“ক্ষমতাই রাজনৈতিক মূল ধারণা'-আলোচনা কর।

admin

 

ভূমিকা : জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিশ্লেষণে ক্ষমতার তত্ত্ব একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। অনেক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ক্ষমতাকে রাজনীতির (রাষ্ট্রবিজ্ঞানের) একটি কেন্দ্রীয় ধারাস্বরূপে উল্লেখ করেছেন। অ্যালান বলের মতে, “অনেকে মনে করেন যে, রাজনীতিকে বিরোধের অবসান হিসেবে ব্যাখ্যা করলে ক্ষমতার বণ্টনের মধ্যেই স্থিরীকৃত হবে কিভাবে বিরোধের অবসান ঘটবে অথবা বিরোধের অবসানের ব্যবস্থাকে সকল রাজনৈতিক দল গ্রহণ করবে


“ক্ষমতাই রাজনৈতিক মূল ধারণা'-আলোচনা কর।


ক্ষমতা : ক্ষমতার সংজ্ঞা বিস্তৃত। এক কথায় ক্ষমতা বলতে প্রভাব প্রয়োগের দক্ষতাকে বুঝায়। ব্যাপকভাবে ক্ষমতার সাথে প্রলোভন ভীতি ইত্যাদি বিষয় জড়িত। প্রভাব, কর্তৃত্ব ও ক্ষমতাকে অনেক সময় একই সূত্রে উল্লেখ করা হয়। ম্যাক্স ওয়েবার কর্তৃত্বের বৈধ ক্ষমতা বলেছেন। প্রভাব ছাড়া কর্তৃত্ব, কর্তৃত্ব ছাড়া ক্ষমতা কল্পনা করা যায় না। সুতরাং এ বিষয়গুলো রাজনীতির সাথে জড়িত।


রাজনীতি : প্রাচীন অর্থে রাজার নীতিকে রাজনীতি বলা হতো। আধুনিক সময়ে রাজনীতি রাষ্ট্র ব্যবস্থার সাথে জড়িত। রাষ্ট্র বা রাজনৈতিক ব্যবস্থার ইনপুট হচ্ছে জনগণ। জনগণের সাথে রাষ্ট্রের সম্পর্ক, অধিকারের মাত্রা, অংশগ্রহণ, মতামতের গুরুত্ব, শাসনকারী এলিটের পরিবর্তন জড়িত। হ্যারল্ড ডি.লাসওয়েল বলেছেন, "Politics : who gets what, when and How." আবার সমাজতন্ত্রীদের মতে, A continuous conflict between haves and have not. কখনো বলা হয় Politics is the study of influence. আবার বলা হয় রাজনীতি অধ্যয়ন হলো ক্ষমতা ও শক্তির পর্যালোচনা ইত্যাদি। সুতরাং রাজনীতির সাথে ক্ষমতার সম্পর্ক রয়েছে।


ক্ষমতা ও রাজনীতির সম্পর্ক বা ক্ষমতাই রাজনীতির মূল ধারণা : নিম্নে এ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :


ক্ষমতা সম্পর্কে রবার্ট ডাল এর অভিমত : রবার্ট এ ডাল (Robert A. Dahl) তাঁর Modern Political Analysis. বইতে রাজনৈতিক ক্ষমতাকে বিস্তৃতভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁর মতে, রাষ্ট্র হলো ক্ষমতার একটি চমকপ্রদ উৎস। কারণ, রাষ্ট্রের উপর নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত করে কোন ব্যক্তি রাষ্ট্রের সাহায্যে ক্ষমতা প্রয়োগ করতে সচেষ্ট হতে পারে। অর্থাৎ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি রাষ্ট্রের বলপ্রয়োগের একচেটিয়া ক্ষমতাকে প্রয়োগ করে নিজের নীতি ও সিদ্ধান্তের সাথে অন্যের সামঞ্জস্যবিধানের চেষ্টা করতে পারে। শাস্তি প্রদানের ভীতির মাধ্যমে অন্যকে নিজের মত গ্রহণে বাধ্য করা যায়। কেবল তাই নয়, পুরস্কারের প্রলোভনের মাধ্যমেও অন্যের কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ করা যায়। রাষ্ট্রের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে এমন সম্পদ ও শক্তি অর্জন করা যায় যা অন্য কাউকে চরম দত্ত ও শাস্তিপ্রদান এবং সুবিধা সম্প্রসারণেও ব্যবহার ও প্রয়োগ করা যায়। ডালের মতে, বলপ্রয়োগ ইতিবাচক ও নেতিবাচক দু'প্রকারের হতে পারে। নেতিবাচক বলপ্রয়োগ চরম শাস্তির ভীতি প্রদর্শনের শক্তির উপর নির্ভরশীল। এখানে বলপ্রয়োগের মাধ্যমে কোন ব্যক্তিকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কাজ করতে বাধ্য করা হয়। অন্যদিকে, ইতিবাচক বলপ্রয়োগের সাথে বিপুল পরিমাণ লাভের সম্ভাবনা থাকে। এখানে এমন ভাবে ভীতি প্রদর্শন করা হয় ব্যক্তি মনে করে ক্ষমতা প্রয়োগকারীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে গেলে ব্যক্তির বিদ্যমান লাভালাভ নাও থাকতে পারে। বরং ইচ্ছানুযায়ী চললে আগের সম্পদ বহাল থাকার পাশাপাশি নতুন সম্পদ লাভ করা যাবে। ইতিবাচক ও নেতিবাচক বলপ্রয়োগ 'ক্ষমতার' ধারণার সাথে জড়িত।


ক্ষমতা সম্পর্কে অ্যালান বল এর অভিমত : শাস্তির ভীতি বা আইন মেনে চলার জন্য পুরস্কার এ নীতির মাধ্যমে ব্যক্তির আচরণ নিয়ন্ত্রেণের ক্ষমতা ও দক্ষতাই হলো রাজনৈতিক ক্ষমতা। শাস্তির ভীতি এবং পুরস্কারের পরিমাণ ও সম্ভাবনা যত বেশি হবে ক্ষমতার ব্যাপকতাও তত বেশি হবে। তাই অ্যালান বল'র মতে, “আদেশ অমান্য করার জন্য ভীতি প্রদর্শনের বা মান্য করার জন্য পুরস্কারের প্রলোভনের মাধ্যমে অন্যের আচরণকে প্রভাবিত করার সামর্থ্যই হলো রাজনৈতিক ক্ষমতা।” অ্যালান বলও ইতিবাচক ও নেতিবাচক বলপ্রয়োগের দৃষ্টিকোণ থেকে ক্ষমতাকে বিশ্লেষণ করেছেন। কোন রাজনৈতিক নেতা সম্পদ ও সম্মানের প্রলোভন দেখিয়ে নাগরিকদের নিজ মতের পক্ষে আনবার চেষ্টা করতে পারেন। আবার তিনি তার বিরোধীদের ঐ সম্পদ ও সম্মান থেকে বঞ্চিত করার ভীতি প্রদর্শনেও করতে পারেন। এখানে প্রথম ধাপ ইতিবাচক এবং শেষ ধাপ নেতিবাচক বেশির ভাগ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রয়োগের ক্ষেত্রে ইতিবাচক ও নেতিবাচক উভয় প্রকার বলপ্রয়োগে জড়িত থাকে। অনেক ক্ষেত্রে ক্ষমতা প্রয়োগকারী বা পরিচালনাকারীর বিরুদ্ধাচরণ করলে ভয়াবহ শাস্তিসহ মৃত্যুদণ্ডও দেয়া হয়ে থাকে। এ রকম চরমদও (মৃত্যুদণ্ড) দেবার ক্ষমতা রাষ্ট্রের নিকট সংরক্ষিত থাকে। যে সকল ব্যক্তি রাষ্ট্রকে নিয়ন্ত্রণ করেন, তারাই সর্বাপেক্ষা ব্যাপক রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রয়োগ করেন। অ্যালান বল অভিমত ব্যাক্ত করেন যে, “বলপ্রয়োগের তুলনায় বলপ্রয়োগের মাধ্যমে শাস্তি প্রদানের ভীতিই আনুগত্য সৃষ্টি করে। ক্রমাগত শাস্তি প্রদানের পদ্ধতি প্রয়োগ করা হলে রাজনৈতিক ক্ষমতার দুর্বলতা প্রকাশ পায়।” অর্থাৎ, বারংবার শাস্তি প্রদান করার অর্থ নাগরিকগণ তা তাদের একটা অংশ রাজনৈতিক ক্ষমতার বৈধতা স্বীকার করতে প্রস্তুত নয়। রাজনৈতিক ক্ষমতার ভিত্তি দুর্বল হলেই বারংবার শাস্তি প্রদানের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয় ।


গ্রিক দার্শনিক এরিস্টটল রাজনৈতিক ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে ক্ষমতাগত সম্পর্ককে বিশ্লেষণ করেছেন। তিনি মনে করতেন, কোন রাজনৈতিক জনসমাজের নাগরিকদের মধ্যে ক্ষমতার অবস্থানগত পার্থক্যই বাস্তব বা উত্তম সরকারগুলোর মধ্যে পার্থক্য নির্দেশের মানদণ্ড হিসেবে কাজ করেছে। সরকার বা সংবিধানের উৎকর্ষতা ও নিম্নগামিতা এ মানদণ্ডে নির্দেশিত হতো। তিনি শাসকের উদ্দেশ্য ও সংখ্যার মিশ্রণে জনগণের উদ্দেশ্যে পরিচালিত ব্যবস্থাগুলোকে ভালো বলেছেন। মেধা ও সম্পদের সংমিশ্রণকে অতি উত্তম বলেছেন। এর মাধ্যমে ক্ষমতার সম্পর্ক নির্ধারিত হয়েছে।


জার্মান সমাজতত্ত্ববিদ ম্যাকস ওয়েবার সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গিতে রাজনৈতিক ক্ষমতাকে দেখেছেন। তিনি রাজনৈতিক ক্ষমতাকে প্রয়োগের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক কর্তৃত্বের আবশ্যকতা রয়েছে বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি মনে করেন যে, নাগরিকের মূল্যবোধের সঙ্গে সঙ্গতি না রেখে ক্ষমতা প্রয়োগ বৈধ নয়। ক্ষমতা ছাড়া কর্তৃত্ব অস্তিত্বহীন এবং বৈধতা ছাড়া কর্তৃত্বে ক্ষণস্থায়ী। তিনি বলেন, “রাষ্ট্র এক বিশেষ সময়ে এবং বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ ক্ষমতা প্রয়োগ করে, শুধু এ কারণেই রাষ্ট্র অন্যান্য সংগঠন থেকে পৃথক। ম্যাকস ওয়েবারের পথ ধরে দিকনার ও প্রেসথাস, পিটার এম ব্লাউ, অ্যালমন্ড ও পাওয়েল প্রমুখ রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রয়োগের আধুনিক সংস্করণ উদ্ভাবন করেছেন। আমলাতান্ত্রিক সংগঠনে সরকারি সিন্ধান্তে গ্রহণ ও বাস্তবায়নের পথ সুগম হয়। মূলত এরই প্রশাসনের স্থায়ী ক্ষমতাবান সংগঠন। অনেক ক্ষেত্রে এদের সাফল্য-ব্যর্থতার ভিত্তিতে রাজনৈতিক ব্যবস্থায় শাসন কর্তৃপক্ষের উত্থান-পতন ঘটে থাকে।


সমাজতান্ত্রিক ধারায় রাজনৈতিক ক্ষমতা হলো সামাজিক ক্ষমতার সেই ধারা, যার একটি শ্রেণি চরিত্র আছে, যা বলপ্রয়োগের বিশেষ হাতিয়ারের প্রতি বিশ্বস্ত থাকে এবং যার হাতে সমগ্র জনগণের উপর বাধ্যতামূলকভাবে প্রযোজ্য আইন ও অন্যান্য ডিক্রি জারি করার একচেটিয়া ক্ষমতা ন্যস্ত থাকে। অর্থাৎ রাজনৈতিক ক্ষমতা বলতে মার্কসীয় তত্ত্বে এমন সংগঠিত ক্ষমতাকে বুঝায়, যার সাহায্যে এক শ্রেণি অন্য শ্রেণিকে শোষণ করে এবং তার উপর প্রভুত্ব বিস্তার করে।


উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনা প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, প্রভাব, ক্ষমতা, কর্তৃত্ব ও রাজনীতি একইসূত্রে গাঁথা। এগুলোকে আলাদা করার কোন সুযোগ নেই। রাজনৈতিক ব্যবস্থায় যাই হোক না কেন শাসন পরিচালনাকারী সবসময়ই মুষ্ঠিমেয় কিছু লোক, যারা ক্ষমতাবান ।


#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Now
Ok, Go it!