“ক্ষমতা বণ্টনের উপর নির্ভর করে ঐ রাষ্ট্রের রাজনৈতিক ব্যবস্থার চরিত্র।”-আলোচনা কর।

admin

 

ভূমিকা : রাজনৈতিক ব্যবস্থায় রাজনৈতিক ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের বণ্টন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কেননা এর উপর নির্ভর করে ঐ রাষ্ট্রের চরিত্র তথা রাজনৈতিক ব্যবস্থার স্থায়িত্ব ও বৈধতা। ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের বণ্টনে যদি জনসাধারণ মোটামুটি সন্তুষ্ট থাকে তাহলে রাজনৈতিক পরিস্থিতি ভালো থাকে; না হলে ব্যাপক জনঅসন্তোষ ও আন্দোলন - সংগ্রামের ফলে পুরো রাজনৈতিক ব্যবস্থায় নৈরাজ্য নেমে আসতে পারে। এতে রাজনৈতিক ব্যবস্থার স্থায়িত্ব ব্যাহত হতে পারে। ফলাফলে শাসক-শাসিত সকলেই এর নেতিবাচক প্রভাবে চলে আসে যা কাম্য নয়। পুঁজিবাদী ও মার্কসবাদী উভয় পন্থায় এ বিষয় আলোচনা করা যায়। যেমন-


“ক্ষমতা বণ্টনের উপর নির্ভর করে ঐ রাষ্ট্রের রাজনৈতিক ব্যবস্থার চরিত্র।”-আলোচনা কর।


ক. পুঁজিবাদী বিশ্লেষণ : সকলেই আশা করে সুষ্ঠু স্বাভাবিক রাজনৈতিক পরিবেশ। এর সাথে জড়িত ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের প্রশ্ন। ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের বণ্টন যদি স্বাভাবিক হয় তাহলে রাজনৈতিক ব্যবস্থার স্থায়িত্ব ও বৈধতা দীর্ঘস্থায়ী হয়। রাজনৈতিক ক্ষমতা অসমভাবে বণ্টিত হলে রাজনৈতিক ক্ষমতা হতে বঞ্চিত জনসাধারণের প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের ফলে রাজনৈতিক ব্যবস্থার স্থায়িত্ব ব্যাহত হবে। রাজনৈতিক ক্ষমতার বণ্টনের প্রকৃতির উপর রাজনৈতিক ব্যবস্থা সম্পর্কে জনসাধারণের দৃষ্টিভঙ্গি নির্ভর করে। রাজনৈতিক ক্ষমতার সুষম বণ্টন ব্যাপক সংখ্যক জনমানুষের মধ্যে রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রতি অনুকূল দৃষ্টিভঙ্গি সৃষ্টি করে এবং রাজনৈতিক অংশগ্রহণে উদ্বুদ্ধ করে। কিন্তু, রাজনৈতিক ক্ষমতা বণ্টনের ক্ষেত্রে সমস্যা আছে। কারণ, ক্ষমতা সর্বত্র সুষমভাবে বণ্টিত হয় না। অ্যালান বল (Alan Ball) এর মতে, “কোন রাজনৈতিক ব্যবস্থায়ই রাজনৈতিক ক্ষমতা সমভাবে বণ্টিত হয় না।” (Political power is not distributed evenly in any political system.)। দরিদ্রদের তুলনায় বিত্তশালীরা সবসময় অধিক ক্ষমতাবান।

আরো পড়ুন : রাজনৈতিক তত্ত্ব হিসেবে ভাববাদ বা আদর্শবাদের উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ আলোচনা কর।

প্রচীন যুগ থেকে বর্তমান যুগ সবখানে ধনী-দরিদ্র বৈষম্য বিদ্যমান ছিল। এ ধন বৈষম্য ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের চাবিকাঠি হিসেবে বিবেচিত। দরিদ্রের তুলনায় বিত্তবানদের হাতে বেশি পরিমাণ রাজনৈতিক সম্পদ সঞ্চিত থাকায় বিত্তবানদের পক্ষে রাজনৈতিক জীবনে প্রভাব বিস্তার করা সহজ হয়ে যায়। নেতৃত্ব ও ব্যক্তিগত গুণাবলি দ্বারা অপেক্ষাকৃত দরিদ্র গ্রুপ থেকে নেতা হওয়া গেলেও বর্তমান সময়ে তার পক্ষে নির্বাচনী ব্যয় নির্বাহ করা সম্ভব হয় না। ফলে নির্বাচনী মনোনয়নের পাল্লা বিত্তশালীদের পক্ষেই ভারী। বর্তমানে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে একই চিত্র বিদ্যমান। লেখাপড়ায় পিছিয়ে গিয়ে তারা ক্ষমতার বলয়ের বাইরে চলে যান, যা বিত্তশালীদের পথ সুগম করে দেয়। ফলে দরিদ্ররা অপেক্ষাকৃত মেধাবী হলেও মেধা যাচাইয়ের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়। অ্যালান বল রাজনৈতিক ক্ষমতার অসম বণ্টনের জন্য মূলত দুটি বিষয়কে দায়ী করেছেন। প্রথমটি রাজনৈতিক সম্পদের অসম বণ্টন এবং দ্বিতীয়টি ব্যক্তিগত গুণ ও পারদর্শিতার তারতম্য। বিভিন্ন ব্যক্তির রাজনৈতিক পারদর্শিতার পার্থক্যের জন্য কোন রাজনৈতিক নেতা অন্য কোন ব্যক্তির তুলনায় তার বিরোধীদের প্রতিরোধ বা জনসাধারণকে প্রভাবিত করতে পারে।


রবার্ট ডাল (Rober Dahl) রাজনৈতিক সম্পদের অসম বণ্টনের কারণ হিসেবে চারটি বিষয়ের উল্লেখ করেছেন।


১. প্রত্যেক সমাজেই কাজের বিশেষীকরণ থাকে এবং এ বিশেষীকরণ রাজনৈতিক সম্পদ আহরণের ক্ষেত্রে ব্যবধান তৈরি করে।

২. প্রত্যেক মানুষ রাজনৈতিক সম্পদের তারতম্য নিয়েই জন্মগ্রহণ করে বিধায় যারা সুযোগ-সুবিধা নিয়ে জীবনারম্ভ করেণ তারা নিজেদের প্রাধান্য বজায় রাখার চেষ্টা করেন।

৩. জৈবিক ও সামাজিক উত্তরাধিকার ও অভিজ্ঞতার তারতম্য সমাজের বিভিন্ন লোকের উৎসাহ, উদ্যোগ এবং লক্ষ্যের মধ্যে বিভিন্নতা ও পার্থক্যের সূচনা করে।

৪. সামাজিক কল্যাণের জন্য উদ্যোগ, উৎসাহ এবং লক্ষ্যের ক্ষেত্রে কিছু ব্যবধানের অস্তিত্ব প্রয়োজন, কারণ বিভিন্ন ব্যক্তিকে বিভিন্ন কাজের জন্য প্রস্তুত করা দরকার।

আরো পড়ুন : ক্ষমতা সম্পর্কে মার্কসীয় মতবাদ আলোচনা কর।

রাজনৈতিক ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব মূলত মুষ্ঠিমেয় বা এলিট শ্রেণির হাতে থেকেই যায় এবং তারা যেভাবে চাইবেন সেভাবে প্রয়োগ করতে পারেন। যারা সমাজে সংখ্যায় কম, অথচ সম্পদ ব্যবহারের ক্ষেত্রে, প্রভাবের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ভোগ করেন ও চর্চা করেন তারা হচ্ছেন একটি। আর সংখ্যাগরিষ্ঠ যারা সম্পদ ও প্রভাবে নগণ্য তারা হচ্ছেন জনগণ (Mass people)। ক্ষমতার বণ্টনে এলিটরা (Elite) বিভিন্ন নামে পরিচিত। কখনো শাসনকারী এলিট (Ruling elite), কখনো রাজনৈতিক এলিট (Political elite), কখনো ক্ষমতা প্রয়োগকারী এলিট (Power elite), কখনো বা রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রয়োগকারী বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ (Political establishment) নামে চিহ্নিত হন। অ্যালান বল (Alan Ball) মনে করেন যে, উদারনৈতিক গণতন্ত্রে এবং সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রাজনৈতিক ক্ষমতা বহু লোকের হাতে ন্যস্ত, এ ধারণা বাস্তবতার প্রকৃত চিত্র নয়। রাজনৈতিক ক্ষমতা ব্যাপকভাবে বণ্টিত হয়েছে এ ধারণা সরকারের বৈধতা ও স্থায়িত্বের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হলেও অ্যালান বল মনে করেন, ক্ষমতা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার মুষ্ঠিমেয় (এলিট) ব্যক্তির হাতেই কেন্দ্রীভূত থাকে। এলিটবাদীরা ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত ও স্থায়ী করার জন্য গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার উপর গুরুত্বারোপ করে বুঝাবার চেষ্টা করেন শাসন পরিচালিত হচ্ছে জনগণের ইচ্ছানুসারে। এতে করে রাজনৈতিক ব্যবস্থায় বহুদলীয় ব্যবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। একই সাথে এলিটচক্রও (Circulation of Elitie) গড়ে উঠেছে। রাষ্ট্রের মূল চালকের আসনে যে দলই আসুক তারা ঐ এলিট শ্রেণির প্রতিনিধি। তারপরও ব্যবস্থায় ন্যূনতম জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার সুযোগ থাকে। রাষ্ট্রের রাজনৈতিক ব্যবস্থার চরিত্র তখনই গণতন্ত্রের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠবে যখন সরকার ক্ষমতার মধ্যে জনগণের অংশগ্রহণের পথকে সহজ ও সুগম করে তুলতে পারবে।


খ. মার্কসীয় বিশ্লেষণ : ক্ষমতার বণ্টনের ক্ষেত্রে মার্কসীয় তত্ত্ব পুঁজিবাদী দৃষ্টিভঙ্গির বিপরীত। এ তত্ত্ব উদারবাদী বা এলিটতত্ত্বকে বর্জন করেছে। তাদের মতে মার্কসবাদই রাজনৈতিক ক্ষমতার বণ্টনের প্রকৃতি সম্পর্কে বিজ্ঞানসম্মত আলোচনা করেছেন। মার্কসীয় বিশ্লেষণ অনুযায়ী বিপ্লবের মৌলিক প্রশ্ন হলো রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রশ্ন। ক্ষমতার বণ্টন সম্পর্কিত মার্কসীয় তত্ত্বের ভিত্তি হলো ঐতিহাসিক বস্তুবাদ (Historical Materialism)। সমাজের অর্থনৈতিক ভিত্তি এবং উপরি কাঠামোর (Super-Structure) চারিত্রিক বৈশিষ্টের উপর ভিত্তি করে মার্কসবাদীগণ ক্ষমতার বণ্টনের মূল প্রকৃতি নির্ধারণ করেন। ঐতিহাসিক বস্তুবাদের মূলসূত্র প্রত্যেক সমাজের রাজনৈতিক এবং অন্যান্য উপরি-কাঠামোর চরিত্র সমাজের অর্থনৈতিক বুনিয়াদের দ্বারা নির্ধারিত হয়। এর অর্থ হলো এই যে, একমাত্র অর্থনৈতিক শক্তি ও উপাদান ব্যতীত অন্য কোন সামাজিক শক্তি উপাদানের কোন ভূমিকা নেই। এ তত্ত্বের মূল বক্তব্য হলো অন্যান্য সামাজিক শক্তি ও উপাদানের প্রভাব ও ভূমিকা থাকলেও অর্থনৈতিক শক্তিই চূড়ান্তভাবে নিয়ন্ত্রণকারী শক্তির ভূমিকা পালন করে।

আরো পড়ুন: রাজনৈতিক ক্ষমতা ও অর্থনৈতিক ক্ষমতার সম্পর্ক আলোচনা কর।

সমাজে যাতে অসাম্য না থাকে তার জন্য সামাজিক ব্যবস্থাপনায় ব্যক্তি সম্পত্তির উচ্ছেদ, কাজ অনুযায়ী পারিশ্রমিক প্রদান, সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় একমুখী শিক্ষা ও কর্মপরিবেশ সৃষ্টি করে ক্ষমতাকে নিম্নতম পর্যায় থেকে উচ্চতম পর্যায় পর্যন্ত জন অংশগ্রহণ (সীমিত) নিশ্চিত করা হয়। একটিমাত্র রাজনৈতিক দলের অধীনে সবকিছু নিয়ন্ত্রিত হয়। প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়ন, চীন, কিউবা প্রভৃতি রাষ্ট্রে এ ধরনের ব্যবস্থা বিদ্যমান। সমাজতন্ত্রের বাইরে একদলীয় ফ্যাসীবাদে প্রায় একই রকম অবস্থা লক্ষ করা গিয়েছিল।


উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, আমাদের বাংলাদেশের মতো রাষ্ট্রগুলোতে তত্ত্বীয় গণতন্ত্র চালু থাকলেও অংশগ্রহণমূলক ব্যবস্থার অভাবে প্রকৃত ক্ষমতা বণ্টিত হয় না। নির্বাচন হলেও জনমতের প্রতিফলন ঘটে না। বিজয়ীরা চমৎকার নির্বাচন হয়েছে বললেও বিজিতরা কখনো তা মেনে নেয় না। তদুপরি এমন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় যাতে আদৌ নির্বাচনের প্রয়োজন পড়ে না। ফলে প্রায়শই জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক আন্দোলন লক্ষ করা যায়। সুতরাং বলা যায় যে, 'ক্ষমতা বণ্টনের উপর নির্ভর করে রাষ্ট্রের রাজনৈতিক ব্যবস্থা কীরূপ হবে।


#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Now
Ok, Go it!