সমাজ ও সংস্কৃতির উপর শিল্পায়নে যে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে তার কারণ আলোচনা কর।

admin

ভূমিকা :

প্রাচীন যুগের চারটি পর্যায় বা ধাপ বিশ্লেষণ করলে এই কথা খুব সহজেই প্রতীয়মান হয় যে, প্রাচীন যুগধারার অনেক ধাপ বা পর্যায় অতিক্রম করে আজকের এই শিল্প ব্যবস্থা বা শিল্পায়ন সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছে। শিল্পায়ন হলো একটি অর্থনৈতিক অবস্থা যা কি না বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত। যার বিকাশ কোনো দেশ, রাষ্ট্র বা শুধুমাত্র জাতির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। তাই বলা হয় পুঁজিবাদী ব্যবস্থা হচ্ছে একটি বিশ্বব্যবস্থা। একটি দেশ যখন তার সর্বাত্মক চেষ্টা দিয়ে নিজেকে পুঁজিবাদী দেশ হিসেবে বিশ্ববাজারে পরিচয় করিয়ে দেবে, তখন অন্যান্য পারস্পরিক প্রতিযোগিতামূলক দেশগুলো নিজেদের আত্মপ্রকাশের জন্য কাজ করতে থাকবে। ঐ দ্বিতীয় দেশটি স্বাভাবিকভাবেই তার সর্বাত্মক চেষ্টা দিয়ে সেই দেশের উৎপাদন প্রযুক্তি যান্ত্রিক শক্তি বৃদ্ধি করে, অধিক মূলধন বিনিয়োগ করে শিল্পায়ন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে চাইবে। ফলে উভয় দেশগুলোর পারস্পরিক প্রতিযোগিতার জন্য অনেক প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সাংস্কৃতিক আচার আচরণাদির পরিবর্তন সাধিত হবে।


সমাজ ও সংস্কৃতির উপর শিল্পায়নে যে নেতিবাচক প্রভাব


সমাজ ও সংস্কৃতির উপর শিল্পায়নের নেতিবাচক প্রভাব :

সমাজ ও সংস্কৃতির উপর শিল্পায়নের বিভিন্ন দিক বিচারবিশ্লেষণ করে নেতিবাচক প্রভাব ও এর প্রকৃতি নিম্নে আলোচনা করা হলো :


১. অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা : দেশের প্রচলিত অর্থব্যবস্থার ফলে দেশের সামগ্রিক বেকারত্ব, দেশের অভ্যন্তরীণ দারিদ্র্য দূরীকরণ, উৎপাদন, বণ্টন ও ভোগের অসামঞ্জস্যতা, চাহিদা ও যোগানের ব্যাপক তারতম্যের অবসান এ সকল উন্নয়নমূলক লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য শিল্পায়ন বা শিল্পায়িত সমাজব্যবস্থার প্রচলন ঘটলেও বিভিন্ন অনাকাঙ্ক্ষিত সমস্যার জন্য তা বাধাগ্রস্ত হতে থাকে। সাধারণত বাংলাদেশের কথাই যদি বলা হয়, এদেশে প্রচলিত শ্রমিক আন্দোলন, দক্ষ কারিগর ও মূলধনের অভাব, দুর্নীতি, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, শ্রমিক অসন্তোষ প্রভৃতি কারণে শিল্পকারখানাসহ অন্যান্য কারখানাগুলোতেও অস্থিতিশীল পরিবেশ লেগেই থাকে, যা কি না একটি দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে।

পুঁজিবাদ বলতে কী বুঝা? পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় পুঁজিপতিদের বিকাশের

২. কুটিরশিল্পের বিলুপ্তি : পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থা বা শিল্প বিপ্লবের পূর্বে বিভিন্ন রাষ্ট্রগুলোর উন্নয়নের প্রধান অর্থনৈতিক চাবিকাঠি ছিল কুটিরশিল্প। বিভিন্ন রাষ্ট্রের শহর ও গ্রামাঞ্চলের হস্তশিল্প বিভিন্ন ধরণের কুটিরশিল্পের যে স্বকীয়তা বজায় ছিল শিল্পায়নের প্রভাবে তা ধ্বংসের পথ অবতীর্ণ হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে আমরা প্রাচীন বাংলার ঐতিহ্য মসলিন কাপড় শিল্পের কথাই উল্লেখ করতে পারি। এছাড়াও তাঁতি, কামার, কুমার, বিভিন্ন নকশি কাঁথা শিল্পী, যারা এককালে অনেক চমকপ্রদ ও প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র সরবরাহ করতো। তারা প্রচলিত কলকারখানাগুলোর সাথে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে বেকারত্ব বাড়তে থাকে। এতে বিভিন্ন পেশাজীবী মহলে প্রচুর পরিমাণে দারিদ্র ও হতাশা দেখা দেয়। এ প্রসঙ্গে ইংল্যান্ডের তাঁতিদের কথাই উল্লেখ করা যায়। শিল্পবিপ্লবের ফলে এসব ঐতিহ্যের ধারক ও রক্ষক জাতিগোষ্ঠী নিঃস্ব হয়ে কারখানার শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে বাধ্য হয়েছিল।


৩. মূল্যবোধের অবক্ষয় : মূল্যবোধের অবক্ষয় বর্তমান শিল্পায়ন ও শহরায়নের একটি নেতিবাচক প্রভাব শিল্পায়নের ফলে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ বা পুঁজিপতি বা মালিকানা প্রতিষ্ঠার প্রবণতা তৈরি হচ্ছে। ফলে বর্তমান সমাজ ও সংস্কৃতির উপর শ্রদ্ধাবোধ দিন দিন কমে যাচ্ছে। সমাজের এই বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টির ফলে সমাজের মানুষের মধ্যে বিজাতীয় পশ্চিমা সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ ঘটছে। যার ফলে সমাজ ব্যবস্থার অবনতির সাথে উন্নয়নের ধারা ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাচ্ছে। এছাড়া সমাজের মানুষের মধ্যে প্রচুর পরিমাণ মানুষের মালিকানা প্রতিষ্ঠা করার জন্য শিল্পকারখানা মালিক বা পরিচালক, কর্মচারী মহলের অর্থ আত্মসাৎ, দুর্নীতি, ঘুস প্রভৃতি কার্যকলাপের ফলে নৈতিক মূল্যবোধ ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে।


৪. যৌথ পরিবারের বিলোপ : শিল্পায়নের বিকাশের সাথে এ সমাজব্যবস্থার যৌথ পরিবারগুলো ভেঙে যাচ্ছে। কারণ শিল্পকারখানাগুলোতে কাজ করতে হলে শ্রমিকও কর্মকর্তাদের শিল্পাঞ্চলে এসে পৃথকভাবে স্ত্রী-কন্যা-পুত্র নিয়ে বসবাস করতে হয়। নচেৎ শ্রমিক বা কর্মকর্তাদের স্ত্রী-কন্যা-পুত্রদের জন্য পৃথকভাবে বাসস্থানের ব্যবস্থা করতে হয়, আবার সংসারের খরচের জন্য পৃথকভাবে টাকা পাঠাতে হয়। শিল্পকারখানায় কাজ করে পৃথকভাবে দু'জায়গায় ভরণপোষণ ও টাকা পাঠানো মোটেও সম্ভব পর হয়ে ওঠে না। যৌথ পরিবারের আলাদা হয়ে যাওয়ার ফলে সকলেই অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল লাভবান হতে পারে। এছাড়াও পারস্পারিক সম্পর্ক দৃঢ় হয় এবং সকলে একযোগে সকল কার্যসম্পাদন করতে সক্ষম হয়। হয়ে পড়ে। যৌথ পরিবারের সকলের উপার্জিত অর্থ একত্রে ব্যয় করলে সেক্ষেত্রে সেই যৌথ পরিবারটি আর্থিকভা যৌথ পরিবার ভাঙনের ফলে যারা অকর্মণ্য কিন্তু পরিবার থেকে পৃথক হয়ে যায় তাদের অর্থনৈতিক অবস্থা খুবই শোচনীয় হয়ে পড়ে। এতে দেশ, রাষ্ট্র তথা সংসারের শাক্তি ধূলিসাৎ হয়ে যায়।

শিল্পায়ন বলতে কী বুঝ? শিল্পায়নের কী কী বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায়? 

৫. সামাজিক অনগ্রসরতা : শিল্পায়নের ফলে একটি দেশ বা রাষ্ট্রের সামাজিক অনগ্রসরতা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ লক্ষ করা যায়। কারণ দ্রুত শিল্পায়নের ফলে মানুষ শহরায়নের দিকে ধাবিত হয় ফলে সামজিক মানুষ তার চিন্তাধারার দ্রুত পরিবর্তন ও পরিবর্ধন আনতে পারে না। ফলে মানুষের সামাজিক গতির সাথে সামঞ্জস্য না রাখতে পারায়, শা শহরায়নের গভির সাথে একত্রে কাজ করতে অপারগ হয়ে পড়ে।


৬. সমাজ কাঠামোর পরিবর্তন : শিল্পায়নের ফলে দেশে-বিদেশে প্রচলিত সমাজব্যবস্থা (যেমন- জমিদার-কৃষক শ্রেণি) পরিবর্তন করে পুঁজিপতিরা বিনিয়োগ করতে শুরু করে এবং কৃষক শ্রেণি শুধুমাত্র কৃষির উপর নির্ভরশীল না থেকে বিভিন্ন অবস্থানরত কলকারখানা কাজ করতে থাকে। এতে সমাজে পরিবারের বন্ধনগুলোর মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, এই শিল্পকারখানায় কাজ করার ফলে সামাজিক বন্ধন, পারিবারিক কলহ, বিবাহবিচ্ছেদ, পারিবারিক ভাঙনকেও এর নেতিবাচক দিক হিসেবে চিহ্নিত করে। তাই বলা হয়েছে যে, শিল্পায়নের ফলে মানুষের উৎপাদন কার্যে লিখু থাকার জন্য তারা সমাজের সাথে সেতুবন্ধন ছিন্ন করে দিতে পারে যার ফলে তাদের মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন সাধিত হতে থাকে।


৭. কিশোর অপরাধ প্রবণতা : শিল্পায়িত সমাজে অত্যধিক কর্মসংস্থান সৃষ্টি হলেও দেশের অভ্যন্তরীণ বা বাহ্যিক উৎসের কিশোর অপরাধ প্রবণতা ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পায়। শিল্পায়িত সমাজের স্বামী-স্ত্রী-পুত্র-কন্যা সকলকেই জীবিকা। অর্জনের জন্য শিল্পকারখানায় কর্মরত থাকতে হয়। স্বামী-স্ত্রীকে একসাথে কাজ করার ফলে, তাদের ছেলেমেয়েদের এ সুযোগে অশিক্ষিত চাকর-চাকরানিদের সাহচর্যে থাকার কারণে নানা প্রকার অসামাজিক অপরাধে লিপ্ত থাকার আশঙ্কা দেখা দেয়। ফলে সকল পারিপার্শ্বিক অবস্থা ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে সেই সকল কিশোরেরা অপরাধমূলক কাজে লিপ্ত হওয়ার কারণে কোনো দ্বিধাবোধ করে না।


৮. নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন : গ্রামের লোকেদের জীবনধারা খুবই সাধারণ। শিল্পায়নের ফলে গ্রামের সাধারণ কৃষক বা শ্রমিকদের শহরকেন্দ্রিক হতে চায়। শিল্পায়নের প্রভাবে গ্রামের লোকেরা শহরে এসে শিল্পকারখানায় উৎপাদনে নিয়োজিত থেকে তাদের জীবিকা সংস্থান করে, শহুরে পরিবেশে এসে শহরের সাথে সামঞ্জস্যতা রক্ষা করার জন্য বিভিন্ন কারণে বিভিন্ন জায়গায় তাদের নৈতিক গুণাবলি বা নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি বিসর্জন দিতে বাধ্য হয়। নানা কারণে তারা মদ্যপান, ব্যভিচার ও পতিতালয়ের দিকে ব্যাপকভাবে নেশাগ্রস্থ হয়ে ওঠে। নিজের সংসার বা যে শিল্পকারখানায় কর্মরত রয়েছে এদের প্রতি বিদ্বেষ মনোভাব গড়ে ওঠার আশঙ্কা থাকে বলে সেদিকে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়। এটিও কিন্তু শিল্পায়নের নেতিবাচক প্রভাবগুলোর মধ্যে অন্যতম প্রধান কারণ ।

“ম্যাকিয়াভেলিকে অনেক দার্শনিক অবমূল্যায়ন করেছেন'- এ সম্পর্কে আলোচনা কর ।

৯. বস্তি সমস্যা : শিল্পায়নের ফলে শিল্পকারখানায় অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোতে বস্তি সমস্যা লক্ষ করা যায়। কোনোভাবে একটু থাকা-খাওয়ার জায়গার নামই বস্তি। দ্রুত শিল্পায়ন ও শহরায়ন প্রক্রিয়ার সাথে শহরে জনসংখ্যা ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ সকল কারখানায় শ্রমিকরা কর্মরত থাকে বড় বড় শিল্পকারখানায়। শিল্পকারখানায় মালিক একটি নির্দিষ্ট অঞ্চল বা স্থান ঘিরে শ্রমিকদের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার একটি ক্ষুদ্র পরিসরে জায়গার ব্যবস্থা করা থাকে। শিল্পকারখানায় মালিক কর্তৃক শ্রেণির কর্মচারীদের জন্য আবাসিক ব্যবস্থা না থাকার কারণ সে সকল বাধা হয়ে থাকে। মাথা গোঁজার জন্য বস্তিতে অবস্থান গ্রহণ করতে হয়। কারণ তাদের পক্ষে ক্রমবর্ধমান দামের ফলে শহরে জায়গা কিনে বাড়ি তৈরি করে বসবাস করা সম্ভব নয়। আবার শহরে ভালো জায়গায় বাড়ি ভাড়াও অনেক বেশি। অতএব বলা যায় যে, দ্রুত শিল্পায়ন ও শহরায়নের প্রভাবে এ সকল শ্রমিকদের জীবনযাত্রায় এরূপ নিম্নমান থাকায় এবং উপার্জনের স্বল্পতা থাকায় তারা বস্তিতে বসবাস করে।


উপসংহার :

উপর্যুক্ত সকল আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, শিল্পায়ন একটি সার্বিক অবস্থা এবং বিশ্বজনীন ব্যবস্থা। বর্তমান বিশ্বেও তৃতীয় বিশ্বের মনে, অর্থনীতিতে দুর্বল দেশগুলোর মধ্যে অনেক দেশের শিল্পায়নের ক্ষেত্রে বিনিয়োগের জন্য পর্যাপ্ত বা যথাযথ মূলধন বর্তমানে নেই। তাই, তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের প্রয়োজনীয়তা লক্ষ করা হয়। শিল্পায়নের মাধ্যমে একটি সাংস্কৃতিক উপাদানগুলো উত্থানপতন ও অন্যান্য উপাদানসমূহ ত্বরান্বিত করা সম্ভবপর হয়। সংস্কৃতির আদানপ্রদান শিল্পায়নের একটি স্বাভাবিক ব্যপার। শিল্পায়নের মাধ্যমে একটি দেশের জাতীয় উন্নয়ন সমৃদ্ধ হয়। তাই বলা হয়, যদিও জাতীয় উন্নয়নের সাথে একটি জাতীয় সংস্কৃতির ইতিবাচক সম্পর্ক রয়েছে তবুও শিল্পায়নের কারণে জাতীয় ও সামাজিক অগ্রগতির কারণে প্রচলিত সমাজব্যবস্থার বিলোপসাধন, অবকাঠামোগত উন্নয়ন ব্যাহত, বিদেশি ধ্যানধারণাও অপসংস্কৃতির অপপ্রচার ও অনুপ্রবেশ কাম্য নয়।


#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Now
Ok, Go it!