বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে রাষ্ট্র ভূমিকা আলোচনা কর।

admin

ভূমিকা :

সাধারণভাবে অর্থনৈতিক উন্নয়ন বলতে দেশের জাতীয় আয়, মাথাপিছু আয়, উৎপাদন ক্ষমতা ও জীবনযাত্রার মানের ক্রমোন্নতির এক দীর্ঘকালব্যাপী প্রক্রিয়াকে বুঝায়। বিশ্বের প্রতিটি দেশই তার অর্থনীতির উন্নতি সাধন করতে চায়। এ লক্ষ্যে এসব দেশ বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করে। কিন্তু এ উন্নত দেশগুলো তাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্যে যেসব ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করে, উন্নয়নশীল দেশগুলোর পক্ষে সেভাবে কর্মসূচি গ্রহণ করা সম্ভব হয় না। উন্নয়নশীল দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন অনেকটা উন্নত রাষ্ট্রগুলোর অর্থনৈতিক ও অন্যান্য সাহায্য সহযোগিতার উপর নির্ভরশীল। উৎপন্ন সামগ্রীর উৎকর্ষ ও পরিমাণ বৃদ্ধির জন্য দেশবাসীর নিরবচ্ছিন্ন পরিশ্রম, বৈজ্ঞানিক জ্ঞান, পুঁজি গঠন প্রভৃতি রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতিকে ত্বরান্বিত করে।


বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে রাষ্ট্র ভূমিকা আলোচনা কর।


বাংলাদেশের ন্যায় উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক উন্নয়নে রাষ্ট্রের ভূমিকা :

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে রাষ্ট্র নিম্নোক্তভাবে ভূমিকা পালন করতে পারে।


১. মূলধন সংগ্রহ : অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য বিপুল পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন। অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে সরকারকে যথোপযুক্ত আর্থিক নীতি ও করনীতি নির্ধারণ করে সঞ্চয় ও বিনিয়োগের পরিমাণ বৃদ্ধি করতে হয়। তবে উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলোতে অভ্যন্তরীণ পুঁজিতে ঘাটতি দেখা দেয় বলে বৈদেশিক পুঁজি গ্রহণ করতে হয়। আর এ পুঁজি অপর রাষ্ট্র থেকে সংগ্রহের ব্যবস্থা করতে হয় সরকারকেই।


বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের উপায়সমূহ কী কী


২. ভারি শিল্প ও কুটিরশিল্পের ভূমিকা : বাংলাদেশে ভারি শিল্প পশ্চাৎমুখী, অথচ কুটিরশিল্প এখানে শিল্পের ভিত্তি। এ জন্য বাংলাদেশে আমদানি হ্রাস ও রপ্তানিবর্ধক ভারি শিল্প স্থাপন করতে। হবে। পাশাপাশি কুটিরশিল্পকে গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে দিতে হবে।


৩. অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবকাঠামো গঠন : বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবকাঠামো সর্বপ্রথম গড়ে তোলা প্রয়োজন। কিন্তু অত্যাবশ্যকীয় আর্থসামাজিক অবকাঠামো এদেশে পর্যাপ্ত পরিমাণে নেই। বাংলাদেশ সরকার রাস্তাঘাট নির্মাণ, বাঁধ নির্মাণ, সেতু ও কালভার্ট নির্মাণ, স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল স্থাপন, যোগাযোগ ও পরিবহণ ব্যবস্থার সম্প্রসারণ ও আধুনিকীকরণ, পানি ও বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিতকরণ ইত্যাদির মাধ্যমে আর্থসামাজিক অবকাঠামো গড়ে তুলছে।


বাংলাদেশ কি একটি উন্নত অনুন্নত না উন্নয়নশীল দেশ? তোমার উত্তরের সপক্ষে যুক্তি দেখাও।


8. শিক্ষার প্রসার :  বাংলাদেশে শতকরা প্রায় ৪০ ভাগ লোক অশিক্ষিত। ফলে উন্নয়নের সব প্রয়াস বিফলে যাচ্ছে। এখানে শিক্ষার অভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ অম্ল, অসচেতন, অদৃষ্টবাদী ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন। আধুনিক প্রযুক্তি প্রয়োগে দক্ষ জনশক্তির খুব অভাব। কাজেই বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য শিক্ষাক্ষেত্রে বাজেট বৃদ্ধিসহ শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করা এবং শিক্ষার সুফল সম্পর্কে জনমনে সচেতনতা গড়ে তুলতে রাষ্ট্রকে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার।



৫. জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ : বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ দেশ। জনসংখ্যার আধিক্য বাংলাদেশের অন্যতম  জাতীয় সমস্যারূপে স্বীকৃত। এছাড়া আবার অভ্যন্তরীণ সম্পদও এখানে খুবই সীমিত। এ কারণে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করতে হলে বাংলাদেশের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করা একান্ত দরকার। বিভিন্ন প্রচারমাধ্যম, পরিবার পরিকল্পনার পক্ষে প্রচারণা ব্যবস্থার মাধ্যমে সরকার জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করে অর্থনৈতিক উন্নয়নের চেষ্টা চালাচ্ছে।


রস্টোর এর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির স্তর তত্ত্বটি ব্যাখ্যা কর


6. জনসম্পদের পূর্ণ ব্যবহার : বাংলাদেশে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক লোক বেকার বা অর্ধবেকার অবস্থায় রয়েছে। = এ অব্যবহৃত জনসম্পদকে পূর্ণভাবে কর্মে নিয়োগ করতে হলে যে ব ব্যাপক কর্মসূচি প্রয়োজন তা কেবল রাষ্ট্রের মাধ্যমেই সম্পাদন ব করা সম্ভব। দেশে কারিগরি শিক্ষা সম্প্রসারণ, শিল্পকারখানা নির্মাণ ও উন্নয়নমূলক কর্মসূচি গ্রহণের মাধ্যমে জনসম্পদকে কাজে লাগানো যেতে পারে।


৭. প্রাকৃতিক সম্পদের পূর্ণ ব্যবহার : বাংলাদেশে প্রচুর আবিষ্কৃত ও অনাবিষ্কৃত প্রাকৃতিক সম্পদ রয়েছে। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য এসব প্রাকৃতিক সম্পদের সদ্ব্যবহার ও পূর্ণ ব্যবহারের নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে এবং নতুন সম্পদের সন্ধান করতে হবে।


৮. পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন : বাংলাদেশের ন্যায়  উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলোর সমস্যা অসীম কিন্তু সম্পদ ও ক্ষমতা  অত্যন্ত সীমিত। এ সীমিত সম্পদের দ্বারা অসীম অভাব পূরণ ও করতে রাষ্ট্রকে সুষ্ঠু পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে এবং অগ্রাধিকার ল ভিত্তিতে সীমিত সম্পদ দ্বারা মৌলিক প্রয়োজন অনুযায়ী বাস্তবায়ন ক করতে হবে।

বাংলাদেশে অর্থনৈতিক উন্নয়নের পূর্বশর্তগুলো কতটুকু বিদ্যমান আছে


৯. সরকারি বেসরকারি বিনিয়োগ : ঝুঁকিবহুল অথচ প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকার নিজেই বিনিয়োগ করছে। অথচ সরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধির পাশাপাশি বেসরকারি বিনিয়োগ | বৃদ্ধির ফলে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতিও ত্বরান্বিত করা সম্ভব। তাই সরকারকে বেসরকারি বিনিয়োগে উৎসাহ প্রদান করা প্রয়োজন।


১০. দ্রুত শিল্প প্রসার : অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য দ্রুত শিল্পায়ন প্রয়োজন। মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি এবং কর্মসংস্থান বৃদ্ধির এ জন্য শিল্পায়নের বিকল্প আর কিছু নেই। কারণ কৃষিতে নিশ্চয়তা ও কম, তাছাড়া জনসংখ্যার বাড়তি চাপ কৃষি গ্রহণ করতে অপারগ। ও দেশে বেকার সমস্যা বিশেষ করে শিক্ষিত বেকারসমস্যা সমাধানের জন্য শিল্পের বিকাশ যত তাড়াতাড়ি করা যায় ততই মঙ্গল এবং এক্ষেত্রে রাষ্ট্রকে অবশ্যই বিভিন্ন কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।


১১. কৃষির উন্নতি : বাংলাদেশ একটি কৃষিপ্রধান দেশ। এ দেশের জনসংখ্যার ৮৫ ভাগ লোক প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কৃষির সাথে জড়িত ও কৃষির উপর নির্ভরশীল। দেশের মোট জাতীয় উৎপাদনের ৬০ ভাগ আসে কৃষি থেকে এবং কাঁচামালের লা রপ্তানিকারক হিসেবে কৃষির গুরুত্ব অপরিসীম। তাই কৃষিতে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের পাশাপাশি অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য কৃষিনির্ভর শিল্প গড়ে তুলতে হবে।


মানব কল্যাণে ইসলামি অর্থনীতির গুরুত্ব আলোচনা কর


১২. আয় বৈষম্য দূরীকরণ :  বাংলাদেশের সামাজিক ব্যবস্থায় আয় বৈষম্য পরিলক্ষিত হয়। রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক উন্নয়নের গুরু যাতে সকলেই ভোগ করতে পারে সেজন্য সরকারকে কতকগুলো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হয়। যেমন- সরকার ধনী। ব্যক্তিদের আয়ের উপর, সম্পদের উপর এবং অতিরিক্ত মুনাফার উপর অধিক হারে কর ধার্য করে আয়ের বৈষম্য হ্রাস করার নি মাধ্যমে অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিশ্চিত করতে পারে।


১৩. বহির্বাণিজ্যের উন্নয়ন :  উন্নত রাষ্ট্রগুলোর সাথে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে উন্নয়নগামী রাষ্ট্রগুলোকে  বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে নিজস্ব স্থান করে নিতে হয়। নিরপেক্ষ বাণিজ্যনীতি ও নিয়ন্ত্রিত আমদানি ও রপ্তানি নীতির মাধ্যমে সরকার বৈদেশিক বাণিজ্যের প্রতিকূলতা বহুলাংশে দূর করতে সক্ষম। তাই বহির্বাণিজ্যের উন্নয়নের ক্ষেত্রেও রাষ্ট্রের উদ্যোগ গ্রহণ হ করতে হয়।


১৪. শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখা : বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হল দেশের ভিতর শান্তি ও শৃঙ্খলা বজায় রাখা। কেননা দেশের ভিতর শাস্তি ও শৃঙ্খলা বজায় না থাকলে অর্থনৈতিক উন্নয়নের সুষ্ঠু পরিবেশ গড়ে উঠে না। সুতরাং  বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বার্থে অভ্যন্তরীণ আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখা রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় কর্তব্য।


১৫. মুদ্রাক্ষীতি রোধ: বাংলাদেশের অর্থনীতি অত্যন্ত দুর্বল। এখানে মুদ্রাস্ফীতি জনজীবনকে বিপর্যস্ত করে তুলেছে। লোকের ক্রয় ক্ষমতা কমে গেছে। এ অবস্থাকে দূর করার জন্য মুদ্রা বাজারকে পুনর্গঠিত করতে হবে এবং মুদ্রাস্ফীতিকে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখতে হবে। অর্থনৈতিক উন্নয়ন যাতে ব্যাহত না। হয় সেদিকেও সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে।


পুঁজিবাদী অর্থ ব্যবস্থার প্রকৃতি বা বৈশিষ্ট্য উল্লেখ কর।


১৬. যোগাযোগ ও পরিবহণ ব্যবস্থার উন্নয়ন : বাংলাদেশের যোগাযোগ ও পরিবহণ ব্যবস্থা উন্নত নয়। অর্থনীতির উন্নয়নের জন্য এক্ষেত্রটিকে উন্নত করতে হবে। বাংলাদেশে দ্রুত পণ্য পরিবহণের উপযোগী রাস্তাঘাট ও সেতু তৈরি করতে হবে। তাছাড়া বিদেশের সাথে যোগাযোগের নেটওয়ার্কের উন্নয়ন সাধনের জন্য আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রবর্তন করতে হবে। তবেই অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে।


উপসংহার : পরিশেষে উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে একথা সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, উন্নত দেশগুলোর অর্থনৈতিক উন্নয়ন খুব সহজ হলেও বাংলাদেশের ন্যায় উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক উন্নয়ন খুবই কষ্টসাধ্য ব্যাপার। এর সাথে রাষ্ট্রের আরও অন্যান্য বিষয়গুলো অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। সে সব বিষয়গুলোর উন্নয়নের সাথে সাথে অর্থনীতিরও উন্নতি সাধিত হয়। তবে সবচেয়ে যেটা প্রয়োজন সেটা হল রাষ্ট্রের শাসকবর্গকে দুর্নীতিমুক্ত ও ন্যায়পরায়ণ হতে হবে এবং জনগণকেও আস্ত রিকভাবে দেশের স্বার্থে নিরলস পরিশ্রম করে যেতে হবে। তবেই ঘটবে অর্থনৈতিক উন্নয়


#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Now
Ok, Go it!