শিল্প সমাজের বৈশিষ্ট্যগুলো আলোচনা কর।

admin

 ভূমিকা :

প্রাচীনকালের সমাজব্যবস্থা বিশ্লেষণ করলে একটি বিষয়ই প্রতীয়মান হয় যে, সমাজের উপর মানুষের নির্ভরশীলতা ছিল এক গুরুত্বপূর্ণ দিক। মানবসমাজ বা মানব সভ্যতার বিকাশ এই সমাজের বিবর্তন ধারাকে সংজ্ঞায়িত করতে বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির পাশাপাশি চারটি পর্যায় বা ধাপ অধিক্রম করেছে। আদিমকালে মানুষ সমাজবদ্ধ হয়ে বসবাস করত না, ধীরে ধীরে তারা সমাজবদ্ধ হয়ে বাস করতে শুরু করল, তারপর সমাজে সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠা, কৃষিকাজ নির্ভর সমাজ, পশুপালন নির্ভর সমাজ, শ্রমনির্ভর সমাজের ধারাকে ধীরে ধীরে শিল্পবিপ্লব শিল্পের বিকাশের মাধ্যমে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিনির্ভর সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠতে লাগল। আজকের যে এই শিল্পনির্ভর সমাজব্যবস্থা তার পেছনে রয়েছে প্রাচীন ইতিহাস। আবহমান প্রাচীন ইতিহাস বাধাবিঘ্ন অতিক্রমের ফলে আজকের এই শিল্প ও প্রযুক্তিনির্ভর সমাজ ।


শিল্প সমাজের বৈশিষ্ট্যগুলো আলোচনা কর।


শিল্প সমাজের সাধারণ বৈশিষ্ট্য :

উল্লেখযোগ্য কিছু বৈশিষ্ট্য দ্বারা শিল্প সমাজ অন্যান্য সমাজব্যবস্থা হতে পৃথক স্বত্ত্বা তৈরি করে নিয়েছে । শিল্প সমাজের বিভিন্ন দিক বিশ্লেষণ করে নিম্নোক্ত বৈশিষ্ট্যসমূহ আলোচনা করা হলো :


ধনতান্ত্রিক অর্থনীতি : শিল্পবিপ্লবের পরপর আধুনিক পুঁজিবাদ বা ধনতন্ত্রবাদের জন্ম দিতে সক্ষম হয়েছে। শিল্পবিপ্লবের পূর্বের সমাজব্যবস্থা ছিল সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থা। সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থা হতে ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা পদার্পন করতে শিল্পবিপ্লব ব্যাপকভাবে প্রভাব বিস্তার করেছে। তৎকালীন বুর্জোয়া বা ধনিক শ্রেণির জনগণ মুনাফা লাভের আশার যে অর্থনৈতিক অবস্থায় উৎপাদনকাৰ্য, কণ্টন, চাহিদা, যোগান ও ভোগ কার্য পরিচালনা করে তাই হলো ধনতান্ত্রিক অর্থনীতি। এই অর্থব্যবস্থায় একদিকে যেমন উৎপাদন বৃদ্ধি পায় অপরদিকে তেমন শিল্প সমাজ সমৃদ্ধ হয়। এই অবস্থায় মুষ্টিমেয় লোকেরা প্রচুর ধনসম্পদের মালিক হলেও সমাজের সকল শ্রেণির মানুষের মধ্যে সামস্যতা বজায় থাকে না। ভাই বলা যায়, আধুনিক ধনতান্ত্রিক অর্থনীতির জন্মদাতা বলা হয় শিল্প সমাজকে।


প্রযুক্তির ব্যাপক উন্নয়ন : শিল্প সমাজে রূপদান করার অন্যতম প্রধান শর্ত হলো আধুনিক প্রযুক্তির উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করতে হবে। যে সকল যন্ত্রপাতি, কলাকৌশল ও তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়ে থাকে সেগুলো তুলনামূলক উন্নত এবং জটিল। মানুষ সাধারণত শিল্প যুগে এসেই প্রযুক্তির উৎকর্ষ সাধন করতে পেরেছে। মানুষ শিল্পক্ষেত্রে নতুন যন্ত্রপাতি, কলাকৌশল ব্যবহার করে উৎপাদনক্ষেত্রে উৎপাদন বৃদ্ধি, জীবনে এনেছে স্বাচ্ছন্দ্য এবং উৎপাদন পণ্য সকল উপাদানে এনেছে বৈচিত্র্যায়ন। বর্তমানে শিল্পের প্রভাবে মানুষ উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার করে উন্নত ঘরবাড়ি প্রস্তুত করছে। ঘরবাড়ি উন্নত হওয়ার সাথে সরঞ্জামাদিসহ সকলের ক্ষেত্রে মানুষ বিলাসবহুল জীবনযাপন শুরু করেছে। বিভিন্ন প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে আধুনিক সময়ে নতুন যন্ত্রকৌশল, উৎপাদিত পণ্য, বিভিন্ন কাঁচামাল ব্যবহার করে আধুনিক কার্যকরী দ্রব্যাদি ব্যবহার করে শিল্প সমাজকে সমৃদ্ধ করছে।


জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন : প্রাচীনকালের ইতিহাস পর্যালোচনা বা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, বর্তমান যুগের মানুষের জীবনযাত্রার মান প্রাচীন যুগের মানুষ অপেক্ষা অনেক উন্নত। তার কারণ পর্যালোচনা করলে শিল্প সমাজের কথাই বলতে হয়। শিল্পবিপ্লবের কলে মানুষ উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে তথ্য, যোগাযোগ, যাতায়াত, উৎপাদন উৎপাদন জাত ও বিলাসবহুল। বৃদ্ধি, জাতীয় মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি, যাতায়াতের সুব্যবস্থাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে মানুষের জীবনকে করেছে।


শিক্ষাব্যবস্থার প্রসার : বর্তমান সময়ে শিক্ষার যে উৎকর্ষ সাধন ও অগ্রগতি লক্ষ করা যায় তার মধ্যে শিল্পায়িত সমাজের অবদান লক্ষণীয়। জ্ঞানবিজ্ঞান, তথ্যপ্রযুক্তি, শিক্ষাদীক্ষা, প্রভৃতি হলো একটি শিল্পভিত্তিক সমাজের একটি অংশ শিল্প যেখানে সমৃদ্ধ সেখানে ক্রমশ শিক্ষাদীক্ষা, জ্ঞানবিজ্ঞানেও সমৃদ্ধ পূর্বের সমাজব্যবস্থায় দেখা যায় যে, যেখানে সেই সমাজব্যবস্থায় কতিপয় লোক শিক্ষা গ্রহণ করতো উৎপাদন ও শিল্পের বিকাশ ঘটার সাথে বর্তমান প্রায় সকল মানুষই শিক্ষার জন্য এগিয়ে আসছে। যার ফলশ্রুতিতে শিল্প সমাজের সাথে তাল মিলিয়ে চলার জন্য সবার জন্য উন্মুক্ত শিক্ষার  ব্যবস্থা করা হয়েছে।

 

উৎপাদনে গতিশীলতা বৃদ্ধি : প্রাচীন সমাজব্যবস্থায় প্রায় সকল মানুষ হাতে কাজ করে উৎপাদন করতো, অল্প সংখ্যক পণ্য উৎপাদন করা সম্ভব হতো। শিল্প সমৃদ্ধির সাথে সাথে অধিক উৎপাদন ব্যবস্থার সম্প্রসারণ ঘটে। শিল্প ব্যবস্থা ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা ও পারস্পরিক প্রতিযোগিতামূলক বাজার ব্যবস্থার সাথে সমন্বয়সাধন করতে পারে এবং এর চাহিদা মেটাতে সক্ষম। অধিক উৎপাদন শিল্প সমাজকে অধিক উৎপাদনের বা উন্নতির পথে ত্বরান্বিত করে।


শিল্পকারখানা স্থাপন : শিল্প সমাজে শিল্প সমৃদ্ধির সাথে দেশের অভ্যন্তরে বা বাইরে অসংখ্য ছোট শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। ফলে দেশের অভ্যন্তরে বা বাইরে প্রচুর পরিমাণ কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে। প্রকৃতি কাঁচামালকে কাজে লাগিয়ে রূপগত উপযোগ সৃষ্টির জন্য শিল্পায়িত সমাজের প্রচলন ঘটে। আধুনিক প্রতিযোগিতামূলক বাজারের সাথে তাল মিলিয়ে চলার জন্য শিল্পায়িত সমাজের বর্তমানে প্রচুর পরিমাণে শিল্পকারখানা গড়ে উঠেছে।


মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভব : আধুনিক সমাজব্যবস্থায় জ্ঞানবিজ্ঞান, তথ্যপ্রযুক্তি, শিল্পকারখানা বৃদ্ধির সাথে সাথে মধ্যধিক শ্রেণির উদ্ভবও ব্যাপকভাবে লক্ষ করা যায়। প্রাচীন সমাজব্যবস্থায় মানুষের জ্ঞানবিজ্ঞানের যেমন অভাব ছিল তেমন ছিল শিক্ষার অভাব। তাই সেই সব সময়কালে শিল্পবিপ্লব ঘটেনি, সেই সমাজব্যবস্থা জমিদার ও কৃষক শ্রেণি ছিল। ধীরে ধীরে শিল্পায়নের ফলে মধ্যবিত্ত শিক্ষিত শ্রেণি গড়ে ওঠে।


অর্থনৈতিক ব্যবস্থার উন্নয়ন : যে সকল সমাজে শিল্পায়নের বিকাশ ঘটেছে, সে সকল সমাজের অর্থনৈতিক অবস্থা ততটা শক্তিশালী। অর্থাৎ, শিল্পায়িত সমাজে শক্তিশালী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে ওঠে। শিল্পের প্রসারের সাথে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের পাশাপাশি পুঁজিবাজার, মূলধন বাজার ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ব্যাপক প্রসার ঘটে। এভাবে শিল্পায়িত সমাজে শক্তিশালী অর্থনৈতিক সমাজব্যবস্থা গড়ে ওঠে।


শক্তির উৎস : একটি দেশের শিল্প সমাজ কতটা এগিয়ে যাবে তা নির্ভর করে ঐ দেশের বিভিন্ন শক্তির উপর। শিল্পের জ্বালানি হিসেবে এ সমাজব্যবস্থায় প্রধানত পেট্রোলিয়াম, প্রাকৃতিক গ্যাস, বিদ্যুৎ, কয়লা ছাড়াও বিভিন্ন উপাদান শিল্প সমাজের উন্নতির অন্যতম উপাদান। অতএব, এ সকল শক্তির উপর নির্ভরশীলতা ও যথাযথ ব্যবহারের মাধ্যমে শিল্প সমাজের উন্নতি ও অগ্রসর হয়।


সামরিক শক্তি বৃদ্ধি : ইউরোপীয় দেশগুলো সামরিক শক্তি বৃদ্ধির মাধ্যমে বিশ্বের বাজার খুব সহজে দখল করতে পেরেছে এবং সমগ্র পৃথিবীতে অর্থনীতির এক বিশাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে। বিশ্ব সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার জন্য একটিকে যেমন সামরিক শক্তির ব্যাপক উন্নয়নের প্রয়োজন অপরদিকে তেমন প্রয়োজন শিল্প সমাজের অর্থনীতিতে ব্যাপক উন্নয়ন। অর্থাৎ সাম্রাজ্যবাদী শক্তিসমূহ তাদের নিজেদের স্বার্থে দেশের যোগাযোগ, প্রযুক্তি, পরিবহণ, শিক্ষা, সংস্কৃতি, জ্ঞানবিজ্ঞান, অর্থনীতি, সমাজব্যবস্থাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে নিজেদের সভ্যতার ব্যাপক উন্নয়ন ঘটায়।


পরিবার ব্যবস্থা : শিল্প সমাজেই সর্বপ্রথম পরিবার ব্যবস্থায় সূত্রপাত ঘটে। পূর্বে ছিল এদেশে যৌথ পরিবার ব্যবস্থা। যৌথ পরিবারের স্থলে শিল্প সমাজের প্রভাবে একক পরিবার ব্যবস্থা বিস্তৃতি লাভ করে। ফলে সমাজে বহুবিবাহ প্রচলন লোপ পায়। শিল্প সমাজে যখন উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রসার আবির্ভাব এবং প্রসার ঘটে তখন এ চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে মৃত্যুহার কমে যায়। নারীর স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হয়। বিখ্যাত সমাজবিজ্ঞান Lenski বলেছেন, "The rise of industrial sociaties has also thought greater freedom to women.


উপসংহার : উপযুক্ত সকল আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, মানুষের প্রাচীন ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, মানুষ আদিম সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থা থেকে যাত্রা শুরু করে ধনতান্ত্রিক অর্থনীতি ও সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির কাঁধে ভর করে বিভিন্ন প্রতিকূল অবস্থা, বিভিন্ন ঘাতপ্রতিঘাত অতিক্রম করে বর্তমানের এই শিল্প সমাজে উপনীত হয়েছে। বর্তমান শিল্প সমাজ বা শিল্প ব্যবস্থা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে পূর্বতন বা প্রাচীন সমাজব্যবস্থার নিকট দায়বন্ধ। বর্তমানের শিল্প সমাজে অবতরণ করে ও অনেক জায়গায় মানুষ আদিম ধারায় জীবনযাত্রার মান, খাদ্যাভ্যাস ও বসবাস করে থাকে। উল্লেখযোগ্য কিছু সমালোচনা ছাড়া শিল্প সমাজ তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্যের নিজ আলোতে সমুজ্জ্বল।

 

 



#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Now
Ok, Go it!