রাজনৈতিক তত্ত্ব ও রাজনৈতিক দর্শনের সম্পর্ক বিশ্লেষণ কর।

admin


ভূমিকা : সাধারণভাবে রাজনৈতিক দর্শনকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অন্যতম আলোচ্যবিষয় হিসেবে গণ্য করা হয় । রাজনৈতিক দর্শন রাজনৈতিক জীবনের বিশ্ববীক্ষা (World view) রূপে চিহ্নিত। রাজনৈতিক দর্শন বলতে সমাজের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক, রাজনৈতিক ও সামাজিক জীবনের পারস্পরিক সম্পর্ক, ব্যক্তির রাজনৈতিক অবস্থান ও চেতনা, আর্থসামাজিক নৈতিক, বৈজ্ঞানিকসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রের সঙ্গে জড়িত রাজনৈতিক ক্ষেত্রের মিথস্ক্রিয়া এবং ব্যক্তির সঙ্গে রাজনৈতিক ক্ষেত্রের সম্পর্কের সর্বজনীন তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গিকে বুঝায়। রাজনৈতিক দর্শন রাজনৈতিক জীবনের তাত্ত্বিক জ্ঞানের সমাহার। রাজনৈতিক তত্ত্ব ও রাজনৈতিক দর্শনের সম্পর্ক নিম্নরূপ :


রাজনৈতিক তত্ত্ব ও রাজনৈতিক দর্শনের সম্পর্ক বিশ্লেষণ কর।


রাজনৈতিক তত্ত্ব ও দর্শনের সম্পর্ক : সাধারণভাবে রাজনৈতিক দর্শনকে রাজনৈতিক জীবনের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য এবং তাত্ত্বিক জ্ঞানরূপে উল্লেখ করা হয়। ডেভিড আপটার (Devid Apter) মনে করেন, মানবিক ঘটনাবলির ক্ষেত্রে প্রয়োগযোগ্য যুক্তিই হলো রাজনৈতিক দর্শন। রাজনৈতিক দর্শন উদ্দেশ্য ও নৈতিক লক্ষ্যের উপর গুরুত্বারোপ করে।


ক. ডি. ডি. রাফায়েলের (D. D. Rafael) মত : ডি. ডি. রাফায়েল সামাজিক ও রাজনৈতিক দর্শনকে দর্শনের একটি শাখারূপে গণ্য করেছেন। সমাজ এবং রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে ভাবধারা সম্পর্কে দর্শনের চিন্তাকেই তিনি যথাক্রমে সামাজিক এবং রাজনৈতিক দর্শন নামে অভিহিত করেছেন। তার মতে, রাজনৈতিক দর্শন এবং রাজনৈতিক তত্ত্বকে অনেক সময় সমার্থক মনে করা হয়। রাফায়েল রাজনৈতিক দর্শনের আলোচনাকে পাঁচটি ভাগে ভাগ করেছেন। যেমন-

১. বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব ও দার্শনিক তত্ত্বের পার্থক্য

২. বিশ্বাসের সমালোচনামূলক মূল্যায়ন

৩. ধারণার ব্যাখ্যা

৪. দর্শন ও মতাদর্শ ও

৫. parafasana saprata safe (a) difference between scientific and philosophical theory. (b) critical evaluation of beliefs (e) clarification of concepts. (d) philosophy and ideology (e) methodc logy of the social scieness)


খ. লিও স্ট্রাউজ এর মত : লিও স্ট্রাউজ (Leo Strauss) তাঁর What is Philosophy? গ্রন্থে তত্ত্ব ও রাজনৈতিক দর্শনকে রাষ্ট্রচিন্তার অংশ বলেছেন। রাজনৈতিক তত্ত্ব রাজনৈতিক বিষয়ের প্রকৃতি অনুধাবনের চেষ্টা করে। তিনি রাজনৈতিক দর্শন ও রাজনৈতিক তত্ত্বকে পরস্পরের পরিপূরক হিসেবে উল্লেখ করেছেন। মূল্যেবোধের ধারণা রাজনৈতিক দর্শনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী কেবল মতামতের বাহক নন, তিনি রাজনৈতিক জ্ঞানেরও বাহক। মতামত অপেক্ষা জ্ঞানের ব্যাপকতা অনেক বেশি। স্ট্রাউজ রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ও রাজনৈতিক দর্শনের মধ্যে কোন কৃত্রিম পার্থক্য নির্ণয়ের বিরোধী । তিনি রাজনৈতিক দর্শনকে মূলত রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সমার্থক হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তিনি আদর্শহীন ও দর্শনহীন রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অস্তিত্ব অস্বীকার করেছেন।


রাজনৈতিক তত্ত্ব ও দর্শনের সম্পর্ক অত্যন্ত গভীর। সাবেকী রাজনৈতিক আলোচনায় রাজনৈতিক তত্ত্ব ও দর্শনের মধ্যে কোন সীমারেখা ছিল না। রাজনৈতিক তত্ত্ব সম্পূর্ণরূপে রাজনৈতিক দর্শনের অন্তর্ভুক্ত ছিল। রাজনৈতিক দর্শনে মূল্যবোধের ধারণা ও ঔচিত্য অনৌচিত্যের প্রশ্ন অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত ছিল। ঊনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত এ ধারা বিদ্যমান ছিল।


রাজনৈতিক তত্ত্ব ও দর্শনের পার্থক্য : সাবেকী চিন্তাধারায় রাজনৈতিক তত্ত্ব ও দর্শনকে সমার্থক হিসেবে গণ্য করা হতো। কিন্তু দৃষ্টবাদের (Positivism) আবির্ভাবে রাজনৈতিক দর্শনের ঐতিহ্যের ক্ষেত্রে ব্যাঘাত সৃষ্টি হয়। দৃষ্টিবাদের লক্ষ্য হলো সামাজিক বিজ্ঞানের বিজ্ঞানসম্মত, অভিজ্ঞতাবাদী এবং মূল্যবোধহীন বিশ্লেষণ উপস্থাপন করা। দৃষ্টবাদের ফলে রাজনৈতিক তত্ত্ব ও দর্শনের মধ্যে পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। একস্টেইন (Eckstein) রাষ্ট্রবিজ্ঞান এবং রাজনৈতিক দর্শনের মধ্যে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্যের কথা উল্লেখ্য করেছেন। যেমন-

১. বিষয়বস্তু (subject),

২. লক্ষ্য (Objective),

৩. বৈধতা বিচারের মানদত্ত (Criteria of validity)।

বিষয়বস্তুর দিক থেকে রাজনৈতিক দর্শন কেবল লক্ষ্য নিয়েই আলোচনা করে না; লক্ষ্যে পৌঁছানোর মাধ্যমও পর্যালোচনা করে। রাজনৈতিক দর্শনের লক্ষ্য হলো ব্যাপক তত্ত্ব গঠন। রাজনৈতিক দর্শন বৈধতা বিচারের ঊর্ধ্বে। রাজনৈতিক তত্ত্ব ও দর্শনের পার্থক্য নিম্নরূপ :


১. উদ্দেশ্যগত থেকে উভয়ের পার্থক্য : রাজনৈতিক তত্ত্ব ও দর্শনের মধ্যে উদ্দেশ্যগত দিক থেকে মৌলিক পার্থক্য লক্ষণীয়। রাজনৈতিক তত্ত্বের উদ্দেশ্য হলো রাজনৈতিক ঘটনাবলির ব্যাখ্যা বা কার্য-কারণগত সম্পর্ক নির্ণয় করা। রাজনৈতিক তত্ত্বের আধুনিক বিশ্লেষকগণ কোন একটি বিশেষ ঘটনাকে ব্যাখ্যা করার পরিবর্তে একই ধরনের ঘটনাবলিকে ব্যাখ্যা করার লক্ষ্যে সাধারণ সূত্র গড়ে তোলেন। কিন্তু রাজনৈতিক দর্শনের প্রধান উদ্দেশ্য হলো, রাজনৈতিক ঘটনা বা প্রতিষ্ঠানের যৌক্তিকতা অনুসন্ধান এবং একটি আদর্শ ও কাঙ্ক্ষিত রাজনৈতিক ব্যবস্থা সম্পর্কে আলোচনা করা।


২. বিষয়বস্তুর ক্ষেত্রে উভয়ের পার্থক্য : বিষয়বস্তুর আলোচনার দিক থেকে রাষ্ট্রতত্ত্বের সাথে রাজনৈতিক দর্শনের পার্থক্য রয়েছে। রাজনৈতিক তত্ত্ব রাষ্ট্র তথা রাজনৈতিক ব্যবস্থার উৎপত্তি, বিকাশ, প্রকৃতি, কার্যকলাপ, ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর আচরণ, রাজনৈতিক প্রক্রিয়া, আন্তঃরাষ্ট্র সম্পর্ক ইত্যাদি বিষয় নিয়ে আলোচনা করে এবং ইতিহাস ও সমসাময়িক বস্তুজগৎকে কেন্দ্র করে। পক্ষান্তরে, রাজনৈতিক দর্শনের মূল উদ্দেশ্য হলো আদর্শ সমাজ ও রাষ্ট্র গড়ে তোলা। মূল্যবোধ ঘটনাবলির বিশ্লেষণ সাপেক্ষে ভবিষ্যদ্বাণীও করে থাকে। এর অর্থ হচ্ছে রাজনৈতিক তত্ত্ব গড়ে উঠে বাস্তব ঘটনা ও প্রাধান্য সম্বলিত দৃষ্টিকোণ থেকে রাষ্ট্র ও তার কার্যকলাপ নির্মাণের চেষ্টা করে রাজনৈতিক দর্শন। উদাহরণ হচ্ছে প্লেটোর (Plato) আদর্শ রাষ্ট্র দার্শনিক রাজা এবং ন্যায়বিচার তত্ত্ব।


রাজনৈতিক তত্ত্বের গুরুত্ব : নিম্নে রাজনৈতিক তত্ত্বের গুরুত্ব আলোকপাত করা হলো :


১. তত্ত্ব, তথ্য ও ঘটনা একসূত্রে আবদ্ধ : যে কোন রাজনৈতিক ঘটনা বা তথ্য বিশুদ্ধ ঘটনা বা তথ্য নয়। ঘটনা বা তথ্যকে কেবল ঘটনা বা তথ্য হিসেবে গণ্য করা উচিত নয়। সমাজে বাস্তবে যা ঘটে তার সাথে মানুষই জড়িত থাকে। সে কোন ঘটনার বিষয়ে সংগৃহীত তথ্য গবেষকের স্বার্থ দ্বারা যেমন নির্দিষ্ট হয় তেমনি তা গবেষক কর্তৃক পূর্ব নির্ধারিতও হয় তথ্য সংগ্রহের একটি কাঠামোর দরকার হয় যার ফলে তথ্যের বিশ্বাস ও প্রাসঙ্গিকতা নির্ধারণ করা যায়। কাঠামোর সচেতন উন্নয়নই হচ্ছে তত্ত্ব। তাত্ত্বিক অনুমান (Generalization) ছাড়া তথ্যের প্রচেষ্ঠা বা ব্যবহার প্রায় অর্থহীন। ডেভিড ইস্টান তথ্যকে “তাত্ত্বিক স্বার্থের পরিপ্রেক্ষিতে বাস্তব অবস্থার বিন্যাস" বলে চিহ্নিত করেছেন। (Fact is a particular ordering of reality in terms of theoritical interest -Easton)


২. তত্ত্ব ও তথ্য পরস্পর নির্ভরশীল : বাস্তব অবস্থায় তত্ত্ব ও তথ্য পরস্পর পরস্পরের উপর নির্ভরশীল। তাত্ত্বিক ভিত্তি ছাড়া তথ্য কেবল কতকগুলো অপ্রয়োজনীয় ও বিচ্ছিন্ন ঘটনা। অন্যদিকে তথ্য ছাড়া তত্ত্ব নিছক কল্পনা বিলাস মাত্র। তাই গ্রহণযোগ্য কৌশলে গৃহীত তথ্য জ্ঞানার্জনে সহায়ক। জ্ঞান তখনই নির্ভরশীল ও বিশ্বাসযোগ্য হয় যখন তা সর্বজনীন বা সাধারণ তত্ত্বের (general theory) মাধ্যমে গৃহীত হয় এবং তা বহুবিধ ঘটনার ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা সম্ভব হয়।


. ফলিত বিজ্ঞানের ন্যায় রাষ্ট্রবিজ্ঞানেও তত্ত্ব গড়ে তোলা সম্ভব : জীববিজ্ঞান, পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন শাস্ত্র, ফলিত বা প্রাকৃতিক বিজ্ঞানে তত্ত্বের ব্যবহার লক্ষণীয়। অর্থনীতিতে তাত্ত্বিক ব্যবহার সামাজিক বিজ্ঞানের যে কোন শাখার চেয়ে বেশি, তবে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে তা একেবারেই কম। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের ভিত্তি গড়ে তোলা সম্ভব। বলেই বিজ্ঞানীদের ধারণা। প্রথমে সংকীর্ণ অনুমান ভিত্তিক এবং ক্রমশ ব্যাপক অনুমান ভিত্তিক তত্ত্ব গড়ে তোলা সম্ভব। অর্থাৎ রাষ্ট্রবিজ্ঞান তথ্য যে কোন জ্ঞানকে সমৃদ্ধ করার ক্ষেত্রে তাত্ত্বিক ভিত্তি গুরুত্বপূর্ণ।


৪. রাজনৈতিক চলক বা উপাদান (variables) সনাক্তকরণ : রাজনৈতিক তত্ত্বের সাহায্যে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক উপাদানসমূহ সনাক্ত করা সম্ভব হয় এবং সেগুলোর পারস্পরিক সম্পর্ককে আলোচনা করা সম্ভব। কিন্তু বিশ্লেষণাত্মক প্রকল্প বা পরিকল্পনা (analytical scheme) ছাড়া ঐ ধরনের কাজ করা সম্ভব নয়। গবেষকের সামনে যদি একটি তাত্ত্বিক কাঠামো (theoritical framework) থাকে তাহলে গবেষক গবেষণাকে অতি সহজে অর্থপূর্ণ করে তুলতে পারে না। কারণ, তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে গবেষক সাধারণ সিদ্ধান্তে উপনীত হবার জন্য অতি সহজে তথ্যের বিন্যাস করতে পারেন।


৫. নতুন গবেষণায় দ্বার উন্মোচন : রাজনৈতিক তত্ত্ব কেবল গবেষণার তুলনা মূলক পর্যালোচনার পথই প্রশস্ত করে না। সে সঙ্গে কোন কোন ক্ষেত্রে নতুন গবেষণার প্রয়োজন তার দ্বারও উন্মোচন করে।


৬. গবেষণার বিশ্বাসযোগ্যতা : তত্ত্ব পুরাতন ও নতুন গবেষণার ফলাফলের বিশ্বাসযোগ্যতা বৃদ্ধি করে। যে কোন বৈজ্ঞানিক গবেষণার লক্ষ্য হচ্ছে সুনির্দিষ্ট ভবিষ্যদ্বাণী (prediction) করা। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে সর্বসময় এ রকম ভবিষ্যদ্বাণী করা সম্ভব নয়। রাজনৈতিক তাত্ত্বিক কাঠামোর সাহায্যে তথ্যাদি সংগ্রহ করা ও বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে গবেষণা চালানো সম্ভব হলে এবং তাদ্বারা বিশ্বাসযোগ্যতা সৃষ্টি হলে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও ভবিষ্যদ্বাণী করা সম্ভব।


উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, জ্ঞানের ক্ষেত্রে ঘটনাবলি, তথ্য ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ। তবে তা অপূর্ণ থেকে যায় যদি কোন তাত্ত্বিক ভিত্তি না থাকে। আচরণবাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে, বিশ্বাসযোগ্য রাজনৈতিক জ্ঞান (Reliabe political knowledge) যোগান দেয়াই রাজনৈতিক তত্ত্বের অন্যতম প্রধান কাজ। ডেভিড ইস্টন মন্ত করেন যে, একটি সাধারণ তত্ত্ব (General theory) ছাড়া রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিজ্ঞানসম্মত আলোচনা অসম্ভব।


#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Now
Ok, Go it!