ভূমিকা :
বর্তমান বিশ্ব রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে বহু অভিধায় বিভক্ত। সম্পদ ও প্রাচুর্যের ক্ষেত্রে গোটা বিশ্ব প্রধানত উন্নত ও অনুন্নত এ দু'ভাগে বিভক্ত। প্রধানত কোন দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা মাথাপিছু আয়, জনসংখ্যার পরিমাণ, শিক্ষার হার, সঞ্চয়, বিনিয়োগ, প্রাকৃতিক সম্পদ ও তার পূর্ণ সদ্ব্যবহার, কর্মসংস্থান ও সামাজিক সুবিধাবলি ইত্যাদির উপর বিশ্লেষণ করে উন্নত ও অনুন্নতের শ্রেণীভেদ করা হয়। বর্তমানে World development এর আলোচ্য রিপোর্ট অনুযায়ী বর্তমান বিশ্বের দেশসমূহকে উন্নত, উন্নয়নশীল এবং অনুন্নত নামে অভিহিত করা হয়। যেসব দেশ অর্থনৈতিক ও শিল্পায়নে অগ্রসর সেসব দেশগুলোকে উন্নত এবং যেসব দেশ অর্থনৈতিকভাবে পশ্চাৎপদ সেসব দেশগুলোকে অনুন্নত দেশ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। আবার যেসব দেশ অর্থনৈতিকভাবে পশ্চাৎপদ কিন্তু দেশে কোন না কোন উন্নয়ন প্রক্রিয়া চলছে সেসব দেশগুলোকে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে অভিহিত করা হয়।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে গৃহীত ব্যবস্থা :
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য নিম্নের পরামর্শগুলো দেয়া যায় :
১. শিক্ষা বিস্তার ও মানবসম্পদ সৃষ্টি : বর্তমানে কল্যাণ অর্থনীতির মূলকথা হচ্ছে মানব উন্নয়ন। মানব উন্নয়ন হলে প্রকৃত অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধিত হবে। আর মানব উন্নয়নের গতিকে শিক্ষা বিস্তারের মাধ্যমে ত্বরান্বিত করা যায়। তা শিক্ষা করলে জনগণের ধর্মীয় ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হয়ে অর্থনৈতিক উন্নয়নের পরিবেশ তৈরি হবে।
২. কারিগরি শিক্ষা বিস্তার: বাংলাদেশের গতানুগতিক শিক্ষার মাধ্যমে পঠিত বিষয়ের সাথে বাস্তব কর্মক্ষেত্রে কোন মিল না থাকায় বহু জাতীয় সম্পদের অপব্যবহার হচ্ছে। এ কারণে শিক্ষা ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন করতে হবে এবং কারিগরি শিক্ষার ব্যাপক প্রসারের মাধ্যমে মানবসম্পদ উন্নয়ন হবে। আর মানবের দক্ষতা বৃদ্ধি পেলে কর্মদক্ষতা ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি। পাবে, ফলে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে।
৩. জনগণের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন : অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধনের জন্য প্রয়োজন জনগণের উন্নত দৃষ্টিভঙ্গি। অর্থনৈতিক উন্নয়নের সুফল সম্পর্কে জনগণের মনে সুস্পষ্ট ধারণা তৈরি করতে হবে, জনগণকে উন্নয়নের প্রত্যাশিত করে তুলতে হবে।
৪. মূলধন গঠন : অর্থনৈতিক উন্নয়নের মূল প্রক্রিয়া হচ্ছে মূলধন। বাংলাদেশে সঞ্চয় প্রবণতা ও মূলধন গঠনের হার অত্যন্ত কম। বিদেশী বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। জনগণের মধ্যে সহয়তা করার ব্যাপারে আগ্রহ সৃষ্টি করতে হবে।
৫. প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবহার : বাংলাদেশে কিছু প্রাকৃতিক সম্পদ পাওয়া গেছে। অনেক গ্যাস প্রাপ্তির সম্ভাবনা রয়েছে। উপযুক্ত কলাকৌশল ব্যবহার করে আবিষ্কৃত সম্পদ উত্তোলন করে যথোপযুক্ত ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
৬. জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার হ্রাস করা : আমাদের জনসংখ্যা জনসম্পদের পরিবর্তে পর্বতসম বোঝাতে পরিণত হয়েছে। জনসংখ্যা সমস্যা এখন বাংলাদেশের প্রধান সমস্যা। এ সমস্যার কারণে সকল উন্নয়ন প্রক্রিয়া ভেঙে যাচ্ছে। সুতরাং অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথ সুগম করতে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার রোধ করা ছাড়া অন্য কোন উপায় নাই।
৭. দক্ষ উদ্যোক্তা সৃষ্টি : দক্ষ উদ্যোক্তার অভাবে উন্নয়ন প্রক্রিয়া এগিয়ে নেওয়া যায় না। আমাদের দেশে দক্ষ উদ্যোক্তার যথেষ্ট অভাব রয়েছে। সরকারকে এমন পদক্ষেপ নিতে হবে যাতে দেশে দক্ষ উদ্যোক্তা শ্রেণী সৃষ্টি হয় এবং তারা যাতে উৎপাদনমুখী শিল্পকারখানা গড়ে তুলতে পারেন, প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারেন।
৮. সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন : বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ। উন্নয়নশীল দেশে দ্রুত উন্নয়ন নিশ্চিত করার জন্য পরিকল্পনা অপরিহার্য। বার্ষিক পরিকল্পনায় গৃহীত উন্নয়ন পরিকল্পনাগুলো যাতে মাঝপথে বন্ধ হয়ে না যায় সেদিকে সরকারকে কড়া নজর রাখতে হবে।
৯. অবকাঠামোগত উন্নয়ন : এদেশের দ্রুত উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন অবকাঠামোর উন্নয়ন। এদেশের যোগাযোগ ও পরিবহন ব্যবস্থা, বিদ্যুৎ, সেচ ব্যবস্থা, বাঁধ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য প্রভৃতি অবকাঠামোগত সুযোগসুবিধা বৃদ্ধি করতে হবে। এর ফলে কৃষি ও শিল্পের উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে।
১০. বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন : যে কোন দেশের কৃষি শিল্পোন্নয়নের জন্য বিদেশ থেকে প্রচুর পরিমাণে যন্ত্রপাতি এবং চ. কাঁচামাল আমদানি করতে হয়। তাই প্রয়োজন প্রচুনা বৈদেশিক ন মুদ্রার। তাই রপ্তানি বাড়িয়ে এবং দ্রুত হারে শ্রমশক্তি রপ্তানির মাধ্যমে অধিক বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে হবে।
১১. আন্তর্জাতিক বাজার সৃষ্টি : বাংলাদেশের অর্থনেতিক উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করতে হলে দেশীয় পণ্যের আন্তর্জাতিক বাজার সম্প্রসারণ করতে হবে। এ বাজার অর্থনীতিতে টিকে থাকতে হলে আমাদের দেশে উৎপাদিত পণ্যের গুণগত মান বৃদ্ধি করতে হবে এবং বিদেশের সহিত সফল কূটনৈতিক এবং বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে।
১২. বৈদেশিক সাহায্য : বর্তমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের উন্নয়নের জন্য বৈদেশিক সাহায্য একান্ত প্রয়োজন। শর্ত যুক্ত বিদেশী সাহায্য আকৃষ্ট করে তার সদ্ব্যবহার করতে হবে। তবে অর্থনৈতিক উন্নয়নের মাধ্যমে পরবর্তীতে ক্রমশ বৈদেশিক সাহায্যের নির্ভরশীলতা কমাতে হবে।
১৩, উন্নত প্রযুক্তি : বাংলাদেশে বর্তমানে মান্ধাতা আমলের প্রযুক্তি ব্যবহৃত হচ্ছে। কৃষি ও শিল্পে অনুন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারের ২ ফলে উৎপাদন কম হচ্ছে। উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যে এ আমাদের জাতীয় উৎপাদন বৃদ্ধি করতে হবে।
১৪. অতিমাত্রায় উদারিকরণ রোধ: বিশ্বায়ন ও মুক্তবাজার হ অর্থনীতির এ যুগে বৈদেশিক বিনিয়োগ আসবেই। তবে অতিমাত্রায় বৈদেশিক বিনিয়োগের ফলে দেশীয় উদ্যোক্তা শ্রেণীর স্থ সৃষ্টির পথ যাতে রুদ্ধ হয়ে না যায় সরকারকে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
১৫. দুর্নীতি রোধ : দুর্নীতি বাংলাদেশের একটি অন্যতম প্রধান সমস্যা। দুর্নীতির কারণে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন রাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করতে হলে চোরাকারবারি, কালোবাজারি, করফাঁকি, ব্যাংক ঋণ খেলাপিসহ সমাজের বিভিন্ন স্তরে বিরাজমান দুর্নীতি রোধ করতে হবে।
১৬. কৃষিতে ভর্তুকি বৃদ্ধি : কৃষিতে ভর্তুকির পরিমাণ আরও বাড়াতে হবে। শুধু ডিজেল এর উপর ভর্তুকি দিলে হবে না। কৃষি সরঞ্জাম, সার, উন্নত বীজ ও কীটনাশক ঔষধ এর উপর ভর্তুকি দিতে হবে। এতে কৃষকের উৎপাদন খরচ কমবে। ফলে কৃষক জন শ্রেণীর মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পাবে এবং দেশের কৃষি ক্ষেত্রের এর উন্নয়ন হবে।
১৭. কৃষিপণ্যের মূল্য সংরক্ষণ : কৃষিপণ্যের চাহিদা ড অস্থিতিস্থাপক বিধায় উৎপাদন বাড়লে নাম হ্রাস পায় ও কৃষক যে ক্ষতিগ্রক হয়। তাই পৃথিবীর সকল দেশেই কৃষিপণ্যের মূল্য | সংরক্ষণ নীতি অবলম্বন করা হয়। আমাদের দেশেও সরকার কর্তৃক টি মূল্য সংরক্ষণনীতি (Price support policy) গ্রহণ করা উচিত ।
১৮. কৃষিপণ্যের বাজায় ব্যবস্থার উন্নয়ন : কৃষকরা যাতে তাদের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য মূল্য পায় সে জন্য কৃষিপণ্যের বাজার ব্যবস্থার উন্নয়ন করতে হবে। পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, ফসল সংরক্ষণ, দালাল ও ফড়িয়াদের তৎপরতা হ্রাস ইত্যাদির মাধ্যমে কৃষিপণ্যের বাজার ব্যবস্থার উন্নয়ন সম্ভব।
১৯. মুন্নাক্ষীতি রোধ : মুদ্রাস্ফীতির ফলে জনগণের প্রকৃত আয় করে। দ্রাক্ষীতিরোধে সরকারকে জোর পদক্ষেপ নিতে হবে। রমলা স্বাভাবিক রাখার জন্য সরকারকে বোর মুগা বেঁধে নিতে হবে এবং প্রয়োজনে নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রব্যের উপর অতকি প্রদান করতে হবে।
২০. স্বকর্মসংস্থান কর্মসূচি : এদেশে বেকারত্ব বেশি। তাই বেকার যুবক-যুবতীর বেকারত্ব রোধ করার জন্য বেকার যুবক- যুবতীরা যাতে স্বউদ্যোগে নিজেই নিজের কর্মসংস্থান করতে পারে বা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে নিজেকে নিয়োজিত করতে পারে। সে জন্য তাদেরকে সরকারি ও বেসরকারিভাবে উপযুক্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে এবং তাদেরকে সহজ শর্তে ঋণ দিতে হবে।
উপসংহার : পরিশেষে উপর্যুক্ত আলোচনার শেষে বলা যায় যে, বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ। এ দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন স্থবির নয় গতিশীল। তাই এ দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন আরও ত্বরান্বিত করতে হলে বাংলাদেশের বিদ্যমান সমস্যাগুলোর আশু সমাধান প্রয়োজন। অর্থনৈতিক উন্নয়নের দিক থেকে বাংলাদেশ একটি অমিত সম্ভাবনার দেশ। তাই সরকার ও বিরোধীদলসহ সকল রাজনৈতিক দলমত নির্বিশেষে দেশের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা দূর করে দেশে সৎ ও যোগ্য নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দেশের উন্নয়ন ত্বরান্বিত করা সম্ভব।