রস্টোর এর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির স্তর তত্ত্বটি ব্যাখ্যা কর।

admin

ভূমিকা :

কোন দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বলতে কোন নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে ঐ দেশের মোট জাতীয় উৎপাদন বৃদ্ধিকে নির্দেশ করে। সাধারণত জাতীয় আর বৃদ্ধিকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সূচক হিসেবে গণ্য করা হয়। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধি ছাড়া দেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়। তাই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধির জন্য সরকারকে যথাযণ প্রচেষ্টা গ্রহণ করতে হবে।


রস্টোর এর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির স্তর তত্ত্বটি ব্যাখ্যা কর।


ডব্লিউ ডব্লিউ, রস্টোর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির স্তরসমূহের তত্ত্ব:


অবিন্যস্তভাবে কোন দেশের পক্ষে অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধন করা সম্ভবপর নয়। তাই সুনির্দিষ্ট ও পূর্ব নির্ধারিত কতিপয় স্তর অতিক্রম করে অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধন করতে হয়। বিভিন্ন উন্নত দেশের ইতিহাসে পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, প্রতিটি দেশ কতকগুলো স্তর বা ধাপ অতিক্রম করে অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধন করেছে।


নিয়ে অধ্যাপক রস্টো প্রবর্তিত অর্থনৈতিক উন্নয়নের রগুলো বর্ণনা করা হল -


১. প্রাথমিক স্তর : অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রাথমিক পর্যায়কে প্রাথমিক বা গতানুগতিক সমাজ স্তর বলে । গতানুগতিক সমাজ বা প্রাথমিক স্তরে অধিকাংশ লোক কথিতে নিয়োজিত থাকে। এ স্তরে কৃষকগণ প্রাচীন পদ্ধতিতে কৃষিকার্য সম্পাদন করে বলে কৃষি। উৎপাদন বৃদ্ধি পায় না। তাছাড়া অধিকাংশ লোক এ স্তরে অশিক্ষিত ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন থাকে এবং বিজ্ঞান ও কারিগরি বিদ্যার প্রয়োগ ঘটে না। ফলশ্রুতিতে এ স্তরে সামাজিক বিশৃঙ্খলা ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা বিদ্যমান থাকে। তাই উন্নয়নের হার এ স্তরে ধীর ও মন্থর হয়।


বাংলাদেশে অর্থনৈতিক উন্নয়নের পূর্বশর্তগুলো কতটুকু বিদ্যমান আছে


২. প্রস্তুতি : এটি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের দ্বিতীয় র। যে স্তরে সমাজ প্রাথমিক স্তর হতে উন্নতির পথে অগ্রসর হয়ে - প্রস্তুতি পর্বে পদার্পণ করে তাকে প্রস্তুতি স্তর বলে। এ স্তরে প্রতিষ্ঠানগত পরিবর্তনের মাধ্যমে অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতিবেগ সঞ্চারিত হয়। ফলে উন্নয়নের অনুকূল পরিবেশ গড়ে ওঠে। এসময় শিক্ষার ভিত্তি প্রসারিত হয়ে বিজ্ঞান ও কারিগরি জ্ঞানের কিছুটা বিকাশ ঘটে এবং উদ্যোক্তা শ্রেণীর আবির্ভাব হয় যারা ঝুঁকি নিয়ে পুঁজি বিনিয়োগ করে থাকে। প্রস্তুতি স্তরে জাতীয় আয়ের বৃহত্তর অংশ কৃষি হতে শিল্পে বিনিয়োগ করা হয়। প্রস্তুতি পর্বে সাধারণত জাতীয় আয়ের ৫% পুঁজি গঠনে নিয়োগ করা হয়। ফলে শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠে, সঞ্চয় ও বিনিয়োগে জনগণ উৎসাহী হয়, পরিবহণ ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন সাধিত হয়ে সামাজিক বিশৃঙ্খলা ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা অনেকটা দূরীভূত হয়। সর্বোপরি অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে পরিবর্তনের সূচনা ঘটে।


অর্থনৈতিক উন্নয়নের পূর্বশর্তগুলো আলোচনা কর


৩. উঠতি স্তর : অধ্যাপক রস্টোর মতে, উঠতি স্তর অর্থনৈতিক উন্নয়নের তৃতীয় স্তর। অর্থনৈতিক উন্নয়নের যে স্তরে উন্নয়নের বিভিন্ন অসুবিধাগুলো দূরীভূত হয়ে অর্থনৈতিক উন্নয়ন একটি স্বয়ংক্রিয় রূপ ধারণ করে তাকে উঠতি স্তর বলে। এ স্তরে নতুন নতুন শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। ফলে কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়ে এবং সঞ্চয় বৃদ্ধি পেয়ে মূলধন গঠিত হয়। উঠতি স্তরে জাতীয় আয়ের ৫%-১০% ভাগ বিনিয়োগ করা হয়। উৎপাদনের ক্ষেত্রে নতুন নতুন কলাকৌশল ও প্রযুক্তি বিদ্যার প্রয়োগের ফলে এ স্তরে কৃষি ও শিল্পক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন সাধিত হয়ে উৎপাদনের পরিমাণ বাড়ে। সাধারণত কোন দেশ ২০ হতে ৩০ বছর এ স্তরে অবস্থান করে থাকে।


৪. আত্মনির্ভরশীল তর : অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ইতিহাসে | চতুর্থ স্তর হল আত্মনির্ভরশীল স্তর। যে স্তরে উৎপাদন পদ্ধতির | বিশেষ উন্নতি ঘটে নিরবচ্ছিন্নভাবে অর্থনৈতিক অগ্রগতি সাধিত কি হয়ে থাকে তাকে আত্মনির্ভরশীল স্তর বলে। এ স্তরে নতুন নতুন যায় কলকারখানা ও শিল্পপ্রতিষ্ঠান বিশেষ করে মৌলিক ও ভারি শিল্প দ্রুত গড়ে ওঠে। ফলে দেশকে পুরোপুরি বৈদেশিক সাহায্য ও ঋণের উপর নির্ভরশীল থাকতে হয় না। তাছাড়া এ স্তরে বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিবিদ্যা অব্যাহত থাকে বলে কোন দেশ নতুন নতুন কলাকৌশল প্রয়োগ করে প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী উৎপাদন করতে সক্ষম হয় এবং বৈদেশিক বাণিজ্য দ্রুত সম্প্রসারিত হয়ে দেশে অনুকূল বাণিজ্যিক ভারসাম্য সৃষ্টি হয়। এ স্তরে সাধারণত জাতীয় আয়ের শতকরা ১০ হতে ২০ ভাগ পুঁজি গঠনে নিয়োগ করা হয়। অধ্যাপক রস্টোর মতে, “কোন দেশ প্রায় ৬০ বছরের মধ্যে উঠতি স্তর হতে আত্মনির্ভরশীল স্তরে পৌঁছতে পারে।”


গ্রিনের স্বাধীনতা সম্পত্তি তত্ত্ব আলোচনা কর।


৫. অত্যধিক ভোগ স্তর : যে স্তরে মানুষের কোন অভাব থাকে না এবং মানুষ ভোগবিলাস ও সম্ভানসম্ভূতি লাভের জন্য অধিকতর আগ্রহী হয় তাকে অত্যধিক ভোগ স্তর বলে। এটি | অর্থনৈতিক উন্নয়নের সর্বশেষ স্তর। এ স্তরে অত্যধিক শিল্পপ্রতিষ্ঠান উৎপাদন কাজে নিয়োজিত থাকে বলে আরাম আয়েশ ও সুখস্বাচ্ছন্দ্যের সকল জিনিস এ স্তরে পাওয়া যায়। এ স্তরে প্রত্যেক ব দেশের মাথাপিছু প্রকৃত আয় বহুল পরিমাণে বৃদ্ধি পায়। বর্তমানে  মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, জার্মানি, কানাডা, যুক্তরাজ্য প্রভৃতি দেশ র অর্থনীতির অত্যধিক ভোগ স্তরে অবস্থান করছে।


পরিশেষে বলা যায়, বিভিন্ন প্রক্রিয়ার উপরে উল্লিখিত স্তরগুলোর ১ মাধ্যমে কোন দেশ অর্থনৈতিক উন্নয়নের সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছতে পারে।


রস্টোর স্তর তত্ত্বের সমালোচনা :


সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অর্থনীতিবিদ রস্টোর স্তর তত্ত্ব বিভিন্ন মহলে প্রশংসিত হয়েছে। কিন্তু অর্থনৈতিক উন্নয়নের ইতিহাসকে রস্টো  পাঁচটি ভাগে ভাগ করে এগুলো অর্থনৈতিক উন্নয়নে জন্ম মৃত্যুর মত অপরিহার্য বলে মন্তব্য করেছেন। ফলে রস্টোর স্তর তত্ত্ব অর্থনীতিবিদদের দ্বারা নানাভাবে সমালোচিত হয়েছে। রস্টোর স্তর তত্ত্বের উল্লেখযোগ্য সমালোচনা নিয়ে উপস্থাপন করা হল :


১. স্তরের ঘনিষ্ঠতা  : একটি দীর্ঘকালীন প্রক্রিয়া ও  প্রবাহমান ধারা হল অর্থনৈতিক উন্নয়ন। কিন্তু স্তর তত্ত্বে অর্থনৈতিক বিকাশের স্তরগুলো একে অপরের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে - জড়িত। ফলে উন্নয়নের স্তরগুলোকে পরস্পর হতে পৃথক করা যায় না। তাছাড়া Prof. Gerschenkron and Prof. Habakuk এর মতে, রস্টোর নির্দেশিত কোন স্তরের বৈশিষ্ট্য অপরাপর স্তরেও বিদ্যমান। তাই অর্থনীতিবিদ রস্টোর স্তর তত্ত্বে । অর্থনৈতিক উন্নয়নে যে পাঁচটি স্তর নির্দেশ করেছে তা পুরোপুরি গ্রহণযোগ্য নয়।


অধ্যাপক এল রবিন্স অর্থনীতির সংজ্ঞাটি ব্যাখ্যা কর


২. প্রকৃত সময়ের আগে উঠতি ভর অতিক্রম : অধ্যাপক রস্টোর মতে, উঠতি স্তর হতে আত্মনির্ভরশীল স্তরে উঠতে কোন দেশের ৬০ বছর সময় লাগে। কিন্তু রস্টোর এ ধারণা ভুল  প্রমাণিত হয়েছে। কেননা অনেক সমাজতান্ত্রিক দেশ অল্প সময়ের মধ্যে এ স্তর অতিক্রম করেছে। যেমন- অনুন্নত ও কৃষিনির্ভর একটি দেশ রাশিয়া ১৯২০ সালের পর মাত্র ৩৫ বছরে উঠতি অতিক্রম করতে সক্ষম হয়েছিল।


৩. অত্যধিক ভোগ স্তর সমানুপাতিক নয়: চারটি স্তর পার হয়ে অত্যধিক ভোগ স্তরে উপনীত হতে হয়। রস্টোর এ ধারণাটি সকল অবস্থায় প্রযোজ্য নয়। কারণ কোন রাষ্ট্র একটি বিশেষ স্তর অতিক্রম করে অন্য স্তরে উপনীত হতে পারে। যেমন- অস্ট্রেলিয়া এবং কানাডা আত্মনির্ভরশীল স্তরে পৌঁছার পূর্বেই অত্যধিক ভোগ স্তরে পৌঁছেছিল।


ব্যষ্টিক ও সামষ্টিক অর্থনীতির মধ্যে পার্থক্যসমূহ উল্লেখ কর


৪. কল্যাণকর রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা : অধ্যাপক রস্টো বলেছেন, অত্যধিক ভোগ স্তরে পৌঁছানোর পর কল্যাণকর রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা যায়। কিন্তু পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে অত্যধিক ভোগ স্তরে পৌঁছার পরও সকল শ্রেণীর নাগরিক অনু, বস্ত্র, বাসস্থানের সুযোগ সুবিধা লাভ করতে পারে না। অন্যদিকে, সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির দেশগুলোতে অত্যধিক ভোগন্তরের অনেক নিচে থাকা সত্ত্বেও সকল শ্রেণীর জনগণ সমান সুযোগ সুবিধা ভোগ করতে পারে। তাই নি রস্টোর কল্যাণকর রাষ্ট্রের এ ধারণাটিও পুরোপুরি সঠিক নয়।


৫. ঐতিহ্যবাহী দেশের উন্নয়নে প্রযোজ্য নয় : যেসব দেশ ইতোমধ্যে উন্নতি লাভ করছে সেসব দেশের উন্নয়নে রস্টোর স্তর তত্ত্ব প্রযোজ্য হয় না। যেমন- যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, নিউজল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়া ঐতিহাসিক দেশ হিসেবে ব্রিটেন হতে স্বাধীনতা লাভ করে। ফলে এসব দেশের উন্নয়নে রস্টোর স্তর তত্ত্ব প্রযোজ্য নয়।


উপসংহার: পরিশেষে উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে আমরা বলতে পারি যে, অধ্যাপক রস্টোর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির স্তরসমূহের কতিপয় সমালোচনা থাকলেও বর্তমান যুগেও অনেক অর্থনীতিবিদের কাছে এটি গ্রহণযোগ্য প্রতিপন্ন হচ্ছে। তাই বলা যায়, অধ্যাপক রস্টোর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের তত্ত্বটি একটি যুগান্তকারী সৃষ্টি।


#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Now
Ok, Go it!