অধ্যাপক এল রবিন্স অর্থনীতির সংজ্ঞাটি ব্যাখ্যা কর।

admin

ভূমিকা :

অর্থনীতির একটি গ্রহণযোগ্য বিজ্ঞানসম্মত সংজ্ঞা থাকা প্রয়োজন। অবৈজ্ঞানিক সংজ্ঞা কেউ গ্রহণ করতে চায় না। এ শূন্যতা পূরণে এগিয়ে আসেন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক Lionen Robins, তিনি অর্থনীতিকে স্বল্পতার দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করেছেন। মানুষের অভাব অসীম এবং সম্পদ সীমিত হওয়ার কারণে স্বল্পতা সমস্যার উদ্ভব ঘটে।


অধ্যাপক এল রবিন্স অর্থনীতির সংজ্ঞাটি ব্যাখ্যা কর।


এল. রবিল এর প্রদত্ত সংজ্ঞা :

১৯৩১ সালে প্রকাশিত 'Nature and Significance of Economic Science' নামক গ্রন্থে এল, রবিন্স মার্শাল প্রদত্ত সংজ্ঞার সমালোচনা করেন এবং বস্তুগত ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত সংজ্ঞাটি বর্জন করে নতুন একটি বৈজ্ঞানিক সংজ্ঞা প্রদানের চেষ্টা করেন। তিনি বলেছেন, “অর্থনীতি হল একটি বিজ্ঞান, যেখানে অসীম অভাব এবং সীমাবদ্ধ সম্পদ, যে সম্পদসমূহ বিকল্পভাবে ব্যবহার করা সম্ভব, এর মধ্যে নিয়োজিত মানব আচরণকে বিশ্লেষণ করে।” রবি অর্থনীতির সংজ্ঞা ও বিষয়বস্তু সম্পর্কে তাঁর পূর্ববর্তী অর্থনীতিবিদদের সমালোচনা করেন। অর্থনীতিকে তিনি অসীম অভাব, দুষ্প্রাপ্য সম্পদ এবং অর্থনৈতিক কর্মকাজের আলোকে উপস্থাপন ও ব্যাখ্যা করেন। তিনি যুক্তি দেন যে, অর্থনীতি বস্তুগত এবং অবস্থাগত এ উভয় ধরনের বিষয় নিয়ে পর্যালোচনা করে। রবিন্স এর সংজ্ঞায় মানব আচরণ সীমাবদ্ধ সম্পদ দ্বারা কিভাবে অসীম অভাব মিটানোর প্রচেষ্টায় নিয়োজিত তার ব্যাখ্যা প্রদান করে। রবিন্স এর সংজ্ঞাটি বিশ্লেষণ করলে এর মধ্যে তিনটি বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়। বৈশিষ্ট্য তিনটি বর্ণনাসহ নিয়ে প্রদান করা হল :


ক. অসীম অভাব : কোন দ্রব্য বা সেবা থেকে উপযোগ বা তৃপ্তি পাওয়ার ইচ্ছা বা আকাঙ্ক্ষাকে অভাব বলে। মানুষের এ অভাবের শেষ নেই। মানুষ সামাজিক জীব। জীবনধারণের জন্য তাকে নানাবিধ অভাবের সম্মুখীন হতে হয়। কোন একটি অভাব পূরণ হলে নতুন করে আরেকটি অভাব দেখা দেয়। যেমন : অন্নের অভাব দূর হলে বস্ত্রের অভাব দেখা দেয়, তারপর ক্রমান্বয়ে বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা ইত্যাদি অভাব দেখা দেয়। আর এ অভাব থেকেই অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের উদ্ভব হয়। কারণ, মানুষ অভাব পূরণের জন্য কাজে লিপ্ত হয়। মানুষের এ অভাব সীমাবদ্ধ হলে এসব অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের প্রয়োজন হতো না। সুতরাং, অভাব থেকেই সমস্যার সৃষ্টি এবং তা নিরসনের জন্য অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সৃষ্টি হয়েছে।


খ. সীমাবদ্ধ সম্পদ : সম্পদ বলতে ঐসব দ্রব্যকে বুঝায় যার উপযোগ আছে, যোগান সীমিত এবং মানুষের শ্রম দ্বারা সৃষ্ট ও বিনিময়যোগ্য। অর্থনীতিতে এ সম্পদের যোগান সীমিত যদিও অভাব অসীম। কিন্তু এ অসীম অভাব এ সীমাবদ্ধ সম্পদ দ্বারাই মিটাতে হবে। এক্ষেত্রে প্রথমে অধিক প্রয়োজনীয় অভাব মিটাতে হবে। অনেক সময় প্রকৃতিতে আমরা অফুরন্ত সম্পদ পাই, কিন্তু তা দ্বারা সব অভাব মিটানো সম্ভব হয় না। আর এখানেই স্বল্পতা সমস্যা দেখা দেয়। আর এ স্বল্পতার সমস্যা না থাকলে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের প্রয়োজন হতো না বা কোন সমস্যা থাকত না। শ্রম, মূলধন, জমি ও সংগঠন সীমাবদ্ধ না হলে মৌলিক সমস্যা দেখা দিত না এবং অর্থনীতি পাঠেরও প্রয়োজন হতো না। চাহিদার তুলনায় সরবরাহের পরিমাণ কমই হল স্বল্পতা, যা রবিন্স এর সংজ্ঞায় গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করা হয়েছে।


গ. সম্পদের বিকল্প ব্যবহার সম্ভব : অর্থনীতিতে চাহিদা অসীম এবং সম্পদ সসীম হলেও এ সসীম সম্পদের বিকল্প ব্যবহার সম্ভব। অর্থাৎ, কোন একটি সম্পদ একাধিক অভাব পূরণে ব্যবহৃত হতে পারে। কোন সম্পদ কম বা বেশি ব্যবহার করে মানুষ তার অভাব পূরণ করতে পারে। যেমন : শিল্পক্ষেত্রে যদি শ্রম ও মূলধন দুটি সম্পদ থেকে একটি কম ব্যবহার করে অন্যটি বেশি ব্যবহার করে উৎপাদন সম্ভব। আবার সম্পদ শিল্পক্ষেত্রে ব্যবহার না করে কৃষিক্ষেত্রেও ব্যবহার করা যেতে পারে। এভাবে অর্থনীতিতে সুযোগ বায় বিবেচনা করে কোথায় সম্পদ ব্যবহার করা হবে তা নির্ধারণ করা হয়। রবিদ এর সংজ্ঞায় এ ধরনের বিকল্প ব্যবহারের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।


এভাবে রবিন্স এর সংজ্ঞা বিশ্লেষণ করলে উল্লিখিত বৈশিষ্ট্যসমূহ ধরা পড়ে। এসব বৈশিষ্ট্যের প্রেক্ষিতে রবিন্স এর সংজ্ঞাকে উত্তম বলে গ্রহণ করা হলেও তা সমালোচনার ঊর্ধ্বে নয়।


রবিল এর অর্থনীতি সংজ্ঞার সমালোচনা :

অধিকাংশ অর্থনীতিবিদগণ রবিন্স এর প্রদত্ত সংজ্ঞাটিকে সমর্থন করলেও সংজ্ঞাটি সমালোচনার ঊর্ধ্বে নয়। রবার্টসন, অধ্যাপক টমাস, বোল্ডিং প্রমুখ অর্থনীতিবিদ এল. রবিন্স প্রদত্ত সংজ্ঞাটির সমালোচনা করেন। নিম্নে সমালোচনাগুলো উল্লেখ করা হল :


১. রবিন্স এর সংজ্ঞায় মানবকল্যাণের দিকটি উপেক্ষিত। রবিন্স অর্থনীতিকে স্বল্পতার আলোচনায় আবদ্ধ রেখেছেন। ফলে তাঁর সংজ্ঞায় অর্থনীতি একটি নিরস বিজ্ঞানে পরিণত হয়েছে।


২. রবিন্স অর্থনীতিকে ব্যষ্টিক পর্যায়ে বিবেচনা করেছেন। এখানে ব্যক্তির আচরণকে স্থান দেওয়া হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে, অর্থনীতি একটি সামাজিক বিজ্ঞান। ফলে রবিল এর আলোচনায় সামাজিক দিকটা বাদ পড়েছে।


৩. রবিন্স অর্থনীতিকে মূল্যনির্ধারণ তত্ত্ব হিসেবে চিহ্নিত করেন। প্রকৃতপক্ষে, মূল্যনির্ধারণ, ভারসাম্য ব্যাখ্যা এবং সম্পদ বণ্টন ছাড়াও অর্থনীতি জাতীয় আয়, বিনিয়োগ, নিয়োগ, ব্যাংকব্যবস্থা, করব্যবস্থা ইত্যাদি অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে আলোচনা করে, যা রবিন্স এর সংজ্ঞার উল্লেখ করা হয় নি।


৪. রবিন্স তাঁর সংজ্ঞায় সম্পদের সীমাবদ্ধতাকে গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করেছেন। কিন্তু পৃথিবীর প্রতিটি দেশেই বেকারসমস্যা বিদ্যমান। কাজেই অব্যবহৃত সম্পদ থাকা অবস্থায় অপ্রতুলতাকে বিবেচনায় আনা ঠিক নয়। সুতরাং, অনুন্নত দেশসমূহে সম্পদের প্রাচুর্যই মূল সমস্যা, যা তার আলোচনায় আসে নি।


৫. বর্তমানে অর্থনৈতিক উন্নয়ন অর্থনীতির অন্যতম প্রধান আলোচ্যবিষয় হিসেবে বিবেচিত হয়। কিন্তু রবিন্স তাঁর সংজ্ঞার কোথাও অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্পর্কে আলোচনা করেন নি। অথচ অর্থনৈতিক উন্নয়নই মানুষের সকল অর্থনৈতিক কর্ম প্রচেষ্টার মূল লক্ষ্য।


৬. রবিন্স এর সংজ্ঞাটি উন্নত দেশের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হলেও অনুন্নত দেশে এর বাস্তবতা পরিলক্ষিত হয় না। অনুন্নত দেশে প্রচুর্য মৌলিক সমস্যা। কারণ, সেসব দেশে সম্পদসমূহ অব্যবহৃত, নিম্ন ব্যবহৃত এবং অপচয়মূলকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। তাই রবিন্স এর সংজ্ঞাটি অনুন্নত দেশের জন্য বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সঠিক নয়।


উপসংহার :

উপরিউক্ত ত্রুটিবিচ্যুতি থাকা সত্ত্বেও অর্থনীতির একটি গ্রহণযোগ্য সংজ্ঞার ক্ষেত্রে যে অপূর্ণতা ছিল, তার কিছুটা হলেও রবিস এর সংজ্ঞার মাধ্যমে পূর্ণ হয়। এক্ষেত্রে তিনি কল্যাণ ও প্রবৃদ্ধির বিষয়টি এড়িয়ে গেলেও অনেক অর্থনীতিবিদ তাঁকে সমর্থন করেছেন। তাই তাঁর এ সংজ্ঞাটি অধিকতর বাস্তব, যুক্তিসংগত ও বিজ্ঞানসম্মত বলা যায়।


#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Now
Ok, Go it!