রাজনৈতিক তত্ত্ব হিসেবে ভাববাদ বা আদর্শবাদের উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ আলোচনা কর।

admin

ভূমিকা : রাষ্ট্রের প্রকৃতি বিশ্লেষণের সাথে যে সকল তত্ত্ব জড়িত সেগুলোর মধ্যে ভাববাদ বা আদর্শবাদ অন্যতম। এ তত্ত্বকে কখনো দার্শনিক তত্ত্ব (Philosophical theory), চরম মতবাদ (Absolute Theory) এবং কখনো বা অধিবিদ্যামূলক তত্ত্ব (Metaphysical Theory) নামে অভিহিত করা হয়। নাম যাই হোক আদর্শবাদ রাষ্ট্রের প্রকৃতি সম্বন্ধে যা উপস্থাপন করেছে রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসে তা সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিস্তার করেছে।


রাজনৈতিক তত্ত্ব হিসেবে ভাববাদ বা আদর্শবাদের উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ আলোচনা কর


ভাববাদ বা আদর্শবাদের উৎপত্তি : গ্রিক দার্শনিক প্লেটো ও এরিস্টটলের চিন্তাধারার মধ্য থেকেই রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগণ ভাববাদী বা আদর্শবাদী তত্ত্ব আবিষ্কার করেছেন। সি. ই. এম. জোয়াড মনে করেন দুটি ভিন্ন সূত্র থেকে আদর্শবাদের জন্ম হয়েছে। জোয়াড (C. E. M. Joad) বলেন, আদর্শবাদের উৎপত্তির প্রথম সূত্র হচ্ছে রাষ্ট্রের প্রকৃতি। প্লোটো ও এরিস্টটল রাষ্ট্রকে স্বয়ংসম্পূর্ণ (Self sufficing) হিসেবে গণ্য করে রাষ্ট্রকে সমাহের সমার্থক বলে মনে করেছেন। রাষ্ট্রের মাধ্যমে ব্যক্তি সকল সামাজিক আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রকাশ এবং সকল সামাজিক অভাব ও প্রয়োজন পূর্ণ হয় বিধায় রাষ্ট্র চরম কর্তৃত্বের অধিকারী। অন্যান্য সকল সংগঠন ও সংঘের উপরও রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব ও প্রাধান্য প্রশ্নাতীত। মানুষ রাজনৈতিক ও সামাজিক জীব বলে একমাত্র রাষ্ট্রের মধ্যেই সে তার পূর্ণতা উপলব্ধি করতে পারে ।


জোয়াডের মতে দ্বিতীয় সূত্র হচ্ছে, মানুষ সম্পর্কে গ্রিক দার্শনিকদের ধারণা। অনেক দার্শনিক মনে করেন মানুষের মৌলিক প্রকৃতি হলো তারা রাষ্ট্র ও সমাজে বসবাসের পূর্বে প্রকৃতির রাজ্যে বসবাস করতো। কিন্তু প্রকৃতির রাজ্যের ভয়াবহ অসহনীয় অবস্থা থেকে বেরিয়ে এসে নিরাপত্তা লাভের আশায় চুক্তির মাধ্যমে প্রকৃতির রাজ্যের স্থলে সমাজ বা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে। এর নাম হলো সামাজিক চুক্তি মতবাদ। এখানে সমাজ একটি কৃত্রিম ব্যবস্থা। এরিস্টটলসহ গ্রিক দার্শনিকদের মতে মানুষ সামাজিক জীব। তাই সমাজে বসবাস করাই মানুষের প্রকৃতি। বিচ্ছিন্ন জীবনযাপন মানুষের প্রকৃতি বিরোধ পারস্পরিক লেনদেন বা আদান-প্রদানের মাধ্যমে মানুষ যেমন তার অভাব দূর করে তেমনি দায়িত্ব পালন ও প্রদর্শনের মাধ্যমে নিজ ব্যক্তিত্বের বিকাশও ঘটতে পারে। রাষ্ট্র ব্যক্তিকে নিরাপত্তা প্রদান করে, অবিচার দূর করে, বাড়ি বিকাশের সুযোগ করে দেয়। বিনিময়ে রাষ্ট্র মানুষের কাছ থেকে দ্বিধাহীন আনুগত্য লাভের আশা করে যা ব্যক্তির। উচিত। অধ্যাপক গার্নার মনে করেন, “গ্রিক দার্শনিক প্লেটোও এরিস্টটলের স্বয়ং-সম্পূর্ণ রাষ্ট্রের ধারণা হতে এমন এক দর্শনের উদ্ভব ঘটলো যা রাষ্ট্রকে আদর্শের দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করে দেবত্বের পর্যায়ে উন্নীত করলো।"


ভাববাদ বা আদর্শবাদের প্রসার বা ক্রমবিকাশ : গ্রিক দর্শনের সূত্র ধরে পরবর্তীতে জার্মান দার্শনিক। হেগেল, ফিকটে, ট্রেইটস্কী, নিৎসে, বার্নহার্ডি এবং ইংরেজ দার্শনিক টি. এইচ. গ্রিন, বর্নার্ড বোসাঙ্কোয়েট ও এফ. এই ব্রাডলী ভাববাদী বা আদর্শবাদী তত্ত্বের বিকাশে বিশাল ভূমিকা রাখেন।


ফরাসি দার্শনিক রুশো (Rousseau) ও মন্টেস্কু (ঘঁতেক) (Montesquieu) দ্বারা প্রভাবিত হয়ে দার্শনিক যায় (Kant) নিজস্ব চিন্তার দ্বার উন্মোচন করেন ও ভাববাদী আদর্শ প্রচার করেন। তাঁর মতে রাষ্ট্র সর্বাত্মক ক্ষমতার অধিকার (Omnipolent) ও অভ্রান্ত (Infalliable)। রাষ্ট্রের সমৃদ্ধি ঐশ্বরিক অবদানের ফল। রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন মানুষের একটি পবিত্র দায়িত্ব। ব্যক্তিস্বাধীনতার ধারক বাহক হিসেবে মনে করতেন বিশুদ্ধ যুক্তি দিয়ে স্বাধীনতা নিয়ন্ত্রিত হয়। তিনি কর্তৃত্ব ও স্বাধীনতার মধ্যে কোন বিরোধ লক্ষ করেন নি।


ভাববাদের অন্যতম দিকপাল ছিলেন দার্শনিক ফিকটে (Fichte)। তিনি মনে করতেন রাষ্ট্র মানুষের স্বাভাবিক প্রকৃতির বহিঃপ্রকাশ। ব্যক্তিকে তার নিজস্ব সভায় প্রতিষ্ঠিত করা রাষ্ট্রের অন্যতম দায়িত্ব। তিনি রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক স্বয়ং সম্পূর্ণতার তত্ত্ব প্রচার করেছিলেন। তিনি প্রচণ্ড ক্ষমতাধর জাতীয়তাবাদী ও সর্বশক্তিমান রাষ্ট্রের প্রবক্তা ছিলেন।


নিৎসে (Nietzsche), ট্রেইটস্কী (Treitschke) এবং বার্নহার্ডি (Bernhwrdi) প্রমুখের মধ্যে ভাববাদী ধারণা আরো ব্যাপক আকার ধারণ করেছিল। তারা সামরিকতন্ত্র ( Militarism) প্রচারের জন্য ভাববাদী তত্ত্বকে ব্যবহার করেন। তারা রাষ্ট্রকে দেবতার আসনে বসিয়ে রাষ্ট্রের মাহাত্ম্য প্রচার করেছিলেন। তাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে জার্মানি সামরিকতন্ত্রের মাধ্যমে এবং আগ্রাসী জাতীয়তাবাদী মনোভাবে দীক্ষিত হয়ে বিশ্বযুদ্ধে লিপ্ত হয়। শক্তি বা বল প্রয়োগ মতবাদ এরা প্রচার করেছিলেন।


খ্রিস্টীয় ঊনবিংশ শতাব্দীতে ইংল্যান্ডে এফ. এইচ. ব্রাডলি (F. H. Bradely). টি. এইচ. গ্রিন (T. H. Green) এবং বার্নার্ড বোসাঙ্কোয়েট (Bosanquet) উদারতাবাদের মাধ্যমে ভাববাদী তত্ত্বের প্রসার ঘটান। টি. এইচ. গ্রিন রাষ্ট্রের ক্ষমতার অভ্যন্তরীণ এবং বাহ্যিক সীমাবদ্ধতার কথা উল্লেখ করেন। তিনি রাষ্ট্রের নৈতিকমূল্য ও প্রাধান্যকে স্বীকার করেছেন। তিনি ব্যক্তিকে রাষ্ট্রের বেদিমূলে বিসর্জন দেন নি। রাষ্ট্রের বিরোধিতার অধিকারকে গ্রিন স্বীকৃতি দিয়েছেন।


ভাববাদের প্রসারে জর্জ উইলহেল্‌ম ফ্রেডারিক হেগেল এর অবদান : হেগেলের রচনায় ভাববাদী মতবাদ বিকশিত ও পরিপূর্ণতা অর্জন করে।


ক. ঐশ্বরিক ও বিবর্তনবাদের সমন্বয় : হেগেলের রাষ্ট্র ঐশ্বরিক শক্তির প্রতীক। তিনি এ চিন্তাধারাও পোষণ করতেন। যে, দীর্ঘকালীন বিবর্তন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে রাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটেছে এবং বিকশিত হয়েছে। ঐশ্বরিক শক্তি রাষ্ট্র বিকাশের প্রতি স্তরে প্রভাব বিস্তার করেছে; রাষ্ট্র ঈশ্বরের সৃষ্টি।


খ. আত্মসচেতন নৈতিক সত্তা : হেগেল মনে করতেন, রাষ্ট্র একটি নৈতিক আত্মসচেতনমূলক সত্তা ও আত্মচেতনসম্পন্ন এবং আত্মোপলব্ধিকারী সত্তা "a self-conscious ethical substance and a self-knowing and self-actualising individual." রাষ্ট্রের নিজস্ব ইচ্ছা ও ব্যক্তিত্ব রয়েছে। রাষ্ট্রের এ ইচ্ছা ও ব্যক্তিত্ব রাষ্ট্রের ভেতরকার অন্য সকল ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব ও ইচ্ছার ঊর্ধ্বে অবস্থান করে। রাষ্ট্র সর্বজনীন যুক্তির (universal reason) প্রতীক। রাষ্ট্রের নিজস্ব চেতনাও রয়েছে। রাষ্ট্র সর্বজনীন চেতনা ও উচ্চতর বাস্তবতার প্রকাশ মাত্র।


গ. রাষ্ট্র সকল স্বাধীনতার প্রতীক : ব্যক্তির কর্তব্য হলো সর্বোচ্চ পর্যায়ে রাষ্ট্রের আনুগত্য প্রদর্শন করা ও তার সদস্য হওয়া। রাষ্ট্রের প্রতি চূড়ান্ত আনুগত্য প্রদর্শনের মাধ্যমেই ব্যক্তি তার সকল প্রকারের স্বাধীনতা ভোগ করতে পারে। রাষ্ট্রই স্বাধীনতার উৎস এবং এর মধ্যেই স্বাধীনতা অনুভূত হয়। যেহেতু রাষ্ট্র সকল প্রকার অধিকার ও স্বাধীনতার জননী সেহেতু ব্যক্তির পক্ষে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধাচরণ করা সম্ভব নয়।


ঘ. রাষ্ট্রসর্বদর্শী ও সর্ব ক্ষমতার অধিকারী : হেগেলের মতে, রাষ্ট্র সর্বদর্শী (Omniscient) সর্বাত্মক ক্ষমতার অধিকারী (Omnipotent) এবং সর্বত্রই রাষ্ট্র উপস্থিত (Omnipresent)। রাষ্ট্র মর্ত্যে ঈশ্বরের পদচারণা বিশেষ (The state is the march of God in the world)। রাষ্ট্র নীতিবোধের উৎস ও সামাজিক নীতিবোধের বহিঃপ্রকাশ। রাষ্ট্র অতিমানবিক এবং সমাজের ঊর্ধ্বে এর অবস্থান। রাষ্ট্রের মধ্যে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, ব্যক্তির স্বাধীনতা, নৈতিকতা যুক্তি ও চেতনা বিলীন হয়ে গেছে ।


উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, সুতরাং রাষ্ট্র সকল অধিকার ও স্বাধীনতার জননী। রাষ্ট্র ও সমাজের মধ্যে ব্যক্তি যে স্বাধীনতা ভোগ করে তা হলো প্রকৃত স্বাধীনতা। হেগেল রাষ্ট্রকে সমষ্টিগত ইচ্ছার প্রতিফলন হিসেবে গণ্য করতেন।


#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Now
Ok, Go it!