রাজনৈতিক ক্ষমতা এবং কর্তৃত্বের সম্পর্ক ও পার্থক্য নির্ণয় কর।

admin

 

ভূমিকা : সাধারণত ক্ষমতা, বৈধতা ও কর্তৃত্বকে অনেক সময় এক মনে করা হয়। কিন্তু রাজনৈতিক ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব সবসময় সমার্থক নয়। তবে রাজনৈতিক ক্ষমতা কর্তৃত্বের সম্পর্ক জটিল ধরনের।


রাজনৈতিক ক্ষমতা এবং কর্তৃত্বের সম্পর্ক ও পার্থক্য নির্ণয় কর।


রাজনৈতিক ক্ষমতা এবং কর্তৃত্বের সম্পর্ক : রাজনৈতিক ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের সম্পর্ক বা পার্থক্য নিম্নরূপ :


১. বৈধ কর্তৃত্বই ক্ষমতা : রাজনৈতিক কর্তৃত্বকে অনেকে বৈধ, যথার্থ বা সঠিক এবং স্বাভাবিক ক্ষমতা বলে গণ্য করেন। মনে করা হয় কর্তৃত্বের অধিকারীরা আইন প্রণয়ন ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের এবং বাস্তবায়নে সক্ষম হলে ক্ষমতাবান বা শক্তিশালী হন। তাই অনেকে মনে করেন যে, কর্তৃত্বের প্রশ্ন মূলত ক্ষমতা বিষয়ক প্রশ্নঃ কর্তৃত্বসম্পন্ন ক্ষমতা বলতে বৈধ ক্ষমতাকে বুঝায়। কিন্তু নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে সক্ষম হলেও শক্তিশালী বলা নাও যেতে পারে। কর্তৃত্বের ধারণা ও ক্ষমতার প্রয়োগ সমার্থক নয়। রাজনৈতিক ক্ষমতা বিদ্যমান কর্তৃপক্ষের পক্ষে অথবা বিপক্ষে প্রয়োগ করা সম্ভব।

আরো পড়ুন : গণতন্ত্রের সফলতার পূর্বশর্তগুলো আলোচনা কর।

২. কর্তৃত্ব ক্ষমতার প্রয়োগ তথা বলপ্রয়োগে সাহায্য করে: সাধারণত মনে করা হয় ক্ষমতার প্রয়োগ ও বলপ্রয়োগ কর্তৃত্বের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। যে ক্ষমতা সংশ্লিষ্ট সকলের সাধারণ অনুমোদনক্রমে প্রয়োগ করার চেষ্টা করা হয় তাই স্বাভাবিকভাবে কর্তৃত্ব নামে অভিহিত। অর্থাৎ কর্তৃত্বকে সঠিকভাবে প্রযোজ্য শক্তিপ্রয়োগের ক্ষেত্রে সনাক্ত করা যায় ও সঠিকভাবে বলপ্রয়োগ বা শক্তিপ্রয়োগের ব্যবস্থাই সর্বদা কর্তৃত্বসম্পন্ন।


কিন্তু, ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের পার্থক্য নির্ণয়ে টি. ডি ওয়েলডন (T. D. Weldon) মনে করেন যে, কর্তৃত্ব ক্ষমতার প্রয়োগ বা বলপ্রয়োগের ক্ষেত্রে সাহায্য করে এ ধারণা ভুল। কর্তৃত্ব হতে পারে এবং বেশির ভাগ লোক যদি শয়তানী কর্মকাণ্ড পছন্দ করে তাহলে ঐ কর্তৃত্ব দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে। হিটলারের শাসনকাল এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ ।


৩. ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব এক নয় : ক্ষমতা ও কর্তৃত্বকে এক মনে করা হলে অনেকগুলো সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রশ্নকে অবহেলা করা হয়। কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী রাজনৈতিক কর্তৃত্ব থেকে বঞ্চিত হয়েও রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারেন। কোন একটি দেশের জনগণ শাস্তির ভয়ে ক্ষমতা মান্য করলেও কর্তৃত্বকে ঘৃণা করতে পারে। সাধারণত জনগণের অনুমোদনবিহীন বলপ্রয়োগের ক্ষমতার ক্ষেত্রে এ পরিস্থিতি লক্ষণীয়।

আরো পড়ুন : “ব্রিটিশ সংবিধান তৈরি হয়নি, এটা গড়ে উঠেছে”- ব্যাখ্যা কর ।

আবার কোন কোন ক্ষেত্রে কর্তৃত্ব থাকলেও ক্ষমতার প্রয়োগ সম্ভব হয় না। যেমন- কোন সংগঠনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা যদি কর্মচারী দ্বারা তার অফিসেই ঘেরাও হন তখন ঐ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ক্ষমতার মালিক হয়েও নিজেকে নিজের আদেশ দ্বারা বা কর্তৃত্ব দ্বারা মুক্ত হতে পারেন না। তাহলে ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের সাথে এ ধারণা জড়িত যে, কর্তৃত্বের সাথে স্বীকৃত ক্ষমতা জড়িত।


৪. ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের পন্থা স্বতন্ত্র : ক্ষমতা এবং কর্তৃত্বের সংজ্ঞা, প্রকৃতি ও প্রয়োগের পন্থা স্বতন্ত্র। ক্ষমতা এমন একটি বিশেষ সম্পর্ক যার মাধ্যমে কোন ব্যক্তি অন্য কোন ব্যক্তিকে নিজের ইচ্ছানুযায়ী এমন কোন কাজ করতে বাধ্য করতে পারে, যা সে সম্পাদন করতে ইচ্ছুক ছিল না। ঐ ইচ্ছা প্রয়োগ এর সাথে শাস্তির ভয় বা আর্থিক প্রতিশ্রুতির বিষয় জড়িত থাকে।


৫. শাসন করার স্বীকৃতি হলো কর্তৃত্ব : ক্ষমতা ব্যতীত কর্তৃত্বের অস্তিত্ব সম্ভব নয় ; কিন্তু কর্তৃত্ব ব্যতীত ও ক্ষমতা টিকে যেতে পারে। অবশ্য তার বাস্তবায়ন সহজ নয়। ক্ষমতাকে কর্তৃত্বে পরিণত করে একটি নির্দিষ্ট ক্ষমতার সম্পর্ককে প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব। ক্ষমতা ব্যতীত যেমন কর্তৃত্ব গড়ে উঠতে পারে না, ঠিক একইভাবে বৈধতা ব্যতীত ক্ষমতাও ফলপ্রসূ হতে পারে না। সুতরাং শাসন করার অধিকারের স্বীকৃতিই হলো কর্তৃত্ব।

আরো পড়ুন : “মার্কিন সিনেট পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী দ্বিতীয় কক্ষ”- ব্যাখ্যা কর।

৬. কর্তৃত্ব ছাড়াও ক্ষমতা প্রয়োগ সম্ভব : কর্তৃত্ব ব্যতীত কোন কোন ব্যক্তি একটা নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারেন। এ ক্ষমতা সংবিধান বহির্ভূত ক্ষমতাকেন্দ্র (Unconstiational centre of power) হতে পরিচালিত হতে পারে। যেমন- রাজনৈতিক কর্তৃতের অধিকারী না হয়েও অনেক সময় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ দলীয় এম. পি. ও মন্ত্রীদের এমনভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেন যে, তাতে করে ঐ নেতৃবৃন্দের ইচ্ছা ও সিদ্ধান্ত অনুসারে সরকার নীতি প্রণয়নে বাধ্য হয়। এখানে মূল কেন্দ্র বেসরকারি ব্যক্তির হাতে এবং কর্তৃত্ব আইনানুগ সংস্থায় নিযুক্ত বা নির্বাচিত ব্যক্তির হাতে ন্যস্ত।


৭. রাজনৈতিক ক্ষমতাকে রাজনৈতিক কর্তৃত্ব হতে বিচ্ছিন্ন করা সম্ভব : রাজনৈতিক ক্ষমতাকে রাজনৈতিক কর্তৃত্ব হতে বিচ্ছিন্ন করা যায়। শাসন করার ক্ষমতা যখন স্বীকৃতি পায় না তখন এ বিচ্ছিন্নতা সম্ভব। কর্তৃত্ব ছাড়াই ক্ষমতা বজায় রাখা যায়, কারণ কোন ব্যক্তি বলপ্রয়োগের মাধ্যমে অন্যকে নিজের ইচ্ছানুযায়ী পরিচালিত করতে পারেন। তবে এর অর্থ এই নয় যে, সকলেই তা মেনে নিয়েছে। শাস্তির ভয়ে মানুষ বলপ্রয়োগ বা ক্ষমতার নিকট নতী স্বীকার করেছে।


আবার ক্ষমতা ছাড়া কর্তৃত্ব অর্থহীন হয়ে দাঁড়ায়। যুদ্ধের সময় শত্রুপক্ষ দ্বারা অধিকৃত অঞ্চলের লোকেরা বিজয়ী পক্ষের কর্তৃত্বের নিকট পরাজয় স্বীকার করলেও ক্ষমতাকে বৈধ মনে করে না। সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সামরিক বাহিনী রাজনৈতিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে ক্ষমতাও প্রয়োগ করতে পারে। কিন্তু সাধারণ মানুষ যতক্ষণ না এ ধরনের ক্ষমতার প্রয়োগের বৈধতা প্রদান না করে ততক্ষণ পর্যন্ত প্রকৃত কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয় না। এ কারণে অসাংবিধানিক পন্থায় যারাই ক্ষমতার আসে তারা সকলেই বৈধতা পাওয়ার চেষ্টা করে।


উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, ক্ষমতার বৈধতা দুটি উপায়ে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। প্রথমত, সাংবিধানিক আইনের স্বীকৃতি এবং দ্বিতীয়ত, ব্যাপক জনগণের স্বীকৃতি। যেখানে ক্ষমতার প্রয়োগে দুটি পদ্ধতির কোন একটিরও সমর্থন না সেখানে শাসন করার বা কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার প্রশ্নই আসে না। সুতরাং কর্তৃত্ব হলো বৈধ ক্ষমতা। ক্ষমতা প্রয়োগ করার অধিকার যখন স্বীকৃতি লাভ করে তখনই কর্তৃত্বের উদ্ভব ঘটে। ক্ষমতা এবং বৈধতার সমন্বয়ে কর্তৃত্বের সৃষ্টি।


#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Now
Ok, Go it!