রাজনৈতিক ক্ষমতা পরিমাপ : বিজ্ঞানের আলোচনায় পরিমাপ (Measurement) একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞান অন্যতম প্রধান সামাজিক বিজ্ঞান যার প্রধান উপজীব্য বিষয় হলো ক্ষমতা, প্রভাব, কর্তৃত্ব এবং এগুলো থেকে উদ্ভূত বিরোধ ও তার মীমাংসা। রাজনৈতিক ক্ষমতার পরিমাপ কতটুকু করা যায় বা কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর ক্ষমতা কতটুকু কার্যকর হয়েছে তা জানার জন্য বা আলোচনার জন্য দুটি পদ্ধতি অবলম্বন করা যায়।
প্রথম পদ্ধতি,
প্রভাবশালীদের আচরণ পর্যালোচনা : কোন রাজনৈতিক ব্যবস্থায় যে সকল ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা সংঘ শক্তিশালী বলে গণ্য হয় তাদের আচরণ বিশ্লেষণ করে কোন নির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে তাদের ভূমিকা পর্যালোচনা বা পরিমাপ করা যায়। এ পদ্ধতি অনুযায়ী ক্ষমতার পরিমাপ করার মূল উদ্দেশ্য হলো নির্দিষ্ট ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর ক্ষমতার মূল্যায়ন করা, তাদের আচরণ কীভাবে বিভিন্ন সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করে তার তথ্য সংগ্রহ করা। এ ধরনের আলোচনা সাধারণত ব্যক্তিকেন্দ্রিক আলোচনা হিসেবে বিবেচিত হয়। এর দ্বারা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এমন একটা অবস্থায় উপনীত হওয়া যায় যেখানে দেখা যাবে যে, কতিপয় বা মুষ্ঠিমেয় ব্যক্তি বা গোষ্ঠীই অনেক সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করেছে এবং সিন্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া ঐ মুষ্ঠিমেয় ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর হাতে সীমাবদ্ধ ।
আরো দেখুন : রাজনৈতিক তত্ত্ব ও রাজনৈতিক দর্শনের সম্পর্ক বিশ্লেষণ কর।
দ্বিতীয় পদ্ধতি,
গৃহীত সিদ্ধান্তের প্রকৃতি পর্যালোচনা : প্রাথমিকভাবে কোন গৃহীত সিদ্ধান্তের প্রকৃতি পর্যালোচনা করে কোন কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী সিদ্ধান্ত গ্রহণে প্রভাব বিস্তার করেছে তা পর্যালোচনা করা সম্ভব। এ পদ্ধতি কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর ক্ষমতা বা আচরণের বিশ্লেষণ না করে কোন একটি বা অনেকগুলো সিদ্ধান্ত বাছাই করে উল্লিখিত সিদ্ধান্ত বা সিদ্ধান্তগুলো গ্রহণে তাদের কার কী ভূমিকা ছিল তা পর্যালোচনা করে। এ পদ্ধতি প্রথম পদ্ধতির চেয়ে বেশি ব্যাপক। এ পদ্ধতিতে এমন সিদ্ধান্তে আশা যায় যে, ক্ষমতা অনেক ব্যক্তি বা গোষ্ঠী বা সংঘের মধ্যে বিকেন্দ্রীকরণকৃত। অতএব, ক্ষমতার পরিমাপের ক্ষেত্রে কোন পদ্ধতি অবলম্বন করা হবে তার উপর পদ্ধতির ফলাফল নির্ধারিত হবে। পরিমাপের ক্ষেত্রে দুটি প্রয়োগ রীতি আছে। একটি হচ্ছে গুণগত দিক এবং অন্যটি হচ্ছে সংখ্যাগত দিক। রাজনৈতিক ক্ষমতার সঠিক পরিমাপ করে ফলাফলকে সব সময় সংখ্যায় প্রকাশ করা সম্ভব হয় না। কিন্তু তা সত্ত্বেও প্রাসঙ্গিক অনেক বিষয় তুলে ধরা সম্ভব যা কোন রাজনৈতিক ব্যবস্থার ক্ষমতা পরিমাপে বা বিশ্লেষণে সহায়তা করতে পারে। উদাহরণ, 'ক' কতবার ”খ’ র আচরণ পরিবর্তনে সফল হয়েছে? খ'এর আচরণের পরিবর্তন কী করে ক'র প্রত্যাশিত স্তরেই সীমিত রয়েছে না আরো নাটকীয়ভাবে পরিবর্তন হয়েছে? আচরণের এ পরিবর্তন কী স্থায়ী? 'ক' কী একইসঙ্গে অন্য ব্যক্তির আচরণ পরিবর্তনে চেষ্টা করেছেন? 'ক' কী একইসঙ্গে একটি না অনেকগুলো সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করেছেন? এ প্রশ্নগুলোর উত্তর পাওয়া গেলে ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর ভূমিকা পরিমাপ করা সম্ভব হতে পারে।
আধুনিক ও জটিল জীবন প্রবাহের কারণে সঠিকভাবে ক্ষমতার পরিমাপ সম্ভব নাও হতে পারে। কারণ আধুনিক রাজনৈতিক জীবনে ব্যক্তি অনেক সংঘ, প্রতিষ্ঠান ও স্বার্থের সাথে এমনভাবে জড়িত যে, প্রকৃতপক্ষে কোন ব্যক্তির আচরণ পরিবর্তনে কার ভূমিকা কী পরিমাণ তা নির্ধারণ করা যায় না। কারো জীবনে তার অভিভাবক, শিক্ষক, সামাজিক সংঘ, রাজনৈতিক দল তার ব্যক্তি জীবন গড়ে উঠাতে ভূমিকা রেখেছে এবং সফল হয়েছে। কিন্তু ঐ ব্যক্তির সাফল্যের পেছনে উল্লিখিত ব্যক্তি-গোষ্ঠীর কার প্রভাব কতটুকু পড়েছে তা পরিমাপ করা সম্ভব নয়। আধুনিক রাজনৈতিক ব্যবস্থায় প্রত্যেক ব্যক্তির রাজনৈতিক আচার-আচরণ এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ এত বহুমুখী প্রভাব ও ক্ষমতার মুখাপেক্ষি থাকে যে, সঠিক এবং পৃথকভাবে কোন নির্দিষ্ট আচরণ ও সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে কোন ব্যক্তি ও সংগঠনের ক্ষমতার ব্যাপকতা, গভীরতা ও পরিমাপ করা সম্ভব নয়। ক্ষমতার পরিমাপের জন্য প্রাথামিক সূত্র হতে তথ্য উপাত্ত সংগ্রহের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। তথ্য পাওয়া অধিকার হলেও অনেকক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় তথ্য সঠিকভাবে সংগ্রহ করা যায় না। বিশেষকরে কোন মন্ত্রণালয়ের সাঠিক তথ্য যা মন্ত্রীর ক্ষমতা বেশি, না সচিবের ক্ষমতা বেশি, না অন্য প্রভাবশালী তথা স্থায়ী কমিটির ক্ষমতা বেশি তার জন্য সংসদ বিবরণী ও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের বিবরণী প্রয়োজন। কিন্তু তা যোগাড় করা প্রায় অসম্ভব। তাই এখানে অনুমানের উপর নির্ভর করতে হয় যা সঠিক নাও হতে পারে।
রাজনৈতিক তত্ত্ব ও রাজনৈতিক দর্শনের সম্পর্ক বিশ্লেষণ কর
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনা প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, পক্ষ-বিপক্ষ বা ইতিবাচক-নেতিবাচক মনোভাব প্রকাশিত হলেও সাধারণভাবে সার্বিক আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক বিশ্লেষণে কারা প্রকাশ্য এবং কারা পর্দার অন্তরালে ক্ষমতা ব্যবহার করেন বা প্রভাব বিস্তারে সক্ষম হন তা সঠিকভাবেই পরিমাপ করা যায়। তবে দলপ্রীতি বা ব্যক্তিপূজায় ব্যস্ত থাকলে এটি নিরূপণ করা সম্ভব নয়।