রুশো একজন সর্বাত্মকবাদী' উক্তিটি ব্যাখ্যা কর।

admin

ভূমিকা :

রাষ্ট্রচিন্তার অন্যতম মহান নায়ক জ্যাঁ জ্যাক রুশো জেনেভার একটি দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। রাষ্ট্র দর্শনের ইতিহাসে তার অমর সৃষ্টি "The social contract' গ্রন্থ, যা তাকে রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসে স্থায়ী আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছে। ফরাসি বিপ্লবের বাইবেল নামে পরিচিত The social contract' গ্রন্থে রুশো রাষ্ট্রচিন্তার বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করলে বলা যায়, “সাধারণ ইচ্ছা” কে কেন্দ্র করে তিনি তার সমগ্র দর্শন বিশ্লেষণ করেছেন। “মানুষ স্বাধীনভাবে জন্মগ্রহণ করে কিন্তু সর্বত্রই সে শৃঙ্খলিত” -এ মহান বাণী দিয়ে তিনি তার গ্রন্থ শুরু করেন। রাষ্ট্রদর্শন মূল্যায়ন করতে গেলে তাকে একদিকে গণতন্ত্রবাদী এবং অপরদিকে সর্বাত্মবাদী দার্শনিক হিসেবে দেখতে পাওয়া যায়।


রুশো একজন সর্বাত্মকবাদী' উক্তিটি ব্যাখ্যা কর।

সর্বাত্মবাদী হিসেবে রুশো :

যে শাসন ব্যবস্থায় মানুষের সামগ্রিক জীবন রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে তাকে সর্বাত্মকবাদ বলে। অন্যদিকে যে শাসন ব্যবস্থায় মানুষের সামগ্রিক জীবন রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে তাই হলো সর্বাত্মকবাদী ব্যবস্থা। অনেক রাষ্ট্রচিন্তাবিদ রুশোকে সর্বাত্মকবাদী হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। আমরা যে সকল করণে রুশোকে সর্বাত্মকবাদী বলতে পারি এবং যে সমস্ত ‘মনোভাব' তার মধ্যে পাওয়া যায় তা নিম্নরূপ :


১. ব্যক্তি স্বাধীনতা প্রসঙ্গে : “মানুষকে স্বাধীন হতে বাধ্য কর” এই সম্পর্কে তিনি যে উক্তি করেছেন তা সর্বাত্মকবাদী রাষ্ট্রনায়কদের স্বেচ্ছাচারিতার নামে অমোঘ অস্ত্রে পরিণত হয়েছে। কেননা মানুষকে এরূপ বাধ্যবাধকতার ধারণা বিভ্রান্তি ও স্ববিরোধিতা।তিনি ব্যক্তি স্বাধীনতার উপর রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ সুনিশ্চিত করেছিলেন। মানুষকে স্বাধীন হতে বাধ্য করে রুশো নিজেই ব্যক্তিস্বাধীনতাকে লঙ্ঘন করেছেন। সুতরা তাঁকে সর্বাত্মকবাদী বলে আখ্যায়িত করা যথার্থ হবে।


২. সাধারণ ইচ্ছা সংক্রান্ত : রুশোর সাধারণ ইচ্ছা ও সকলের ইচ্ছার মধ্যে যে পার্থক্য তা খুব বিভ্রান্তিকর। সাধারণ ইচ্ছা নিরূপণের জন্য তিনি কোনো নির্ভরযোগ্য প্রণালির কথা বলেননি। বস্তুত এ কারণেই একনায়কগণ তাদের ক্ষমতা ও কার্যক্রমকে বৈধকরণের জন্য রুশোর সাধারণ ইচ্ছাকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছেন।


৩. রাষ্ট্রই সর্বেসর্বা : রুশো তার রাষ্ট্রদর্শনে বলেছেন, জনগণ বিনাশর্তে তাদের সমস্ত ক্ষমতা সম্পূর্ণরূপে যৌথ ব্যক্তিত্ব বা রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের কাছে সমর্পণ করেছে যা সর্বাত্মক প্রকৃতির।


৪. ব্যক্তিস্বার্থবিরোধী : রুশোর চিন্তাধারায় সামাগ্রিক সমাজের স্বার্থ সকল অবস্থাতেই স্বার্থের ঊর্ধ্বে প্রতিফলিত হওয়ায় তা সমাজতান্ত্রিক ও একনায়ক দর্শনকে দারুণভাবে আন্দোলিত করেছিল। সমাজতন্ত্রে ব্যক্তিকে প্রাধান্য না দিয়ে রাষ্ট্রকেই প্রধান্য দেওয়া হয় যা সর্বাত্মক ব্যবস্থার নামান্তর।


৫. সার্বভৌমিকতা প্রসঙ্গে : রুশো তাঁর গ্রন্থে সার্বভৌম ক্ষমতার আলোচনা করতে গিয়ে সরকারকে সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী বলে অভিহিত করেছেন, যা সর্বাত্মকবাদের পরিচয় বহন করে। রুশো আগে বলেন, সার্বভৌমত্ব সাধারণ ইচ্ছার উপর ন্যস্ত। সাধারণ ইচ্ছাকে চরম ক্ষমতাসম্পন্ন করে তিনি সর্বাত্মবাদের পরিচয় দিয়েছেন। এছাড়া রাষ্ট্রের সার্বভৌম শক্তি “অসীম চরম, চূড়ান্ত হস্তান্তর অযোগ্য, অবিভাজ্য, অবিনশ্বর” এসবই সর্বাত্মকবাদের নামান্তর।


৬. সরকারের উৎপত্তি প্রসঙ্গে : রুশো বলেছেন যে, সরকার কোনো যুক্তির মাধ্যমে সৃষ্টি হয়নি বরং তা সার্বভৌম শাসকের আদেশের মাধ্যমে সৃষ্টি হয়েছে। তার এই মন্তব্য স্বৈচ্ছাচারিতার নামান্তর।


৭. সামাজিক ধর্ম : জনগণ যাতে আইন প্রণেতাদের ভুল না বোঝে সেজন্য রুশো সামাজিক ধর্ম বলে এক অভিনব তত্ত্বের অবতারণা করেছেন। রুশোর সামাজিক ধর্ম সকল ধর্ম অনুশীলনের পথে প্রতিকূলতা সৃষ্টি করে। যা সর্বাত্মবাদীর পরিচয় বহন করে। তাছাড়া রুশোর ধর্মতত্ত্ব মতে, এটি এক অভিনব ধর্মতত্ত্ব রচনা। এ নতুন ধর্ম মানুষের ধর্মমতে আঘাত হেনেছে এবং এ ধর্ম প্রতিটি ব্যক্তিকে মানতে বাধ্য করায় তিনি সর্বাত্মবাদের পরিচয় দিয়েছেন।


৮. রাষ্ট্রের বিরুদ্ধাচরণ করা যাবে না : রুশো বলেন যে, রাষ্ট্র কোনো অন্যায় করতে পারে না। রাষ্ট্র ব্যক্তি স্বাধীনতা হরণ করলেও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কিছুই করার নেই। কেননা রাষ্ট্র সর্বক্ষমতাসম্পন্ন প্রতিষ্ঠান। এটি সর্বাত্মকবাদী রাষ্ট্রেরই বৈশিষ্ট্য।

আরো পড়ুন: রুশোকে সর্বাত্মকবাদী গণতন্ত্রী বলা হয় কেন?

উপরিউক্ত কারণগুলোর পরিপ্রেক্ষিতে আমরা রুশোকে সর্বাত্মকবাদী দার্শনিক বলতেই পারি। এছাড়াও সর্বাত্মকবাদের কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে যা আমাদের চোখে ধরা পড়ে। তা নিম্নরূপ :


১. সর্বাত্মবাদে জনগণের মত প্রকাশের স্বাধীনতা দেয়া হয় না।

২. সর্বাত্মকবাদী রাষ্ট্র ক্ষমতাসীন একনায়কের ইচ্ছা অনুযায়ী পরিচালিত হয়।

৩. সর্বাত্মকবাদী রাষ্ট্রে ব্যক্তিকে রাষ্ট্রের অধীনতা পাশে অবদ্ধ করা হয়।

৪. সর্বাত্মকবাদী রাষ্ট্রে একটি মাত্র রাজনৈতিক দল থাকে-

৫. সর্বাত্মকবাদে আইনের শাসনকে প্রাধান্য দেয়া হয় না ।


মূল্যায়ন গভীরভাবে পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, সর্বাত্মক দর্শনের সাথে রুশোর দর্শন নিতান্তই বাহ্যিক। সর্বাত্মক রাষ্ট্রের শাসন পদ্ধতিতে কোনো নৈতিক ভিত্তি নেই এবং তা শাসক সম্প্রদায়ের ইচ্ছার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয়। আরও একটু বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে, নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্র পার্লামেন্টারি শাসন ও স্বাধীন বিচার ব্যবস্থার ন্যয় প্রধান প্রধান সংবিধানিক নীতি, সরকারের শাসন পদ্ধতি, নীতি প্রভৃতি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্যের সাথে রুশোর সাধারণ ইচ্ছা তথা দর্শনের যথেষ্ট সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায়। কাজেই সার্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে রুশোকে সর্বাত্মকবাদী না বলে গণতান্ত্রিক বলাই শ্রেয়।

আরো পড়ুন: রুশোর সাধারণ মতবাদটি বর্ণনা কর

উপসংহার:

পরিশেষে বলা যায়, রুশোর দর্শনের যথার্থতা সম্পর্কে সমালোচকদের মধ্যে পরস্পর বিরোধী অভিমত বিদ্যমান থাকলেও তার দর্শনের আবিষ্কার বাস্তব তত্ত্বগত প্রভাব সম্পর্কে কোনো মতভেদ নেই। তিনি সর্বদা অধিকতর ব্যক্তি প্রয়োগকে ঘৃণা করতেন। রুশোর রাষ্ট্রদর্শন আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তার ক্ষেত্রে এক ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। তার সাধারণ ইচ্ছাতত্ত্ব আপাতদৃষ্টিতে সর্বাত্মাকবাদী মতবাদ হিসেবে গণ্য হতে পারে। তবে গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, তার মতবাদ নৈতিকতা বিবর্জিত নয়। এছাড়া সামাজিক ধর্ম নিয়ে রুশোকে সর্বাত্মকবাদী বলা হলেও তিনি একজন জাতীয় চেতনা সৃষ্টিকারী ধর্মের দিশারি ছিলেন। তার “সাধারণ ইচ্ছার” মধ্যে মানবজাতির প্রকৃত কল্যাণ ও স্বাধীনতার কথাই বিবৃত হয়েছে।


#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Now
Ok, Go it!