ভূমিকা :
বর্তমান বিশ্ব রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত। সম্পদ এবং প্রাচুর্যের ক্ষেত্রে গোটা বিশ্ব প্রধানত উন্নত এবং অনুন্নত এ দুই ভাগে বিভক্ত। এক সময় এ নিখিল ধরণী প্রথম বিশ্ব, দ্বিতীয় বিশ্ব, তৃতীয় বিশ্ব ও চতুর্থ বিশ্ব এ চার ভাগে বিভক্ত ছিল। আর বর্তমান বিশ্ব প্রধানত চার ভাগে বিভক্ত। যথা : উন্নত, অনুন্নত স্বল্পোন্নত এবং উন্নয়নশীল। অর্থনৈতিক ও শিল্পোন্নয়নে অগ্রসর দেশগুলো। উন্নত দেশ হিসেবে চিহ্নিত। অর্থনৈতিকভাবে পশ্চাৎপদ | দেশগুলো অনুন্নত দেশ হিসেবে চিহ্নিত। অর্থনৈতিকভাবে পশ্চাৎপদ কিন্তু কোন না কোন উন্নয়ন প্রক্রিয়া চলছে এমন দেশকে উন্নয়নশীল দেশ বলা হয়।
আর্থসামাজিক উন্নয়নে বাংলাদেশের অবস্থান :
অনেকে বাংলাদেশকে অনুন্নত দেশ বলে। আবার অনেকে বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশ বলে। আসলে বাংলাদেশ কোন ধরনের দেশ, উন্নত, অনুন্নত না কি উন্নয়নশীল তা বাংলাদেশের আর্থসামাজিক বৈশিষ্ট্য আলোচনার দ্বারা সুস্পষ্ট হয়ে উঠবে।
বাংলাদেশ একটি উন্নত, অনুন্নত না উন্নয়নশীল দেশ সে সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করা হল:
১. স্বল্প মাথাপিছু আয় : বাংলাদেশের জনগণের জীবনযাত্রার মান নিম্ন হওয়ায় মাথাপিছু আয়ের পরিমাণ অত্যন্ত অল্প। মার্কিন ডলারের হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশের বর্তমান মাথাপিছু আয়ের পরিমাণ ১১৯০ মার্কিন ডলার। অন্যান্য দেশের তুলনায় এ সংখ্যা অতি নিম্নমানের।
২. নিম্ন জীবনযাত্রার মান : বাংলাদেশের মানুষের জীবনযাত্রার মান খুব খারাপ। দরিদ্রতা এবং স্বল্প মাথাপিছু আয়ের কারণে জীবনযাত্রার মান নিম্ন। শহরাঞ্চলে যত্রতত্র বস্তি মা গড়ে উঠায় সেখানকার জনস্বাস্থ্যের অবনতি ঘটছে। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান প্রভৃতি মৌলিক অধিকার হতে বঞ্চিত হচ্ছে বহু মানুষ। স্বাস্থ্যবিজ্ঞান অনুযায়ী একজন সুস্থ লোকের দৈনিক ৩,০০০ কিলোক্যালোরি থেকে ৩,৫০০ কিলোক্যালোরি খাদ্য গ্রহণ করা পরকার। সেখানে বাংলাদেশের মানুষের দৈনিক গড় খাদ্য গ্রহণের পরিমাণ ১,৫০০ কিলোক্যালোরি, যা নিম্ন জীবনধারণের পরিচয় পর বহন করে।
৩. কৃষির উপর অতি নির্ভরশীলতা : বাংলাদেশের ত অর্থনীতি কৃষির উপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল এবং কৃষিতে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহৃত না হওয়ায় কৃষি উৎপাদন কম। ফলে বা জাতীয় উৎপাদন ব্যাহত হয়। সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী বর্তমানে র বাংলাদেশের শতকরা ৪৭.৫ ভাগ মানুষ কৃষির উপর নির্ভরশীল।
৪. বৈদেশিক সাহায্যের উপর অতি নির্ভরশীলতা : উন্নয়নশীল দেশগুলো অতিমাত্রায় বৈদেশিক ঋণ সাহায্যের উপর নির্ভরশীল, তেমনি বাংলাদেশও বৈদেশিক ঋণ সাহায্যের উপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল। প্রত্যেক বছরের বাজেটের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ আসে বৈদেশিক ঋণ সাহায্যের মাধ্যমে। কিন্তু আশার কথা, অতি সম্প্রতি আসছে। অন্যদিকে বৈদেশিক | রেমিটেন্স ধারাবাহিকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
৫. মূলধনের স্বল্পতা : বাংলাদেশের জনগণের মাথাপিছু | আর কম বলে সঞ্চয় প্রবণতা কম, সে কারণে কাঙ্ক্ষিত হারে মূলধন গঠিত হচ্ছে না।
৬. শিল্পে অনগ্রসরতা : স্বল্প মূলধন এবং দক্ষ উদ্যোক্তার অভাবে বাংলাদেশে শিল্পায়নের গতি ত্বরান্বিত হচ্ছে না। বাংলাদেশের ক্রমবর্ধিষ্ণু জনগণের খাদ্য চাহিদা মিটাতে গিয়ে প্রচুর পরিমাণে খাদ্যশস্য আমদানি করতে হচ্ছে। এতে আমাদের অর্জিত | বৈদেশিক মুদ্রার সিংহভাগ ব্যয় হয়ে যাচ্ছে। ফলে প্রয়োজনীয় মূলধনের অভাবে আমাদের শিল্পোন্নয়ন ঘটছে না।
৭. জনসংখ্যার বিশালায়তন : জনসংখ্যার বিশালায়তনের কারণে আমাদের সকল প্রকার উন্নয়ন প্রচেষ্টা ব্যাহত হচ্ছে। ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী বাংলাদেশে প্রতি বর্গকিলোমিটারে ১০১৫ জন লোক বসবাস করছে এবং ১৪ কোটি ৯৭ লক্ষ জনসংখ্যা ১-৩৭% হারে বৃদ্ধি পেয়ে এর পরিমাণকে আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে।
৮. ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব : বাংলাদেশে বেকার সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করছে। বর্তমানে মোট কর্মক্ষম লোকের প্রায় ৩৩% বেকার। কৃষিতে অতিরিক্ত লোকের চাপে উদ্বৃত্ত শ্রমিক সৃষ্টি হচ্ছে আবার কাঙ্ক্ষিত হারে শিল্পোন্নয়ন না হওয়ায় উদ্বৃত্ত শ্রমিক বেকারে পরিণত হচ্ছে। তাছাড়া থিওরেটিক্যাল পড়াশুনার কারণেও | বাংলাদেশে বেকারত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে।
৯. প্রযুক্তিগত অনগ্রসরতা : বর্তমান যুগ প্রযুক্তির যুগ। কিন্তু আমাদের দেশ এখনও প্রযুক্তির আশীর্বাদে পরিস্ফুটিত হয়ে উঠতে পারে নি। কৃষিক্ষেত্রে ব্যবহৃত হচ্ছে মান্ধাতার আমলের প্রযুক্তি। ফলে কৃষি উৎপাদন অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক কম।
১০. শিক্ষার নিম্নহার : বাংলাদেশে শিক্ষার হারও অত্যন্ত নিম্ন। দেশের অধিকাংশ লোক এখনও অশিক্ষিত, অম্ল, কুসংস্কারাচ্ছন্ন। যারা লিখতে এবং শুধু পড়তে পারে তাদের সংখ্যা হল ৬৫%, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার হার আরও কম।
১১. কারিগরি জ্ঞানের অভাব : স্বল্প আয়, জীবনযাত্রা নিম্নমান ও দেশের কারিগরি শিক্ষাকেন্দ্রের অভাবে বাংলাদেশের শ্রমিকদের কর্মকুশলতা অত্যন্ত নিম্নমানের। কুশলি লোকের অভাব আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্তরায়।
১২. প্রাকৃতিক সম্পদের অপূর্ণ ব্যবহার : মূলধন ও দক্ষ জনশক্তির অভাবে আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদ পূর্ণভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে না। আবার যথোপযুক্ত প্রাযুক্তিক সুবিধা না থাকায় আবিষ্কৃত এবং অনাবিষ্কৃত প্রাকৃতিক সম্পদ উত্তোলন করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে প্রাকৃতিক সম্পদ অব্যবহৃত থাকছে।
১৩. অনুন্নত পরিবহণ ও যোগাযোগ ব্যবস্থা : বাংলাদেশে পরিবহণ ও যোগাযোগ ব্যবস্থাও অনুন্নত। এদেশের সড়ক ও রেলপথের অবস্থা মোটেই সন্তোষজনক নয়। নৌপরিবহণ এবং বিমান ব্যবস্থাও যথেষ্ট উন্নত নয়। সড়ক পথও ততটা ভালো না।
১৪. বৈদেশিক বাণিজ্যের উপর অতি নির্ভরশীলতা : অন্যান্য অনুন্নত দেশের ন্যায় বাংলাদেশও অতিমাত্রায় বৈদেশিক বাণিজ্যের উপর নির্ভরশীল। বাংলাদেশ তৈরি পোশাকসহ মুষ্টিমেয় কয়েকটি f কাঁচামাল ও খাদ্যশস্য রপ্তানি করে। কিন্তু রপ্তানি অপেক্ষা বাংলাদেশকে আমদানি বেশি করতে হয়। এ কারণে বৈদেশিক বাণিজ্যের ভারসাম্য প্রতিকূল এবং ঘাটতি থাকে।
১৫. সামাজিক ও ধর্মীয় প্রথা : বাংলাদেশের সামাজিক ও ধর্মীয় প্রেথা উন্নত না হলেও, যৌথ পরিবার প্রথা, হিন্দুদের জাতিভেদ প্রথা, মানুষের রক্ষণশীল মনোভাব, কুসংস্কারাচ্ছন্ন মনোবৃত্তি, অর্থনৈতিক উন্নয়নে এখন তেমন একটা বাধার সৃষ্টি করছে না।
১৬. উদ্যোক্তার অভাব : অনুন্নত দেশগুলোর অন্যতম f বৈশিষ্ট্য হল দক্ষ উদ্যোক্তার অভাব। বাংলাদেশে এখনও তেমন উল্লেখযোগ্য পরিমাণে উদ্যোক্তা শ্রেণী গড়ে উঠে নি। পাকিস্তান ি আমলে এদেশের উদ্যোক্তার পরিমাণ ছিল মাত্র ২২টি পরিবার। সে তুলনায় এখন বৃদ্ধি পেলেও তা যথেষ্ট নয়।
১৭. দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র : বাংলাদেশের অর্থনীতি দারিদ্র্যের দুষ্টচক্রে আবদ্ধ হয়ে ঘুরপাক খাচ্ছে। স্বল্প মাথাপিছু আয়ের কারণে স্বল্প সঞ্চয়, ফলে যথেষ্ট মূলধন গঠিত হচ্ছে না। আবার স্বল্প মূলধনের কারণে স্বল্প বিনিয়োগ হয়ে স্বল্প উৎপাদন সংগঠিত হচ্ছে।
১৮. রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার অভাব : রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব বিস্তার করে। স্বৈরাচার, দুর্নীতি, আমলাতান্ত্রিক দীর্ঘসূত্রতা ইত্যাদি দেশের উন্নয়নকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে, দেশে বিদেশী বিনিয়োগে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে।
উপসংহার :
পরিশেষে উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে একথা সহজেই অনুমেয় যে, বাংলাদেশ একটি উন্নত দেশ নয় । বাংলাদেশের অর্থনীতিতে অনুন্নত এবং উন্নয়নশীল উভয় দেশের বৈশিষ্ট্যই বিদ্যমান। তবে আমাদের দেশে অর্থনৈতিক উন্নয়নের যাত্রা শুরু হয়েছে এবং গত কয়েক বছর ধরে কিছুটা অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। ধীরগতিতে হলেও আমাদের জাতীয় মাথাপিছু আয়, জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিভিন্ন অবকাঠামো গড়ে উঠছে, জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্যের অবস্থার উন্নতি ঘটছে। সর্বোপরি, মানব উন্নয়ন হচ্ছে, UNDP এর সর্বসাম্প্রতিক রিপোর্ট অনুযায়ী, মানব উন্নয়ন সূচকে বাংলাদেশ নিম্ন মানব উন্নয়নের দেশ থেকে মধ্যম মানব উন্নয়নের দেশে উন্নীত হয়েছে। সুতরাং সন্দেহাতীতভাবে একথা বলা যায় যে, | বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ।