রাষ্ট্রচিন্তা কী? রাষ্ট্রচিন্তার উদ্ভব ও ক্রমবিকাশের ইতিহাস পর্যালোচনা কর।

admin

ভূমিকা : মানুষ সামাজিক জীব। সমাজের প্রতিটি মানুষ সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের সাথে। থেকে জীবনাচরণ পরিচালনা করে। আর মানুষ যে প্রতিষ্ঠানের স্বার্থে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত সেটি হলো রাষ্ট্র। রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সম্পর্কে যে চিন্তাচেতনা ও ধ্যানধারণা তাই হলো রাষ্ট্রচিন্তা বা রাষ্ট্রদর্শন। আর এই রাষ্ট্রচিন্তার উৎপত্তি ও বিকম সেই প্রাচীনকাল থেকে । কালের বিবর্তনে রাষ্ট্রের সম্পর্কে চিন্তার ক্রমান্বয়ে পরিবর্তন সূচিত হয়েছে।


রাষ্ট্রচিন্তা কী? রাষ্ট্রচিন্তার উদ্ভব ও ক্রমবিকাশের ইতিহাস পর্যালোচনা কর।


রাষ্ট্রচিন্তা কী :

সমাজ ও রাষ্ট্রের উন্নয়নমূলক গবেষণা হলো রাষ্ট্রচিন্তা। সাধারণভাবে বলা যায়, রাষ্ট্রবিষয়ক চিন্ত অভিব্যক্তি হলো রাষ্ট্রচিন্তা। শব্দগত বা শাব্দিক অর্থে রাষ্ট্রচিন্তা বলতে রাষ্ট্রীয় সংগঠনের বিভিন্ন দিক ও বিভাগ নিয়ে সূ আলোচনা যা কতিপয় মানুষের মস্তিষ্ক ও হৃদয়ের মাধ্যমে তাদের মুখ ও হস্তের দ্বারা প্রকাশিত প্রত্যয়কে বুঝায়। তাই ফ যায়, বিভিন্ন মনীষী বিভিন্ন সময়ে সমাজ, রাষ্ট্র, রাষ্ট্রের প্রকৃতি, উদ্দেশ্য ও কার্যাবলি সম্পর্কে যে মতবাদ প্রদান করেছেন। তাই হলো রাষ্ট্রদর্শন বা রাষ্ট্রচিন্তা। অর্থাৎ রাষ্ট্রদর্শন রাষ্ট্রের কাঠামো ও শাসনব্যবস্থাকে নির্দেশ করে।



প্রামাণ্য সংজ্ঞা : রাষ্ট্রচিন্তা সম্পর্কে এখনো পর্যন্ত একক ও সর্বজনস্বীকৃত কোনো সংজ্ঞা প্রদান করা সম্ভব হয়নি। এ সম্পর্কে বিভিন্ন রাষ্ট্রচিন্তাবিদ তাদের স্ব-স্ব দৃষ্টিকোণ থেকে সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। নিম্নে তাদের প্রদত্ত কয়েকটি সংজ্ঞা প্রদান করা হলো :


অধ্যাপক ওয়েপার বলেন, রাষ্ট্রদর্শন বলতে বুঝায় সেই দর্শন যা রাষ্ট্রের গঠন, প্রকৃতি ও উদ্দেশ্য নিয়ে আলোচন করে।


অধ্যাপক আর্নেস্ট বার্কার এর মতে, “রাষ্ট্রীয় মতবাদ বিভিন্ন চিন্তাবিদদের চিন্তাচেতনা ও গবেষণার ফলস্বর বহুলাংশেই এটি তাদের সমসাময়িক কালের বাস্তব ঘটনা বলা থেকে দূরে থাকে, কিন্তু রাষ্ট্রদর্শন একটি যুগের বাস্ত ম্যা ঘটনাবলির স্থায়ী দর্শন। "


অধ্যাপক ফিলিপ ডোয়েল এর মতে, “রাষ্ট্রচিন্তার বিষয়বস্তু বিশেষত তিনটি ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। যথা : মানব প্রকৃতি ও তার কার্যকলাপ, জীবনের সামগ্রিক অনুভূতির দরুন পৃথিবীর অপরাপর বিষয়ের সাথে মানুষের একাত্মতা এবং সামাজিক ও সমাজের পারস্পরিক সম্পর্ক।”


সুতরাং বলা যায়, রাষ্ট্রদর্শন বা রাষ্ট্রচিন্তা রাষ্ট্রের সামগ্রিক চিন্তাভাবনা ও রাষ্ট্রপরিচালনার বিষয় নিয়ে আলোচনা করে। সমাজবদ্ধ মানুষের প্রকৃতি, তার রাজনৈতিক আচরণ ও কার্যাবলি, আচরণের নৈতিক দিক, ব্যক্তির সাথে সমাজ ও রাষ্ট্রের পারস্পরিক সম্পর্ক, রাষ্ট্রের গঠন, কার্যাবলি এবং মানবজীবনের সার্বিক দিকের উপর এগুলোর প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া ইত্যাদি সম্পর্কে বিভিন্ন যুগের মনীষীদের চিন্তাভাবনাগুলোকে সমষ্টিগতভাবে রাষ্ট্রচিন্তা বলে আখ্যায়িত করা হয়।


রাষ্ট্রচিন্তার উদ্ভব ও বিকাশের ইতিহাস :

বর্তমানে আমরা রাষ্ট্রচিন্তার যে অবস্থা দেখতে পাই তা একদিনে তৈরি হয়নি। এটি বিভিন্ন দার্শনিকদের দীর্ঘদিনের চিন্তার ফসল। সমগ্র রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসকে প্রধানত দুই ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন- প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তা ও পাশ্চাত্যের রাষ্ট্রচিন্তা। পাশ্চাত্যের রাষ্ট্রচিন্তাকে আবার চার ভাগে ভাগ করা হয়েছে। যেমন-প্রাচীন যুগের রাষ্ট্রচিন্তা, মধ্যযুগের রাষ্ট্রচিন্তা, আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তা ও সাম্প্রতিককালের রাষ্ট্রচিন্তা। নিম্নে রাষ্ট্রচিম্বয় উদ্ভব ও বিকাশের ইতিহাস সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :


১. প্রাচীন যুগের রাষ্ট্রচিন্তা : পাশ্চাত্য রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসে প্রাচীন যুগ একটি উল্লেখযোগ্য স্থান দখল করে আছে। খ্রিষ্টপূর্ব ৪৬৯ অব্দ হতে খ্রিষ্টপূর্ব ২৬ অব্দ পর্যন্ত প্রাচীন যুগের পরিব্যাপ্তি। এ যুগের রাষ্ট্রচিন্তার মধ্যে গ্রিক রাষ্ট্রদর্শন সবচেত গুরুত্বপূর্ণ। তৎকালে গ্রিক চিন্তাবিদগণ তাদের রাজনৈতিক চিন্তাচেতনা দিয়ে অন্যান্যদেরকে প্রভাবিত করেছেন। তানো জ্ঞানবিজ্ঞানে অর্থাৎ গ্রিক পণ্ডিতদের আবির্ভাবের ফলে মানবজাতির জ্ঞানবিজ্ঞান সমৃদ্ধ হয়েছে। যার ফলে পরবর্তীতে ব্যাপক প্রসার লাভ করে। গ্রিক পণ্ডিতদের মধ্যে যেসব চিন্তাবিদ তাদের চিন্তাচেতনার দ্বারা গ্রিক রাষ্ট্রচিন্তাকে সমৃদ্ধ  করেছেন তাদের মধ্যে সক্রেটিস, প্লেটো, এরিস্টটল অন্যতম। অধ্যাপক আর্নেস্ট বার্কার বলেছেন, গ্রিকদের মাধ্যমেই রাষ্ট্রচিন্তার সূচনা ঘটে এবং সমৃদ্ধি লাভ করে।” এ যুগের রাষ্ট্রচিন্তার প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল নৈতিকতা ও যুক্তিবাদের সমন্বয়। তবে গ্রিক দার্শনিকদের প্রচারিত মতবাদ ছাড়াও প্রাচীন যুগে আরো কয়েকটি চিন্তাধারার স্রোত প্রবাহমান ছিল। এসব চিন্তাধারার মধ্যে ছিল সোফিস্টগণ প্রচারিত মতবাদ, স্টোয়িকবাদ, রোমান চিন্তাবিদ পলিবিয়াস, সিসেরো, সেনেকা প্রমুখের দর্শন ইত্যাদি। তবে উৎকর্ষ ও চিন্তাধারার মৌলিকত্বের দিক থেকে গ্রিক দর্শনই ছিল প্রভাবশালী যা পরবর্তী যুগের রাষ্ট্রচিন্তা বিকাশে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে।


২. মধ্যযুগের রাষ্ট্রচিন্তা : গ্রিক নগর রাষ্ট্রের পতনকাল হতে শুরু করে রোমান আইনের প্রসার ছাড়া আধুনিক জাতীয় রাষ্ট্রের উত্থান কাল পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় দর্শন একান্তভাবে রাজনীতি বিবর্জিত ছিল। ইতিহাসে এটাকেই মধ্যযুগ বলে। সাধারণত ষষ্ঠ শতাব্দী হতে শুরু করে পঞ্চদশ শতাব্দী পর্যন্ত মধ্যযুগের সময়সীমা। রাষ্ট্রতত্ত্বের অনুপস্থিতি, স্টোয়িকাদের প্রভাব, গির্জা ও রাষ্ট্রের মতবিরোধ, বিশ্বজনীনতাবাদ, সামন্তবাদ, পোপতন্ত্র এবং ধর্মীয় আধিপত্য প্রভৃতি ছিল মধ্যযুগের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। সেন্ট অগাস্টিন, সেন্ট টমাস একুইনাস, এলিখিয়েরি দান্তে এবং মার্সিলিও অব পাদুয়া ছিলেন মধ্যযুগের চিন্তাবিদ।

W.A. Dunning বলেছেন, "The middle age was unpolitical, aspirations and ideals centred about the form and content of religious belief."


৩. আধুনিক যুগের রাষ্ট্রচিন্তা : পঞ্চদশ শতাব্দীতে পরিষদ আন্দোলনের ব্যর্থতার মধ্য দিয়ে আধুনিক যুগের সূত্রপাত। আধুনিক শব্দটির ইংরেজি প্রতিশব্দ 'Modern' যার উদ্ভব হয়েছে Mode থেকে। Mode শব্দের অর্থ পদ্ধতি বা প্রক্রিয়া। অর্থাৎ, যে পদ্ধতি সনাতন পদ্ধতি থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র এবং যা বর্তমানের সাথে সংগতিপূর্ণ তাকে আধুনিক যুগ বলে। আধুনিক যুগের চিন্তাচেতনা মধ্যযুগীয় চিন্তাচেতনা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। ম্যাকিয়াভেলি আধুনিক রাষ্ট্রদর্শনের এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেন। তিনি তাঁর 'The Prince' গ্রন্থে আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা সম্পর্কে আলোচনা করেন। তিনি তাঁর রচনাতে রাষ্ট্রীয় আইন ও ঐশ্বরিক আইন যে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র তা স্পষ্ট করে বলেন। আধুনিক যুগে ধর্ম রাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ম্যাকিয়াভেলি রাষ্ট্রকে সার্বভৌম শক্তির প্রতীক বলে মনে করেন। তার পূর্বে রাষ্ট্র সম্পর্কে এত গভীরভাবে কেউ ভাবেননি । এজন্য তাকে আধুনিক রাষ্ট্রদর্শনের জনক বলা হয়।


গির্জা ও রাষ্ট্রের সীমিত শাসন প্রবর্তনের ক্ষেত্রে পরিষদ আন্দোলন যে অসামান্য অগ্রগতি অর্জন করে ষোড়শ শতাব্দীর প্রারম্ভে ইউরোপের বিভিন্ন রাষ্ট্রের তীব্র রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া তাকে বন্যার স্রোতের ন্যায় ভাসিয়ে নিয়ে যায়। ফলে রাষ্ট্রের উপর গির্জার প্রভাব সম্পূর্ণভাবে হ্রাস পায়। রাষ্ট্র মূলত ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে পরিণত হয়। প্রাচীন গ্রিক ও রোমান সভ্যতার যেসব ঐতিহ্য ও অবদান মধ্যযুগীয় বিশ্বাস ও সংস্কৃতির সাথে সংগতিপূর্ণ নয় বলে উপেক্ষিত ও অনাদৃত থেকে যায়, ষোড়শ শতাব্দীর নতুন দৃষ্টিভঙ্গির সাথে সেগুলোর চমৎকার সাদৃশ্য পরিলক্ষিত হওয়ায় সেগুলোকে পুনরুদ্ধার করা হয় এবং তার ফলে মানুষ নতুন দৃষ্টিভঙ্গি ও ধ্যানধারণায় বিশেষভাবে প্রভাবান্বিত হয়। মূলত এটিকে ষোড়শ শতাব্দীর রেনেসাঁ বা পুনর্জাগরণ বলে অভিহিত করা হয়। আধুনিক যুগের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো গণতন্ত্র, স্বাধীনতা, সাম্য, সামাজিক চুক্তি, ধর্ম নিরপেক্ষতাবাদ এবং লোকায়তবাদ। তবে আধুনিক যুগের একটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো জার্মান ভাববাদের উত্থান। ব্রিটিশ রাষ্ট্রদর্শন ও জার্মান ভাববাদী দর্শনের প্রভাবে আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তায় আরো কতিপয় বিশেষ বৈশিষ্ট্য যুক্ত হয়। এগুলো হলো উপযোগবাদ, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ, উদারতাবাদ, কাল্পনিক সমাজবাদ, পুঁজিবাদ প্রভৃতি। আধুনিক যুগে যেসব দার্শনিক তাদের চিন্তাচেতনা দ্বারা আধুনিক যুগকে প্রভাবিত করেছেন তাদের মধ্যে ম্যাকিয়াভেলি, টমাস হব, জন লক, রুশো, মন্টেস্কু, হেগেন, গ্রিন, কান্ট, বেন্থাম, জে. এস. মিল, কার্ল মার্কস অন্যতম।


উপসংহার :

উপর্যুক্ত আলোচনার পরিশেষে বলা যায় যে, কালের বিবর্তনের সাথে সাথে যুগে যুগে রাষ্ট্রচিন্তার উত্তর ও ক্রমবিকাশ ঘটেছে। প্রাচীনকাল থেকে শুরু হয়ে মধ্যযুগ পেরিয়ে আধুনিক যুগে এসে রাষ্ট্রচিন্তা পরিপূর্ণ রূপ লাভ করেছে। মার বর্তমানে রাষ্ট্রচিন্তার যে বিশাল অবয়ব লক্ষ করা যায় তা অনেকটা সময় পার হয়ে বর্তমান অবস্থায় উপনীত হয়েছে। যার এর পিছনে রয়েছে বহু মনীষীর ত্যাগের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস।



#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Now
Ok, Go it!