ক্ষমতার সম্পর্ক নির্ধারণের সমস্যাগুলো আলোচনা কর।

admin

 

ভূমিকা : রাজনৈতিক ক্ষমতা শব্দটির সাথে প্রভাব, কর্তৃত্ব, মর্যাদা, বৈধতা ইত্যাদি বিষয়গুলো জড়িত। এ সকল কিছুর সাথে আবার জনগণ জড়িত। জনগণের সাথে শাসকের সম্পর্ক, সরকারের, বিভিন্ন বিভাগের সম্পর্ক, ক্ষমতাধরদের পারস্পরিক সম্পর্ক, রাজনৈতিক দলগুলোর সম্পর্ক এ সব কিছুর সাথে ক্ষমতার সম্পর্ক বিদ্যমান। সঙ্গত কারণে এখানে সমস্যাও বিদ্যমান।


ক্ষমতার সম্পর্ক নির্ধারণের সমস্যাগুলো আলোচনা কর।


ক্ষমতার সম্পর্ক নির্ধারণের সমস্যা : ক্ষমতার সম্পর্ক নির্ধারণের সমস্যাগুলো নিম্নে আলোচনা করা হলো -


১. ক্ষমতার সম্পর্ক সর্বদা সুস্পষ্ট নয় : রাজনৈতিক ক্ষমতাকে একটি সম্পর্ক হিসেবে বিবেচনা করলেও এ সম্পর্ক সব সময় সুস্পষ্ট নয়। প্রকৃতপক্ষে ক্ষমতা সম্পর্কিত কোন অবস্থার মধ্যে কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর আচরণ কেন প্রভাবিত ও পরিবর্তিত হয় তা নির্ধারণ করা কষ্টকর। যেমন- প্রধানমন্ত্রী যদি কোন মন্ত্রীকে পদত্যাগ করতে বলেন এবং মন্ত্রী যদি পদত্যাগ করেন তা হলে এখানে প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক ক্ষমতা বিদ্যমান। কিন্তু ভিন্ন কারণে মন্ত্রীর পদত্যাগ যদি প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছার কাকতালীয় রূপ (Coincidence) হয় তাহলে প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক ক্ষমতা কিভাবে নির্ধারণ করা যাবে? পদত্যাগী মন্ত্রী যদি পদত্যাগের যে কারণ উল্লেখ করেন, তার সাথে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য যদি এক না হয় তাহলে সমস্যা দেখা দেবে।


২. ক্ষমতাবানদের ক্ষমতার তারতম্য : কোন বিষয়ে এবং কোন ব্যক্তির ক্ষেত্রে অন্য কোন ব্যক্তির ক্ষমতা আছে এ ব্যাপারে সমস্যা দেখা দিতে পারে। যেমন- ঢাকা সিটি কর্পোরেশন (উত্তর) এর পরিচালকের সুযোগ-সুবিধা ও ক্ষমতা কাউন্সিলরের তুলনায় বেশি তাহলে ক্ষমতার সম্পর্ক এক ধরনের সম্পর্ককে বুঝাবে। আবার যদি বলা হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার চেয়ে বেশি তাহলে আরেক ধরনের সম্পর্ক বুঝাবে। এখানে প্রথম উদাহরণে পরিচালকের প্রাধান্যের বিষয়টি স্পষ্ট। দ্বিতীয় উদাহরণে কোন তৃতীয় পক্ষকে নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে মার্কিন রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির তুলনায় বেশি এটাকেই বুঝাবে। উল্লিখিত তৃতীয় পক্ষ অন্যকোন দেশে রাষ্ট্রপতি হতে পারেন আবার নিজ দেশের মন্ত্রিসভা, আইনসভা বা আমলাতন্ত্রও হতে পারে। কোন প্রতিষ্ঠান বা পদাধিকারীর রাজনৈতিক ক্ষমতা বিশ্লেষণ করতে হলে সমসাময়িক প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির আচরণ নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে তার প্রভাব বিস্তারের সক্ষমতার বিষয়টি বিবেচনা করা প্রয়োজন। কারণ, ক্ষমতা পরিবর্তনশীল। মার্কিন সুপ্রিম কোর্টের প্রথমদিককার ক্ষমতার চেয়ে সাম্প্রতিক ক্ষমতার বিরাট তারতম্য বিদ্যমান।


রবার্ট ডাল কোন নির্দিষ্ট অবস্থায় ক্ষমতার সম্পর্ক নির্ধারণ করা যায় বা সন্ধান করা যায় তা নিয়ে আলোচনা করেছেন। তার মতে চারটি উপায়ে ক্ষমতার সম্পর্ক পর্যবেক্ষিত হতে পারে। কিন্তু সেখানেও সমস্যা থাকতে পারে। কারণ চারটি উপায় বা পদ্ধতি এককভাবে সম্পূর্ণরূপে নির্ভুল নয়। চারটি পদ্ধতি হচ্ছে :


১. ক্ষমতা পদবী বা পদমর্যাদার উপর নির্ভরশীল : কোন ব্যক্তির ক্ষমতা সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ব্যবস্থায় তার পদমর্যাদার উপর নির্ভর করে। রাজনৈতিক ব্যবস্থায় কোন ব্যক্তি কোন পদমর্যাদার অধিকারী, কে বেশি গুরুত্বপূর্ণ, সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে কোন গোষ্ঠীর কত প্রতিনিধি আছে ইত্যাদি বিষয় আলোচনা করে ক্ষমতার সম্পর্ক অনুধাবন করা যায়। এ পদ্ধতির প্রধান গুণ হলো এটি সহজ ও সরল। স্থান, কাল, নথিপত্র সহজে সংগ্রহ করা যায়। ডালের মতে, এ পদ্ধতির মাধ্যমে ব্যাপক ঐতিহাসিক পরিবর্তন এবং ব্যাপক রাজনৈতিক ব্যবস্থার তারতম্য, কেন রাজনীতিতে সমাজের একটা অংশের প্রভাব হ্রাস পায় ও কেন বিশেষ সামাজিক, অর্থনৈতিক স্তরের উদ্ভব ঘটে এবং বিভিন্ন বাছাই করা গোষ্ঠীর সম্পর্ক নির্ধারণ করা যায়। তবে সমস্যা হলো আনুষ্ঠানিক পদমর্যাদার ভিত্তিতে এককভাবে কোন পদাধিকারীর ক্ষমতার মূল্যায়ন সম্ভব নয়। যারা রাজনৈতিক পদাধিকার (King-maker) গড়ে তোলেন, যে সব রাজনৈতিক কর্ণধার (Political boss) এবং যে সব শ্রেণি বা সম্প্রদায় পরোক্ষভাবে আনুষ্ঠানিক পদমর্যাদা বণ্টনে সহায্য করে, তাদের বিষয় এ পদ্ধতির মাধ্যমে জানা বা অনুধাবন করা অসম্ভব।

আরো দেখুন : ফরাসি বিপ্লবে দার্শনিকদের অবদান মূল্যায়ন কর ।

২. প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে সম্পর্ক অনুধাবন করা সম্ভব : বিভিন্ন পর্যবেক্ষকের প্রদত্ত তথ্যাবলির ভিত্তিতে ক্ষমতার সম্পর্ক অনুধাবন করা সম্ভব। পর্যবেক্ষকদের পর্যবেক্ষিত তথ্যের বা সিদ্ধান্তের তুলনামূলক বিশ্লেষণের মাধ্যমে কোন ব্যক্তির ক্ষমতার সম্পর্ক বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া যায়। সহজে, কম ব্যয় এবং দ্রুততার সাথে এটি প্রয়োগযোগ্য। ঐতিহাসিক ঘটনাবলির বিশ্লেষণেও এ পদ্ধতি প্রয়োগ করা যায়। সমস্যা হলো এখানে পর্যবেক্ষকদের প্রদত্ত তথ্যের উপর নির্ভরশীল থাকতে হয়। পর্যবেক্ষকরা সব সময় নিরপেক্ষ নাও হতে পারেন।


৩. বিভিন্ন ব্যক্তির ভূমিকা বিশ্লেষণের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ সম্ভব : ক্ষমতার সম্পর্ক নির্ধারণে আনুষ্ঠানিক পদমর্যাদার সীমানা পেরিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ব্যক্তির ভূমিকা বিশ্লেষণ করে তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভব। এ পদ্ধতির মাধ্যমে বিভিন্ন প্রকার ক্ষমতার ধরন সম্পর্কে অবহিত হওয়া যায় ; একটি বিষয় হতে অন্য বিষয়ের ক্ষমতার তারতম্য: একটি বিষয়ের সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী ব্যক্তির বিশেষ ক্ষমতার সাথে অনেক বিষয়ে ক্ষমতা প্রয়োগকারী ব্যক্তির তারতম্য ও মূল্যায়ন করা সম্ভব। সমস্যা হলো এ পদ্ধতিতে অংশগ্রহণকে (Participation) ক্ষমতার সমার্থক মনে করা হয়। কোন বিষয়ে অংশগ্রহণ করা আর ক্ষমতার প্রয়োগ করা এক বিষয় নয়, সমার্থক নয়। সচিব পর্যায়ের পদাধিকারীর মন্ত্রীর সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আলাপ পরামর্শ করতে পারেন। কিন্তু সচিব নিজেই ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারেন না। এর জন্য মন্ত্রীর বা প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন প্রয়োজন ।


৪. সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীদের কার্যকলাপ সম্পর্ক অনুধাবনে সহায়ক : সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী ও তাদের কার্যকলাপ বিশ্লেষণ করে ক্ষমতার সম্পর্ক অনুধাবন করা সম্ভব। রবার্ট ডাল নিউ হ্যাভেনে (New Haven) দীর্ঘকালের সিদ্ধান্ত গ্রহণের তথ্য সংগ্রহ করে ক্ষমতার সম্পর্ক নির্ণয়ের চেষ্টা করেছেন। কোন ব্যক্তি কত প্রস্তাব উত্থাপন করেছেন এবং তার মধ্যে কতকগুলো নীতি প্রণয়নে গৃহীত হয়েছে; কোন ব্যক্তি সাফল্যের সাথে কতবার অন্যের বক্তব্যের ও প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছেন- এগুলোর মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, যে ব্যক্তি বেশিবার সিদ্ধান্ত গ্রহণে অংশগ্রহণ করেছেন এবং প্রভাব বিস্তার করেছেন সেই ব্যক্তিই সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী। তবে সবসময় তা নাও হতে পারে, বরং এ প্রভাবের কারণে ভুল সিদ্ধান্তও গৃহীত হতে পারে।


উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, রাজনৈতিক ক্ষমতার সম্পর্ক অত্যন্ত জটিল। ব্যক্তি থেকে ব্যক্তি, গোষ্ঠী থেকে গোষ্ঠী, বিভিন্ন ক্ষেত্রে এর সরলীকরণ যেমন করা হয় তেমনি জটিল সমস্যাও দেখা দেয়। স্থান- কাল-পাত্রভেদে ক্ষমতার সম্পর্ক বিভিন্ন রকম। ক্ষমতার সম্পর্ক একটি আপেক্ষিক বিষয়।


#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Now
Ok, Go it!