণত দুই ধরনের ইচ্ছা প্রকাশ করে। একটি তার ব্যক্তি স্বার্থকেন্দ্রিক যথার্থ ইচ্ছা (Actual will) | এবং অপরটি সামাজিক কল্যাণ কেন্দ্রিক প্রকৃত ইচ্ছা (Real will)
→ সাধারণ ইচ্ছা তত্ত্ব : রুশোর “সাধারণ ইচ্ছা তত্ত্ব" রাষ্ট্র দর্শনে বিশেষ স্থান দখল করে আছে। কেউ একে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার মূর্তপ্রতীক এবং রাজনৈতিক দর্শনের চরম প্রকাশ । বলে উল্লেখ করেছেন। আবার অনেকে একে কল্পিত রূপরেখা। বলে আখ্যায়িত করেছেন। তবে তাঁর “সাধারণ ইচ্ছা" ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের দিশারি এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতিচ্ছবি। সাধারণ ইচ্ছা তত্ত্বটি রাষ্ট্রীয় দর্শনে রুশোর শ্রেষ্ঠতম অবদান। রুশোর মতে, প্রত্যেক ব্যক্তির মধ্যে দুই ধরনের ইচ্ছার সঞ্চার হতে পারে। যথা :
-
১. ব্যক্তির যথার্থ ইচ্ছা : ব্যক্তির যথার্থ ইচ্ছা হচ্ছে তার যুক্তিবিবর্জিত যা ব্যক্তিস্বার্থের ওপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত। এই মহা সংকীর্ণ, ক্ষণস্থায়ী এবং বিরোধপূর্ণ। এটা সমাজের কল্যাণে নিয়োজিত না থেকে ব্যক্তিস্বার্থ রক্ষায় নিয়োজিত থাকে।
কিভাবে সুইপার সোশ্যাল ( Swiper social) যুক্ত হয়ে টাকা ইনকাম করবেন?
২. ব্যক্তির প্রকৃত ইচ্ছা : প্রকৃত ইচ্ছা ব্যক্তির বিবেকসম্পন্ন ইচ্ছার অভিব্যক্তি। এই ইচ্ছা হচ্ছে ব্যক্তির যুক্তিযুক্ত ইচ্ছা এবং এটা সমাজের সাধারণ কল্যাণ ও মঙ্গল সাধনায় নিয়োজিত থাকে।
→ সাধারণ ইচ্ছা তত্ত্বটির বৈশিষ্ট্য : সাধারণ ইচ্ছার কিছু বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। নিম্নে আলোচনা করা হলো :-
১. সার্বভৌম : রুশোর মতে, সাধারণ ইচ্ছা কল্যাণকামী তাই এটা সার্বভৌম। এটা সীমাহীন ক্ষমতার অধিকারী। জনগণের মধ্যে চুক্তির ফলে এটা সম্ভব হয়েছে। রুশোর মতে, সাধারণ- ইচ্ছার বাইরে মানুষ পুরোপুরি স্বাধীনতা ভোগ করতে পারে না। অর্থাৎ সাধারণ ইচ্ছা শুধুমাত্র সার্বভৌমই নয়, চরম ক্ষমতারও অধিকারী।
২. ঐক্যের প্রতীক : রুশোর মতে, সাধারণ ইচ্ছা রাষ্ট্রীয় ঐক্যের প্রতীক। সাধারণ ইচ্ছাকে টিকিয়ে রাখতে হলে তাই, রাষ্ট্রীয় সংগঠনকে সংহতি বজায় রাখতে হবে।
৩. জনগণের কল্যাণ : সাধারণ ইচ্ছার লক্ষ্য হলো প্রত্যেকের কল্যাণ সাধন করা। তা সকলের বা অধিকাংশের বা সংখ্যালঘিষ্ঠের ইচ্ছা কিনা তা জানা এক্ষেত্রে নিষ্প্রয়োজন । কোনো কোনো সময়ে তা সকলের ইচ্ছা হতে পারে আবার কোনো কোনো সময় তা অধিকাংশের ইচ্ছা হতে পারে।
৪. সাধারণ ইচ্ছাস্থায়ী ও হস্তান্তরযোগ্য নয়: রুশোর মতে, সাধারণ ইচ্ছা চিরস্থায়ী এবং অহস্তান্তরযোগ্য। সাধারণ ইচ্ছা কল্যাণের প্রতীক। সাধারণত যা কিছু কল্যাণকর তাই স্থায়ী। সুতরাং সাধারণ ইচ্ছাও স্থায়ী। এছাড়াও তিনি বলেছিলেন, কোনো ব্যক্তির জীবন দ্বীপকে যেমন- হস্তান্তরিত করা যায় না, তেমনি সাধারণ ইচ্ছাও হস্তান্তরবিহীন।
৫. গণমুক্তির সহায়ক : সাধারণ ইচ্ছা গণমুক্তির সহায়ক। সকলে এ নির্দেশ মেনে চলতে বাধ্য। কেউ এর বিরুদ্ধাচরণ করলে সামাজিক চুক্তি অনুযায়ী বল প্রয়োগ দ্বারা তাকে মানতে বাধ্য করা উচিত।
৬. সাধারণ ইচ্ছা নির্ভুল : রুশোর মতে, মানুষ ব্যক্তিস্বার্থের কারণে ভুল করতে পারে। কিন্তু কখনোই সাধারণ ইচ্ছা ভুল করতে পারে না। কারণ মানুষ যখন তাদের ব্যক্তিগত স্বার্থকে বিসর্জন দিয়ে সমাজের সকলের স্বার্থের কথা চিন্তা করে একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হয় তখন সে সিদ্ধান্তের আর কোনো ভুল থাকতে পারে না ।
৭. সকলের ইচ্ছা সাধারণ ইচ্ছা নয় : সাধারণ ইচ্ছা সকলের ইচ্ছার সমষ্টি নয়। অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় সংগঠনের সব ইচ্ছা বা ইচ্ছার সমষ্টি সাধারণ ইচ্ছা নয়। এটি সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠের ইচ্ছার যোগফল নয়। সাধারণ ইচ্ছা হলো সমাজের রাষ্ট্রীয় সংগঠনের সকল ব্যক্তির সকল প্রকৃত ইচ্ছার সমষ্টি।
৮. সাধারণ ইচ্ছা অধ্বংসনীয় : রুশোর মতে, সাধারণ ইচ্ছা অধ্বংসনীয়। রাষ্ট্র একবার সৃষ্টি হলে তা যেমন ধ্বংস হয় না অনুরূপ সাধারণ ইচ্ছাও ধ্বংস হয় না। তিনি আরও বলেন, মতভেদ ও বিরোধিতাকে আমন্ত্রণ জানানোর অর্থ হলো সাধারণ ইচ্ছাকে ধ্বংস করা। আর সাধারণ ইচ্ছা ধ্বংস মানে রাষ্ট্রের ধ্বংস। কিন্তু রাষ্ট্রকে ধ্বংস করে ফেলার জন্য সৃষ্টি হয়নি । তাই রুশো বলেন- "General will is always Constant Unalterable pure.
৯. সকল ক্ষমতার উৎস : এটি সাধারণ ইচ্ছার অন্যতম উল্লেখযোগ বৈশিষ্ট্য। কেননা সাধারণ ইচ্ছা সকল ক্ষমতার উৎস। সরকার এখানে সাধারণ ইচ্ছার ভৃত্য। এটা সাধারণ ইচ্ছার ব্যা মতানুযায়ী কার্যকর থাকে।
১০. সবার ইচ্ছার প্রতিফলন : সাধারণ ইচ্ছা সকল অবস্থাতে চূড়ান্ত, ন্যায্য ও সঠিক। সাধারণ ইচ্ছায় কোনো ব্যক্তির ইচ্ছা-অনিচ্ছার কোনো প্রাধান্য থাকে না, কিন্তু সবার ইচ্ছার সা প্রতিফলন ঘটে।
১১. সাধারণ ইচ্ছা গণতান্ত্রিক : সাধারণ ইচ্ছা ব্যক্তি যে স্বাধীনতাকে নিশ্চিত করে এবং জনগণের অধিকার সংরক্ষণ স্ব করে। তাই বলাই যায় যে, সাধারণ ইচ্ছা গণতান্ত্রিক ।
১২. নিয়ন্ত্রণবিহীন : সাধারণ ইচ্ছার ক্ষমতার ওপরে কার্যত কোনো বাধা-নিষেধ করা যায় না। তাই এটা নিয়ন্ত্রণ বিহীন।
১৩. ন্যায়বিচারের মাপকাঠি : সাধারণ ইচ্ছা মতবাদের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য ন্যায়বিচারের মাপকাঠি। কেননা সাধারণ ইচ্ছা ন্যায়বিচারের একমাত্র মাপকাঠি
১৪. আইন প্রণয়ন করা : সাধারণ ইচ্ছা কোনো নির্বাহী নয়। এর কার্য হলো আইন প্রণয়ন করা। আইন কার্যকরী করা নয়।
সমালোচনা :
সাধারণ ইচ্ছা তত্ত্ব রুশোর রাষ্ট্রদর্শনের একটি উল্লেখযোগা দিক হলেও এটা নানাভাবে সমালোচিত হয়েছে । নিম্নে আলোচনা করা হলো :
১. অস্পষ্ট ন্যায়নীতির মানদণ্ড : রুশোর মতে, সাধারণ ইচ্ছা সামাজিক ন্যায়নীতির একমাত্র মানদণ্ড। কিন্তু সাধারণ ইচ্ছা কীভাবে ন্যায়নীতির মানদণ্ড হিসেবে ব্যবহৃত হয় তা স্পষ্ট করে বলা হয়নি।
২. ব্যক্তি স্বাধীনতার পরিপন্থী : রুশোর মতে, যদি কেউ সাধারণ ইচ্ছাকে মেনে চলতে অস্বীকার করে তবে তাকে বল প্রয়োগের মাধ্যমে তা মেনে চলতে বাধ্য করা হবে। যা ব্যক্তি স্বাধীনতাকে ক্ষুণ্ণ করে রুশোর সাধারণ ইচ্ছায় ।
৩. আইনের অপপ্রয়োগ : সার্বভৌমের কথা বলে মূলত আইনকে একটি নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে নিয়ে গেছেন। যার দরুন আইনের অপপ্রয়োগ ঘটে।
৪. বৃহত্তর রাষ্ট্রের অনুপযোগী : রুশোর মতে, সাধারণ ইচ্ছা জনগণের সাধারণ স্বার্থ রক্ষা করতে বদ্ধপরিকর। কিন্তু আধুনিক বৃহত্তর রাষ্ট্রে সাধারণ স্বার্থরক্ষা করা অসম্ভব।
৫. আপেক্ষিক মতবাদ : রুশোর সাধারণ ইচ্ছা মতবাদটি মূলত আপেক্ষিক। কেননা মানুষের চিন্তা বা আকঙ্ক্ষাকে আঙ্গিক নিয়মে যোগ- বিয়োগ করে কোনো একটা বস্তুগত বিষয়ে উপস্থাপন করা যায় না।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, উপরিউক্ত সমালোচনা ও মতভেদসমূহ থাকা সত্ত্বেও জ্যা জ্যাক রুশোর “সাধারণ ইচ্ছা তত্ত্ব রাজনৈতিক দর্শনের ইতিহাসে যথেষ্ট মূল্য বহন করে। এটি ব্যক্তিস্বাধীনতা ও রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের এক অপূর্ব সমন্বয়। সাধারণ ইচ্ছা হচ্ছে জনগণের কল্যাণকামী ইচ্ছা যা প্রতিটি ব্যক্তিরই কাম্য। তাই এ ইচ্ছা অভ্রান্ত এবং এর বিরোধিতা অন্যায়। এ ইচ্ছা হলো সমষ্টিগত চেতনা। এতে আছে কল্যাণমুখী মনোভাব এবং যৌথ অভিপ্রায়ের বাস্তবায়ন। গণতান্ত্রিক আদর্শের ধারণা সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতা ও জনগণের সার্বভৌমত্বের ধারণা রুশোর সাধারণ ইচ্ছা তত্ত্বে পাওয়া যায়। ফরাসি বিপ্লবের মূল স্পেগান রুশোর সাধারণ ইচ্ছারই বাস্তবরূপ। মোটকথা, আদর্শ হিসেবে রুশোর সাধারণ ইচ্ছাতত্ত্ব' ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যের দিশারি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থারই প্রতিচ্ছবি।