রাজনৈতিক ক্ষমতা ও অর্থনৈতিক ক্ষমতার সম্পর্ক আলোচনা কর।

admin

ভূমিকা : রাজনীতি ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মৌল বিষয় হচ্ছে ক্ষমতা। পৃথিবীর সকল রাষ্ট্রই শক্তিমান ক্ষমতার বলে। ক্ষমতা প্রভাবের সাথে সম্পর্কিত। সাধারণভাবে ক্ষমতা বলতে কোন নির্দিষ্ট ঘটনা ঘটানোর সামর্থ্যকেই বুঝায় । রবার্ট ডাল (Robert Dahi) এর মতে, ক্ষমতা রাজনীতির সমর্থক। (Power is synonymous with politics)। ক্ষমতা অনেক রকমের হয়ে থাকে। এগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক ক্ষমতা, অর্থনৈতিক ক্ষমতা, সামাজিক ক্ষমতা সামরিক সক্ষমতা, ধর্মীয় ক্ষমতা এবং আমলাতান্ত্রিক ক্ষমতা উল্লেখযোগ্য। সামাজিক ব্যবস্থাপনায় এসব ক্ষমতার প্রভাব থাকলেও রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতা অধিকতর উল্লেখযোগ্য।


রাজনৈতিক ক্ষমতা ও অর্থনৈতিক ক্ষমতার সম্পর্ক আলোচনা কর।


রাজনৈতিক ক্ষমতা ও অর্থনৈতিক ক্ষমতার সম্পর্ক : নিম্নে রাজনৈতিক ক্ষমতা ও অর্থনৈতিক ক্ষমতার সম্পর্কগুলো আলোকপাত করা হলো :


১. রাজনীতি ও অর্থনীতি সম্পর্কযুক্ত : রাজনীতি ও অর্থনীতি সম্পর্কযুক্ত। একটি থেকে অন্যটিকে বিচ্ছিন্ন করা উচিত নয়। কারণ এ দুটি বিষয়ই ক্ষমতা হিসেবে বিবেচিত। কোন অর্থনৈতিক চিন্তা-চেতনা, উন্নয়ন পরিকল্পনা সঠিক রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ছাড়া বাস্তবায়িত হতে পারে না। আবার উন্নত মানের রাজনৈতিক দক্ষতা থাকলেও সঠিক অর্থনৈতিক পরিকল্পনা না থাকলে কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন হবে না। তাই লক্ষ করা যায় যে, যে সব রাষ্ট্র ক্ষমতাবান তাদের রাজনীতি ও অর্থনীতি উভয়ই উত্তম। মার্কিন সমাজবিজ্ঞানী ম্যাকাইভার বলেন, “অর্থনীতিকে এবং রাজনীতিকে আমরা ক্ষমতা হিসেবে বিবেচনা করি। কিন্তু এদের একটি অপরটি হতে বিচ্ছিন্ন হতে পারে না। ”

আরো পড়ুন : রাজনৈতিক তত্ত্ব ও রাজনৈতিক দর্শনের সম্পর্ক বিশ্লেষণ কর।

২. রাজনীতি ও অর্থনীতি একই লক্ষ্য অর্জনের দুটি পদ্ধতি : রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতা একই লক্ষ্য অর্জনের দুটি ভিন্ন পদ্ধতি মাত্র। রাজনীতি ও অর্থনীতি উভয়ের লক্ষ্য মানব সমাজের মঙ্গল সাধন করা। মঙ্গল সাধনের ক্ষেত্রে একটি অপরটির উপর বিস্তৃত। চিরায়ত নিয়মানুসারে মানুষের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের জন্য ক্ষমতার প্রয়োজন হয়। বলাই বাহুল্য, রাজনৈতিক অর্থনৈতিক ক্ষমতা একসাথে না হলে তা বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো কার্যসিদ্ধির জন্য রাজনৈতিক ক্ষমতার দ্বারস্থ হয় আবার রাজনৈতিক ইচ্ছা ও ক্ষমতার বাস্তবায়নের জন্য অর্থনৈতিক সক্ষমতা প্রয়োজন। এ দৃষ্টিতে রাজনীতি ও অর্থনীতি ক্ষমতার দিক থেকে বিচার্য।


৩. একে অপরের পরিপূরক : উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে রাজনীতি ও অর্থনীতি পরিপূরক; কেউ কারো অধীন বা আজ্ঞাবহ নয় । কেউ কারো নীতি নির্ধারণ করে দেয় না। রাষ্ট্র বা রাজনীতি অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে নিজের গতি নির্ধারণ করে দিতে পারে না, তেমনি অর্থনৈতিক ব্যবস্থাও রাষ্ট্রের বা রাজনীতির প্রভাবকে উপেক্ষা করতে পারে না। কর ধার্যের বিষয়টি রাষ্ট্রের হলেও মূলত তা নির্ধারিত হয় অর্থনৈতিক সামর্থ্যের উপর। তবে এর দ্বারা রাষ্ট্র উপকৃত হয়। সম্পদের বণ্টন ব্যবস্থায়ও পরিবর্তন লক্ষ করা যায়।

আরো পড়ুন : ক্ষমতার সম্পর্ক নির্ধারণের সমস্যাগুলো আলোচনা কর।

৪. প্রয়োজনীয়তার দিক থেকে : প্রয়োজনীয়তার দিক থেকে রাজনীতি ও অর্থনীতি পৃথক ও বিচ্ছিন্ন হতে পারে না। রাষ্ট্রের পক্ষে কখনো অর্থনৈতিক ক্ষেত্র ত্যাগ করা সম্ভব নয়। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য অনুযায়ী ব্যক্তির হাতে সব কিছু ছেড়ে দেয়ার কথা থাকলেও তারা উপযোগিতার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় বা রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ অনুমোদন করেন। জন-উপযোগিতার বিষয়গুলো হচ্ছে--মুদ্রা ব্যবস্থা। বিদ্যুৎ সরবরাহ, বিশুদ্ধ পানির যোগান ও সার্বিক যোগাযোগ ব্যবস্থা। এ ক্ষেত্রগুলোতে রাষ্ট্রের ভূমিকা ব্যাপক হওয়া উচিত। না হলে সাধারণ মানুষ দুর্ভোগে পড়বে যা রাজনৈতিক ক্ষমতা অনুমোদন করে না।


পার্থক্য : যতদিন পর্যন্ত অর্থনৈতিক ক্ষমতাই রাজনৈতিক ক্ষমতার উৎস হিসেবে কাজ করেছে ততদিন উভয়ের সম্পর্কের বিষয়টি তত গুরুত্ববহ ছিল না। কিন্তু রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রনৈতিক জীবনে জটিলতা বৃদ্ধির সাথে সাথে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতার মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি হয়। বর্তমানে অর্থনৈতিক ক্ষমতা স্বীয় ক্ষমতা প্রতিষ্ঠায় তৎপর। আবার অন্যদিকে রাজনৈতিক ক্ষমতা তার একক সার্বভৌমত্বও প্রতিষ্ঠা করতে পারছে না। পার্থক্যের বিষয়গুলো এরূপ :


১. রাজনৈতিক ক্ষমতা অর্থনৈতিক ক্ষমতার চেয়ে শ্রেষ্ঠ : প্রায়োগিক বা আনুষ্ঠানিকতার দিক থেকে অর্থনৈতিক ক্ষমতার চেয়ে রাজনৈতিক ক্ষমতা শ্রেষ্ঠ। রাজনৈতিক ক্ষমতা অর্থনৈতিক ক্ষমতার সীমা নির্ধারণ করে দেয়। যে কোন ধরনের অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান বা ব্যবস্থাকে রাষ্ট্রায়ত্ত করতে পারে। রাষ্ট্রীয় আইনের কারণে রাজনৈতিক ক্ষমতা অর্থনীতির উপর এ ধরনের নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে পারে। অর্থনৈতিক ক্ষমতা সংঘবদ্ধভাবে রাজনৈতিক ক্ষমতার উপর প্রভাব বিস্তার করতে সচেষ্ট থাকলেও শেষ পর্যন্ত তা হয়ে উঠে না। কারণ, ঐ অর্থনৈতিক গোষ্ঠী তখন রাজনীতিবিদ হয়ে যায়। ফলে আবারো রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রাধান্য বিস্তার করে।


অন্যদিকে, অর্থনৈতিক ক্ষমতা আয়ের উপর প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে পারে। চাহিদা ও যোগানের সামঞ্জস্য ও অসামঞ্জস্য বিধান করে পুরো ব্যবস্থার উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে পারে। অবশ্য এ ক্ষেত্রে এক সময় রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতার মধ্যে আপস রফা হয়ে যায়।


২. অর্থনৈতিক ক্ষমতা অপেক্ষাকৃত দ্রুতগতিসম্পন্ন : অর্থনৈতিক ক্ষমতা ক্ষিপ্রগতিসম্পন্ন ও প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল। অর্থনৈতিক ক্ষমতা ও স্বার্থ আঞ্চলিক ও বিশ্বব্যাপী উভয়ই হয় এবং অবাধগতিতে চলে; নিকটতম কেন্দ্রে কার্যকর হয় এবং ইচ্ছামত সম্প্রসারিত হয়। অর্থনৈতিক ক্ষমতা বহুরূপী ও বহুকেন্দ্রিক। এ কারণে অর্থনৈতিক ক্ষমতা কর্পোরেট ব্যবস্থা তৈরি করতে পারে ও রাজনীতিতে হস্তক্ষেপের শক্তি সঞ্চয় করে। যেমন বহুজাতিক কোম্পানি ও এনজিও কর্মকাণ্ড।


অন্যদিকে, রাজনৈতিক ক্ষমতা ধীর গতি সম্পন্ন এবং কিছুটা নমনীয়; অনেকক্ষেত্রে অনমনীয়। এ ক্ষমতার প্রভাব সমগ্র সমাজের উপর কার্যকর হয়। রাজনৈতিক ক্ষমতা ঐক্য ও স্বাতন্ত্র্যের এক সুনির্দিষ্ট একটি পদ্ধতি চাপিয়ে দেয়, খা অনেকটা আবেগ বিবর্জিত ও কেন্দ্রীভূত।

আরো পড়ুন : ক্ষমতার সম্পর্ক নির্ধারণের সমস্যাগুলো আলোচনা কর।

৩. উদ্দেশ্যগত পার্থক্য : অর্থনৈতিক ক্ষমতা মুনাফালোভী। কিন্তু রাজনৈতিক ক্ষমতাকে জনগণের স্বার্থের বিষয় চিন্তা করতে হয়। অনেক সময় রাষ্ট্রকে রক্ষকের ভূমিকা পালন করতে হয়। না হলে অসম প্রতিযোগিতা, একচেটিয়া উৎপাদন, বণ্টন প্রভৃতির মাধ্যমে অর্থনৈতিক অবস্থা দুর্দশাগ্রস্ত হয়ে উঠতে পারে। তখন রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে জনস্বার্থ রক্ষা করে। এ কারণে অর্থনীতিকে Price oriented এবং রাজনীতিকে Value oriented বলা হয়।


উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, সাধারণত রাজনীতি ও অর্থনীতি পরস্পর সম্পর্কযুক্ত হলেও বাস্তবায়ন রীতি বা প্রয়োগ রীতিতে পার্থক্যও লক্ষ করা যায়। রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত অর্থনৈতিক সক্ষমতা মিলে একটি আদর্শ ব্যবস্থা তৈরি হতে পারে। তবে সৎ রাজনীতি না থাকলে অর্থনৈতিক সম্পদ থাকলেও রাষ্ট্র দরিদ্র থেকে যেতে পারে।


#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Now
Ok, Go it!