ভূমিকা : অর্থনীতি একটি সামাজিক বিজ্ঞান। বিভিন্ন অর্থনীতিবিদ বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ হতে অর্থনীতির সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। প্রখ্যাত নিও ক্লাসিক্যাল অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আলফ্রেড মার্শাল ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষদিকে অর্থনীতির এক নতুন সংজ্ঞা প্রদান করেন। অর্থনীতির বিভিন্ন সংজ্ঞার মধ্যে অধ্যাপক মার্শালের সংজ্ঞাটি সর্বাধিক প্রণিধানযোগ্য।
মার্শাল প্রদত্ত সংজ্ঞা ও মার্শালের মতে, "মানুষের দৈনন্দিন জীবনের প্রতিচ্ছবি হল অর্থনীতি। অর্থনীতি এমনই একটি বিষয়, যা মানবীয় কল্যাণের সাথে জড়িত।" সম্পদের পরিবর্তে কল্যাণের উপর মার্শাল গুরুত্ব আরোপ করতে বলেছেন। তাঁর মতে, সম্পদ হল একটি সমাজের লক্ষ্য অর্জনের উপায়। কিন্তু সমাজের মূল লক্ষ্য হল কল্যাণ অর্জন। নিও ক্লাসিক্যাল অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আলফ্রেড মার্শাল তাঁর A Principle of Economies' গ্রন্থে অর্থনীতির সংজ্ঞা প্রদান করেছেন এভাবে, "Political Economy or Economics is a study of mankind in the ordinary business of life, it examine that part of individual and social action which is most closely connected with the attainment and with the use of the material requisites of well being." রাজনৈতিক অর্থনীতি বা অর্থনীতি মানবজীবনের সাধারণ কার্যাবলি নিয়ে পর্যালোচনা করে, তা বিশ্লেষণ করে ব্যক্তি ও সমাজের কার্যাবলির সে অংশ, যা কল্যাণের বস্তুগত প্রয়োজনের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত বিষয়ের ব্যবহার প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে।
অর্থনীতি পাঠের প্রয়োজনীয়তা আলোচনা কর।
এ্যাডাম স্মিথ অর্থনীতিকে 'সম্পদের বিজ্ঞান' হিসেবে আখ্যা দিয়ে যে বক্তব্য রেখেছিলেন, অর্জন মার্শাল তা প্রত্যাখ্যান করে মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সাথে অর্থনীতিকে সম্পর্কবন্ধ করেন। মার্শালের মতে, “সম্পদকে কেন্দ্র করে অর্থনীতির আলোচনা হলেও অর্থশাস্ত্রের মুখ্য উদ্দেশ্য হল সম্পদের সাহায্যে মানবকল্যাণ সাধন করা।” এ জন্য অধ্যাপক মার্শাল বলেছেন, “অর্থনীতি একদিকে যেমন সম্পদ নিয়ে আলোচনা করে অন্যদিকে তেমনি অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ দিক মানুষ সম্পর্কেও আলোচনা করে।” তিনি আরও বলেছেন, "অর্থনীতি ব্যক্তি ও সমাজের সেসব কার্যারলি পরীক্ষা নিরীক্ষা করে, যাদের দ্বারা সুখ ও কল্যাণের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় সামগ্রী প্রাপ্তি ও ব্যবহার সম্ভব।” সুতরাং বলা যায়, মার্শাল মূলত নিম্নোক্তভাবে অর্থনীতিকে সংজ্ঞায়িত করেছেন, “অর্থনীতি মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সাধারণ কর্মকাণ্ড নিয়ে বিশ্লেষণ করে।" মার্শালের সংজ্ঞায় উল্লিখিত দৈনন্দিন কর্মকাণ্ড বলতে অর্থ উপার্জন এবং আয়ব্যয় সম্পর্কিত কর্মকাণ্ডকে বুঝিয়েছেন। তিনি তাঁর সংজ্ঞায় সম্পদের চেয়ে মানবকল্যাণের উপর গুরুত্বারোপ করেছেন।
মার্শালের সংজ্ঞার বৈশিষ্ট্য :
মার্শালের সংজ্ঞা পর্যালোচনা করলে কতিপয় বৈশিষ্ট্য প্রতিফলিত হয়। নিম্নে মার্শালের সংজ্ঞার বৈশিষ্ট্যসমূহ আলোচনা করা হল :
১. অর্থনীতি একটি সামাজিক বিজ্ঞান। সামাজিক বিজ্ঞান হিসেবে তা সামাজিক জীব মানুষকে নিয়ে পর্যালোচনা করে, তা কোন প্রকার উদ্ভিদ বা জীবজন্ত নিয়ে পর্যালোচনা করে না। অর্থনীতি ব্যক্তি ও সমাজ নিয়ে আলোচনা করে থাকে।
২. অর্থনীতি কল্যাণের বস্তুগত প্রয়োজনের সাথে সম্পৃক্ত, যা মানবীয় কল্যাণ নিয়ে পর্যালোচনা করে। তবে মানবীয় কল্যাণের একটি অংশ হিসেবে অর্থনৈতিক বা বস্তুগত কল্যাণ অর্থনীতির আলোচনায় স্থান পায়। এক কথায় অবস্তুগত বিষয়ের সাথে জড়িত কল্যাণসমূহ মার্শালের আলোচনার বহির্ভূত রয়েছে।
৩. মানুষের জীবনের অর্থনৈতিক দিকগুলো নিয়েই অর্থনীতি কেবল পর্যালোচনা করে না, তাতে মানুষের সামাজিক, রাজনৈতিক বা ধর্মীয় কার্যাবলি বিবেচিত নয়। এখানে ব্যক্তির আয়ব্যয়ের কৌশলই প্রাধান্য পায়।
ব্যষ্টিক ও সামষ্টিক অর্থনীতির মধ্যে পার্থক্যসমূহ উল্লেখ কর।
৪. অসীম অভাব পূরণের লক্ষ্যে মানুষ যেসব কার্যাবলি সম্পাদন করে সেগুলো আর্থিকভাবে পরিমাপযোগ্য। মার্শালের মতে, অর্থের মাধ্যমে পরিমাপযোগ্য বস্তুগত দ্রব্যসামগ্রীর আলোচনাই অর্থনীতির আওতাভুক্ত। এখানে বস্তুগত দ্রব্য বলতে যেসব দ্রব্য দেখা যায় এবং অর্থের মাধ্যমে যাদের মূল্য পরিমাপ করা যায় তাদেরকে বুঝায়।
অধ্যাপক মার্শাল এভাবে অর্থনীতির সংজ্ঞায় মানব কল্যাণের উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তিনি অর্থনীতিকে একটি মানবধর্মী ও কল্যাণকামী শাস্ত্রে পরিণত করেছেন।
মার্শালের সংজ্ঞার সমালোচনা :
সমকালীন সময়ে মার্শালের সংজ্ঞাটি সমর্থিত হলেও ১৯৩০ সালে রবিন্দ ও তাঁর সমর্থকগণ সংজ্ঞাটির নিম্নোক্ত উপায়ে সমালোচনা করেছেন :
১. মার্শাল অর্থনীতিকে কল্যাণমূলক বিজ্ঞান হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তাঁর মতে, অর্থনীতি কেবল কল্যাণের সাথে জড়িত বিষয়সমূহ নিয়ে আলোচনা করে, রবিন্স মনে করেছেন অর্থনীতি একটি নিরপেক্ষ বিজ্ঞান।
২. মার্শালের মতে, "অর্থনীতি শুধু বস্তুগত বিষয়ের সাথে জড়িত কল্যাণ নিয়ে পর্যালোচনা করে।” কিন্তু এল রবিন্স বিষয়টিকে গ্রহণ করতে পারেন নি। রবিন্সের মতে, “অর্থনীতি শুধু বস্তুগত বিষয়ের সাথে জড়িত কল্যাণ নিয়ে পর্যালাচনা করে না, বরং অবস্তুগত বিষয়সমূহ কল্যাণের নির্ধারক, যা মার্শালের সংজ্ঞায় বিবেচিত হয় নি।"
৩. মার্শালের মতে, মানুষের কল্যাণকে অর্থের দ্বারা পরিমাপ করা যায়। কিন্তু কল্যাণ বা উপযোগ একটি মানসিক ধারণা, যাকে অর্থের দ্বারা পরিমাপ করা যায় না। সুতরাং, মার্শাল অর্থকে কল্যাণের মানদণ্ডে বিবেচিত করে সংজ্ঞাটিকে ত্রুটিপূর্ণ করেছেন ।
৪. মার্শালের আলোচনায় শুধু নীতিবাচক দিক স্থান পেয়েছে। ইতিবাচক দিক তাঁর আলোচনা হতে বাদ পড়েছে। বাস্তবে অর্থনীতি কোন নীতিশাস্ত্র নয় ।
৫. মার্শাল অর্থনীতিকে বিজ্ঞান এবং কল্যাণের সাথে সম্পৃক্ত করেছেন। অন্যদিকে, রবিন্স অর্থনীতিকে শুধু বিজ্ঞান হিসেবে চিহ্নিত করার চেষ্টা করেছেন।
৬. মার্শালের মতে, অর্থনীতি কেবল সমাজবদ্ধ মানুষের কার্যাবলি আলোচনা করে। কিন্তু রবিলের মতে, “সামাজিক ও অসামাজিক সকল মানুষের কার্যকলাপ অর্থনীতির আওতাভুক্ত হওয়া উচিত।” এ দিক দিয়ে বিচার করলে মার্শালের সংজ্ঞাটি সংকীর্ণ হয়ে পড়েছে একথা বলা যায়।
৭. মানবজীবনের মৌলিক সমস্যাটি অধ্যাপক মার্শালের সংজ্ঞায় উপেক্ষা করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে, অর্থনীতি সম্পদের আলোচনার শাস্ত্র নয়; বরং অপ্রাচুর্যের ফলে সমাজে যে সমস্যার সৃষ্টি হয় অর্থনীতি মূলত তাই আলোচনা করে ।
উপসংহার :
উপরিউক্ত ত্রুটিবিচ্যুতির কারণে মার্শালের সংজ্ঞাটি সমালোচিত হলেও পরবর্তীকালে অনেক অর্থনীতিবিদ তাঁর সংজ্ঞাটিকে গ্রহণ করতে চেয়েছেন, আবার অনেকে সে সংজ্ঞাটিকে বর্জন করতে বলেছেন। অধ্যাপক পিগু, অধ্যাপক মার্শালের সংজ্ঞাকে সমর্থন করে বক্তব্য রাখেন কিন্তু অধ্যাপক রবিন্স কল্যাণভিত্তিক সংজ্ঞাকে বর্জন করার পরামর্শ দেন। সুতরাং বলা যায়, বাস্তবতার নিরীখে মার্শালের ত্রুটিযুক্ত সংজ্ঞাটির গুরুত্ব হ্রাস পেলেও তাঁর সংজ্ঞায় মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সাধারণ কর্মকাণ্ড তথা মানবকল্যাণ অন্তর্ভুক্ত করায় সংজ্ঞাটির গুরুত্ব কম নয়।