রেনেসাঁ বলতে কী বুঝ? রেনেসাঁর প্রধান প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো বর্ণনা কর।

admin

ভূমিকা :

রেনেসাঁ বা পুনর্জাগরণ হলো একটি সাংস্কৃতিক আন্দোলন যার মাধ্যমে সমগ্র বিশ্বে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত হয়। রেনেসাঁর মাধ্যমে সভ্যতার মধ্যযুগের পরিসমাপ্তি এবং আধুনিক যুগের সূচনা হয়। এটি মানুষের পানির ব্যক্তিত্ব ও বিবেককে পুনর্জাগরিত করার সংগ্রাম হিসেবে আবির্ভূত হয়। এ আন্দোলনের মাধ্যমে মানুষ মধ্যযুগের ধর্মীয় আর বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে এসে নবযুগের বা আধুনিক যুগের সূচনা করে। রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসে এ আধুনিক যুগকে স্বর্ণযুগ পারি হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। ষোড়শ শতাব্দীতে মূলত রেনেসাঁ আন্দোলনের মাধ্যমেই আধুনিক যুগের আবির্ভাব ঘটে। এ আন্দোলনের মাধ্যমে আধুনিক যুগের দর্শন ও চিন্তাচেতনায় এক যুগান্তকারী পরিবর্তন সাধিত হয় ।


রেনেসাঁ বলতে কী বুঝ? রেনেসাঁর প্রধান প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো বর্ণনা কর।


বুৎপত্তিগত অর্থে রেনেসাঁ :

ইংরেজি Renaissance শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে ফরাসি শব্দ 'Renaissant' থেকে। যার অর্থ হচ্ছে নবজাগরণ বা পুনর্জাগরণ। ব্যাপক অর্থে মানুষের ব্যক্তিত্ব, বুদ্ধি, চিন্তা ও বিবেকের বিকাশকে রেনেসাঁ বলা যায়। বাংলায় নবজাগতি বা আন্দোলন অর্থেও রেনেসাঁ শব্দটি ব্যবহৃত হয়।


রেনেসাঁ কী :

মূলত রেনেসাঁ হলো একটি বিপ্লব, যার মাধ্যমে একটি সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটে যা প্রত্যাশিত অবস্থায় রূপলাভ করে। আধুনিক যুগের সূচনায় রেনেসাঁ আন্দোলনটি ইউরোপে সংঘটিত হলেও এর প্রভাব বিশ্বব্যাপী বিস্তৃতি লাভ করে। এই আন্দোলনকে একটি সাংস্কৃতিক আন্দোলনও বলা যেতে পারে। রেনেসাঁর আভিধানিক অর্থ হালা শিল্প, বিজ্ঞান, কলা ও সাহিত্যের বিকাশ সাধন। মধ্যযুগের সংস্কৃতির জগদ্দল পাথর ও সংকীর্ণতা থেকে মানুষ নিজেদেরকে স্বাধীন বা যুক্ত করে আলোর নবদিগন্তে পদার্পণ করে। মূলত একেই বলা হয় রেনেসাঁ বা নবজাগরণ।


প্রামাণ্য সংজ্ঞা :

বিভিন্ন চিন্তাবিদ বিভিন্নভাবে রেনেসাঁর সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। নিম্নে তাদের প্রদত্ত কয়েকটি সংজ্ঞা উল্লেখ করা হলো :


ঐতিহাসিক ডেভিস (Davis) এর মতে, "দুঃসাহসিক চিন্তাচেতনা, স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা প্রভৃতি যে গুনগুলো মধ্যযুগে শৃঙ্খলাবদ্ধ হয়েছিল সেগুলোর পুনর্জীবনই হলো রেনেসাঁ।” (The world renaissance signified  the  rebirth of the freedom loving adventurous thought of men, which during the middle ages has been feltered and imprisoned.)


আরো পড়ুন: আধুনিক যুগ বলতে কী বুঝ? আধুনিক যুগের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বর্ণনা কর।


 মেয়ার্স (Mayers) তাঁর Medieval and Modern History' গ্রন্থে রেনেসাঁর সংজ্ঞায় উল্লেখ করেছেন, "সনাতন জীবনযাত্রা ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল হতে এক নবজগতে পুনঃপ্রবেশ, যেখানে ধর্মনিরপেক্ষতা, অনুসন্ধানী মানসিকতা ও ব্যক্তির আত্মপ্রত্যয়ের গতিপ্রকৃতি সর্বোচ্চ পর্যায়ে থাকে তাকেই আমরা রেনেসাঁ বা পুনর্জাগরণ বলে আখ্যায়িত করতে  পারি ।" (We may define the Renaissance as there entrance into the world of the peculiar. inquiring selfreliant spirit which characterised the life and culture of classical antiguity.)" অর্থাৎ, সনাতন জীবনযাত্রা ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল হতে এক নবজগতে পুনঃপ্রবেশ, যেখানে ধর্মনিরপেক্ষতা, অনুসন্ধানী  মানসিকতা ও ব্যক্তির আত্মপ্রত্যয়ের গতিপ্রকৃতি সর্বোচ্চ পর্যায়ে থাকে তাকেই আমরা রেনেসাঁ বা পুনর্জাগরণ  বলে আখ্যায়িত করতে পারি।


সুইজারল্যান্ডের লেখক বুদ্ধহার্টের মতে, “মানুষের ইহজাগতিক বিষয়ের প্রতি সচেতন হওয়ার নামই হলো রেনেসাঁ।" ঐতিহাসিক ইরগাং (Ergang) এর মতে, ১৩০০-১৬০০ সাল পর্যন্ত সময়ের মধ্যে ইউরোপের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল অর্থাৎ শিল্পকলা, সাহিত্য, দর্শন, বিজ্ঞান, অর্থনীতি ও মনোচর্চায় যে পরিবর্তন সাধিত হয়েছিল তাই রেনেসাঁ।”


অক্সফোর্ড অ্যাডভান্সড ডিকশনারির ভাষ্যমতে, রেনেসাঁ হলো "The period in Europe during the 14th, 15th and 16th centuries when people became interested in the ideas and culture of ancient Greece and Rome and used these influence in their own art, literature etc.


সুতরাং বলা যায় যে, রেনেসা হলো এমন এক বিপ্লব যার মাধ্যমে ইউরোপীয় ভাবধারা ও চিন্তাচেতনায় ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে এবং বিশ্বের সকল প্রান্তে এর প্রভাব পড়ে।


আরো পড়ুন: আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তার বৈশিষ্ট্যগুলো কী কী? আলোচনা কর।


রেনেসাঁর প্রধান প্রধান বৈশিষ্ট্য :

রেনেসাঁ আন্দোলনের বেশ কিছু স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য রয়েছে। নিম্নে রেনেসাঁর প্রধান হ বশিষ্ট্যগুলো সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :


১. নবযুগের সূচনা : রেনেসা একটি ব্যাপকভিত্তিক পরিবর্তনের নাম। মধ্যযুগে প্রাকৃতিক অপেক্ষা অতিপ্রাকৃতিক ধারণাসমূহ মানুষের চিন্তাকে অধিক প্রভাবিত করত। কিন্তু সপ্তদশ শতাব্দীতে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি বিকাশ লাভ করার ফলে অতিপ্রাকৃতিক ধারণাসমূহের পরিবর্তন হয় এবং মানুষের মধ্যে বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন দেখতে পাওয়া যায়।


২. সামাজিক চিন্তা-চেতনার ফসল : আধুনিক যুগের সূচনায় সৃষ্ট আন্দোলন রেনেসাঁ, তৎকালীন সমগ্র সামাজিক চিন্তাচেতনার ফসল। রেনেসাঁর প্রভাবে সমাজের সকল ক্ষেত্রেই ধর্ম, জ্ঞানবিজ্ঞান, শিল্প, সাহিত্য, ব্যবসায়-বাণিজ্য ইত্যাদি নতুন চিন্তার উন্মেষ ঘটে । অতীতকে ভুলে গিয়ে মানুষ নিজেকে নতুন করে গড়ে তোলার সাথে নিয়োজিত হয়।


৩. শিল্প ও চিত্রকলার বিকাশ : রেনেসাঁর অন্যতম প্রধান একটি বৈশিষ্ট্য হলো শিল্প ও চিত্রকলার বিকাশ। এ সময়ের  শিল্প ও চিত্রকলা মধ্যযুগের ধর্মাশ্রিত ও কাল্পনিক বিষয়ের আবর্ত থেকে বের হয়ে প্রেম, সৌন্দর্য, স্বাধীনতা প্রভৃতিকে মূল উপজীব্য হিসেবে গ্রহণ করে।


আরো পড়ুন: রাষ্ট্রচিন্তা কী? রাষ্ট্রচিন্তার উদ্ভব ও ক্রমবিকাশের ইতিহাস পর্যালোচনা কর।


৪. ধর্ম ও নৈতিকতাবোধের গুরুত্ব হ্রাস : রেনেসাঁর অপর একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো ধর্ম ও নৈতিকতা যেমন  অস্বীকার করেনি, বোধের গুরুত্ব হ্রাস, রেনেসা ধর্ম ও নৈতিকতাকে তেমনি এটিকেই একমাত্র জীবনসর্বস্ব করেও তোলেনি ধর্মীয় প্রভাব থেকে ব্যক্তিকে মুক্ত করতে রেনেসাঁ বা নবজাগরণ বিশেষভাবে সাহায্য করে।


৫. রাজনৈতিক অগ্রগতি সাধন : রেনেসাঁর সবচেয়ে বড় অবদান হলো মানবজাতির রাজনৈতিক অগ্রগতি সাধনে গণতান্ত্রিক চেতনাবোধের উন্মেষ ঘটানো। মধ্যযুগের স্বৈরতান্ত্রিকতা থেকে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, যেখানে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ বিকাশ ঘটে মানুষ গির্জার অন্যায় প্রভাব থেকে পরিত্রাণ পেয়ে নিজেদের শাসন নিজেরা করার উপায় ও পদ্ধতি প্রবর্তন  করে। সংক্ষেপে বলতে গেলে গণতান্ত্রিক চেতনাবোধ, ব্যক্তিস্বাধীনতা, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও জাতীয় রাষ্ট্রের আইনে রাজনৈতিক মৌলিক ধারণা প্রণয়নই হলো রেনেসাঁর ফলশ্রুতি।


৬. বিজ্ঞানের নব নব আবিষ্কার : পনেরো শতাব্দীর শেষের দিকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির নব নব আবিষ্কার ও উদ্ধাবন মানুষের কর্মময় জীবনে যে পরিবর্তন ও অগ্রগতি সাধন করে তা মানুষের জীবন ও জগতের সাথে তার সম্পর্কের দিগস্তকে দারুণভাবে প্রভাবিত করে। নানা দেশ ও জনপদের আবির উৎপাদন ক্ষেত্রে মাত্রাবৈপ্লবিক পরিবর্তন, বিনিয়োগ বৃদ্ধি করে। সামগ্রিকভাবে এটি মানুষের জীবন, জীবনবোধ ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে অনেক পরিবর্তন সাধিত হয়।


৭. সংগ্রাম ও অভিযানের প্রেরণা দান : মধ্যযুগের কুসংস্কার, স্থবিরতা, দল-বদল, দ্বন্দ্ব-সংঘাতের রাহুমুক্ত হওয়ার জন্য মানুষ তাদের ন্যায্য অধিকার ও স্বাধিকার প্রাপ্তিকল্পে সংগ্রাম ও অভিযান পরিচালনা করে। এতে যেমন যোগাযে ক্ষেত্রে সাধিত হয় অগ্রগতি, তেমনি প্রতিষ্ঠিত হয় সম্পর্কের নীতি ও ভিত।


৮. মূল্যবোধের পুনরাবির্ভাব : রেনেসাঁ মানুষের মূল্যবোধকে শানিত ও প্রসারিত করে। মানুষ তার জীবন ও জগৎকে খুবই নিকটবর্তী ভাবতে ও উপলব্ধি করতে শিখে। ধর্মের শাসন ও শোষণ থেকে মুক্তি পেয়ে স্বাধীনতা লাভ করে। মুক্ত মনের মুক্তচিন্তার দিগন্ত হয় প্রসারিত।


আরো পড়ুন: রাষ্ট্রদর্শনের ইতিহাসে আন্দোলনের পরিষদ তাৎপর্য ব্যাখ্যা কর।


৯. ব্যাপকভিত্তিক পরিবর্তনের সূচনা : রেনেসাঁর একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো ব্যাপকভিত্তিক পরিবর্তনের সূচনা। মধ্যযুগের ধর্মীয় সংকীর্ণতা থেকে রনেসাঁ মানবজীবনকে টেনে এনে এক মহাদিগন্তে বিচরণের অবকাশ সৃষ্টি করে। এতে মানুষের বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে। মানুষের অতিপ্রাকৃতিক চিন্তাচেতনা, অবসান ঘটে।


১০. মানবতাবাদ : রেনেসাঁর অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল মানবতাবাদ। এ আন্দোলনে মানবপ্রেম, দেশপ্রেম, প্রাকৃতিক বিষয়ের প্রতি অনুরাগ, এমনকি স্বাধীনতা ও ঐক্যবদ্ধ মানব সভ্যতার কথাও প্রতিফলিত হয়েছিল। এ সময় মানবতাবাদের প্রবক্তাগণ ঈশ্বর চেতনার চেয়ে মানব চেতনায় বা মানবতাবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে সাহিত্যচর্চায় বা সাহিত্য রচনায় বেশি আগ্রহী হন।


১১. ভৌগোলিক আবিষ্কার : রেনেসাঁর মাধ্যমে মানুষ ভৌগোলিক আবিষ্কারের অনুপ্রেরণা লাভ করে। এই সময় সামাজিক জীবনযাত্রার পরিবর্তনের সাথে সাথে মানুষের মধ্যে অজানাকে জানার আগ্রহ জন্মেছিল। এই আগ্রহের কারণেই তখন মানুষ বিভিন্ন দ্বীপ আবিষ্কার করে। তাই ভৌগোলিক আবিষ্কার রেনেসাঁ যুগের বৈশিষ্ট্য বহন করে।


উপসংহার :

উপর্যুক্ত আলোচনার পরিশেষে বলা যায় যে, রেনেসাঁ সমাজব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনের মাধ্যমে এর অতীতের ভালো বা মঙ্গলজনক ঐতিহ্যকে অস্বীকার করে নয় বরং সেটাকে সামনে রেখে আরো সুন্দরের পথে গমন করা। তাই বলা যায়, রেনেসাঁর অবদান ব্যাপকভিত্তিক ও বহুমাত্রিক। মানুষের জীবন ব্যবস্থাকে আমূল পরিবর্তন সাধন করে কলি আধুনিক যুগের সূত্রপাত ঘটায়।


#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Now
Ok, Go it!