রাষ্ট্রদর্শনে জন লকের অবস্থান ও উদারবাদী চিন্তাবিদ হিসেবে তার অবদান মূল্যায়ন কর

admin

ভূমিকা :

জন লক ছিলেন সপ্তদশ শতকের যুক্তিবাদী দার্শনিকদের অন্যতম। সামাজিক চুক্তি, প্রাকৃতিক আইন, প্রাকৃতিক অধিকার এবং জনগণ কর্তৃক বিপ্লব সংগঠিতকরণের অধিকারের উপর ভিত্তি করে তিনি যে রাষ্ট্রচিন্তা পড়ে তোলেন, তা রাষ্ট্রদর্শনের ইতিহাসে উদ্ভাবিত হলেও তাঁর তত্ত্ব প্রাকৃতিক অধিকার। সরকারের উপর জনসাধারণের নিয়ন্ত্রণ এবং সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার বক্তব্যকে সুষ্ঠুরূপে প্রতিষ্ঠিত হতে সাহায্য করেছে। লকের বক্তব্য হবসের ন্যায় যুক্তিতে পরিপূর্ণ না হলেও সমকালীন সকল রাজনৈতিক সমস্যার পর্যালোচনা এতে স্থান পেয়েছে এবং সেসব সমস্যার দার্শনিক সমাধান দিতে চেষ্টা করেছেন। সমাধানে তিনি ব্যক্তির স্বাধীনতা, স্বাতন্ত্র্যবোধ এবং গণতন্ত্রের ন্যায় আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মৌল অনুভূতিসমূহের আলোকে দার্শনিক সমাধান দিতে চেষ্টা করেছেন।


রাষ্ট্রদর্শনে জন লকের অবস্থান ও  উদারবাদী চিন্তাবিদ হিসেবে তার  অবদান মূল্যায়ন কর


রাষ্ট্রদর্শনে জন লকের অবদান বা অবস্থান :

সপ্তদশ শতাব্দীর কিংবদন্তী ব্যক্তিত্ব, গণতান্ত্রিক চিন্তা উজ্জীবিত এবং বুর্জোয়া ও উদারনৈতিক রাষ্ট্রচিন্তার অকুণ্ঠ সমর্থক ছিলেন জন লক। তাঁর রচিত গ্রন্থ ইংল্যান্ডে উদারনীতিবাদ ও সংবিধানতন্ত্রের গোড়াপত্তন করেছে। লকের রাষ্ট্রদর্শনের মূল্যায়ন করতে হলে একটা কথা মনে রাখতে হবে যে, তিনি নতুন কিছু বলেননি। যে তত্ত্বগুলো তার আগে প্রচলিত ছিল তিনি কেবল অসাধারণ দক্ষতার সঙ্গে সেগুলোকে এক জায়গায় সংগৃহীত করেছেন। কাজেই রাষ্ট্রচিন্তার ক্ষেত্রে তাঁর কোনো মৌলিকত্ব না থাকলেও এ কাজের জন্য রাষ্ট্রদর্শনের ইতিহাসে তিনি অমর হয়ে আছেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য অবদানগুলো নিম্নে আলোচনা করা হলো:


জন লক কে ছিলেন? জন লককে কেন আধুনিক গণতন্ত্রের জনক বলা হয়?


১. জীবন, সম্পত্তি ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা : লক নিশ্চিতরূপে বুঝতে পেরেছিলেন যে, পূর্ণাঙ্গ জীবনের জন্য অধিকার অপরিহার্য। স্বৈরাচারী শাসক ব্যক্তিস্বাধীনতাকে ক্ষুণ্ণ করে। তাই তিনি সার্বভৌম শক্তিকে নিয়ন্ত্রণে আনার কথা বলেছেন। লক তাঁর প্রাকৃতিক অধিকার তত্ত্বের ধারণা দিয়ে মানুষের জীবন, সম্পত্তি ও স্বাধীনতার অধিকারগুলোকে পবিত্রতম ও অলঙ্ঘনীয় অধিকারের মর্যাদায় ভূষিত করেছেন। এজন্য লক চিরকাল সমগ্র মানবজাতির কৃতজ্ঞতা পাশে আবদ্ধ থাকবেন।


২. সাংবিধানিক সরকারের প্রবক্তা : লক বলেন যে, কতকগুলো সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য সাধনের নিমিত্তে ও নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যে থেকে সরকারকে কাজ করে যেতে হবে। চরম সার্বভৌমত্বের পরিবর্তে সাংবিধানিকতাকে তিনি প্রাধান্য দিয়েছেন। তাঁর মতে, সাংবিধানিক নীতির ভিত্তি হবে সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামত। যে সরকারের ভিত্তি জনগণের সম্মতি নয়, সে সরকারকে তিনি বৈধ সরকার বলতে রাজি হননি। লকের আগে আর কোনো রাষ্ট্রদার্শনিক এতখানি জোর দিয়ে বলেন নি যে, জনগণের সম্মতি ব্যতীত সরকারের বৈধতা মূল্যহীন।


৩. উদারনীতিবাদের প্রবক্তা : লক বলেন যে, জনগণের স্বাধীনতার পরিধিকে বিস্তৃত করাই হচ্ছে সরকারের প্রকৃত লক্ষ্য। জনগণকে মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা সরকার বা রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য নয়। সরকারকে অবশ্যই জনগণের স্বার্থে ৬ কল্যাণে কাজ করে যেতে হবে। লকের এই উদারনীতির চিন্তাধারা পাশ্চাত্য রাষ্ট্রচিন্তার ওপর যথেষ্ট প্রভাব ফেলেছিল। এজন্য অনেকে তাঁকে উদারনীতিবাদের প্রবক্তারূপে আখ্যায়িত করেছেন।

সমাজ ও সংস্কৃতির উপর শিল্পায়নে যে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে তার কারণ আলোচনা কর।

৪. ক্ষমতা-স্বতন্ত্রীকরণ নীতির প্রেরণাদাতা : আধুনিক যুগে লকই সর্বপ্রথম ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির ওপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করেছেন। জনগণের জীবনের অধিকার, স্বাধীনতার অধিকার এবং সম্পত্তির অধিকার সংরক্ষণ করার জন্য তিনি সরকারের ক্ষমতা পৃথক পৃথক তিনটি বিভাগের ওপর ন্যস্ত করার কথা বলেছেন এবং এক বিভাগ অন্য বিভাগের কাজে হস্তক্ষেপ করবে না বলে উল্লেখ করেছেন। ফরাসি দার্শনিক মন্টেস্কু এ নীতির প্রবক্তা হিসেবে বিবেচিত হলেও লক ছিলেন তার পূর্বসূরী ও প্রেরণাদাতা। এদিক দিয়েও ক্ষমতা-স্বতন্ত্রীকরণ নীতি বিষয়ে তাঁর অবদান মোটেও নগণ্য নয় ।


৫. ধর্মীয় সহনশীলতার অনুসারী : লক ধর্মীয় সহনশীলতার অনুসারী ও অনুরাগী ছিলেন। তিনি বিভিন্ন ধর্মবিশ্বাসের প্রতি সহিষ্ণুতা প্রদর্শন করার কথা বলেছেন। তাঁর মতে ধর্মের ব্যাপারে কোনো জোর-জবরদস্তি নেই। ধর্মের উদ্দেশ্য আত্মার মুক্তি ও শুদ্ধি সাধন করা; যা বলপ্রয়োগের মাধ্যমে সম্ভব নয়। তাঁর মতে শাসকের ক্ষমতার উৎস জনগণ, বিধাতা নয়। তিনি মনে করেন, ধর্মের বিষয়ে রাষ্ট্রের করণীয় কিছু নেই। ব্যক্তি নিজ ইচ্ছামতো তার নিজ ধর্ম পালন করতে পারবে: রাষ্ট্র তাতে কোনো হস্তক্ষেপ করবে না।


৬. সংসদীয় গণতন্ত্রের জনক : জন লককে সংসদীয় গণতন্ত্রের জনক বলা হয়। তিনিই বলেছেন জনগণ রাজনৈতিকভাবে সার্বভৌম এবং পার্লামেন্ট আইনগতভাবে সার্বভৌম। কাজেই পার্লামেন্টের শ্রেষ্ঠত্বের নীতি তাঁর দ্বারা ঘোষিত হয়েছে। তিনি শাসনবিভাগকে আইনবিভাগের নিকট দায়ী করে সংসদীয় গণতন্ত্রের দ্বারা উন্মোচন করেছেন। আধুনিক সংসদীয় গণতন্ত্রের ধারণা আমরা সর্বপ্রথম তার নিকট থেকেই পাই।


৭. মূল্যের শ্রমনীতির প্রবক্তা : মূল্যের শ্রমনীতির ব্যাখ্যা করে তিনি বলেছেন, শ্রমের মাধ্যমে উৎপাদিত বস্তু ব্যক্তির ব্যক্তিগত সম্পত্তি । মূল্যতত্ত্ব সম্পর্কে লকের তত্ত্ব পরবর্তী সময়ে পুঁজিবাদী ও সমাজতন্ত্রবাদী অর্থনীতিবিদগণ আপন-আপন স্বার্থে সাফল্যজনকভাবে কাজে লাগিয়েছেন ।


৮. ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের সমর্থক : লকের উদ্দেশ্য ছিল ব্যক্তির সার্বিক কল্যাণ সাধন করা। তাঁর সকল চিন্তা ও ধ্যানধারণা ব্যক্তিকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হতো। ব্যক্তির সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য বিধান এবং তাঁদের অধিকার ও স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য তিনি তাঁর ক্ষমতা-স্বতন্ত্রীকরণ তত্ত্ব প্রদান করেন। এজন্য তাঁকে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের পথপ্রদর্শক বলা হয়।


৯. আমেরিকায় লকের প্রভাব : আমেরিকার স্বাধীনতা ঘোষণাপত্রের ওপর লকের অপরিসীম প্রভাব লক্ষ করা যায়। ঘোষণাপত্রের রচয়িতাগণ লকের সংবিধানতন্ত্রকে যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গে পরিণত করেছিলেন। অঙ্গরাজ্যগুলোর সংবিধান ও ঘোষণাপত্রের ভাষা পর্যন্ত লকের কাছ থেকে ধার করা। আমেরিকার অর্থনৈতিক ও সামাজিক জীবন লকের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য্যবাদ ও সম্মতি তত্ত্বের বিশ্লেষণের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত।


১০. সম্পত্তি তত্ত্বের প্রবক্তা: লকের রাষ্ট্রদর্শনে 'সম্পত্তি (property) একটি বিশেষ অধ্যায়। লকের মতে, সম্পত্তির সঙ্গে মানুষের শ্রম যুক্ত হয়ে ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার সৃষ্টি হয়েছে। লক বিশ্বাস করতেন ব্যক্তিগত সম্পত্তি শ্রমের মর্যাদা বৃদ্ধি করে এবং ব্যক্তির উৎপাদিত পণ্যের মাধ্যমে তাঁর শ্রমের মূল্য নিরূপণ হয়। তাঁর মতে, সম্পত্তি কোনো প্রকার চুক্তি ছাড়াই জনগণের অধিকারভুক্ত। সম্পত্তিসংক্রান্ত লকের তত্ত্ব অনুসারে ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার রক্ষার জন্যই রাষ্ট্র ও সরকারের সৃষ্টি এবং এর ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজন রয়েছে। পরবর্তী সময়ে সনাতনপন্থি-অর্থনীতিবিদ সমাজতন্ত্রবাদী অর্থনীতিবিদগণ "মূল্যের শ্রমনীতি' এবং 'মূল্য তত্ত্ব' সম্পর্কে যে তত্ত্ব দেন তার অনুপ্রেরণা লাভ করেন লবের

কাছ থেকে।


১১. সম্মতি তত্ত্বের প্রবক্তা : জন লকের মতে, জনগণের সম্মতি (consent) শাসনের মূল ভিত্তি। জনসম্মতি ব্যতীত শাসকের শাসন করার তেমন কোনো অধিকার নেই। কাজেই রাষ্ট্র সৃষ্টি ও পরিচালনা এ উভয় কাজের জন্যই জনসম্মতি অপরিহার্য।


১২. দায়িত্বশীল সরকারের প্রবক্তা : জন লক দায়িত্বশীল সরকারের সমর্থক ছিলেন। তাঁর মতে, যাঁরা শাসন করবে তাঁরা প্রতিটি কাজের জন্য জনগণ ও জনপ্রতিনিধিদের নিকট দায়ী থাকবে। অর্থাৎ সরকার হলো জনগণের স্বার্থ ও অধিকারের জিম্মাদার।


১৩. নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্রের প্রবক্তা : জন লক তাঁর সময়ে স্টুয়ার্ট স্বৈরতন্ত্রকে মনেপ্রাণে ঘৃণা এবং এর উচ্ছেদ কামনা করলেও রাজতন্ত্রের বিলুপ্তি চাননি। তিনি চেয়েছিলেন রাজতন্ত্র ও গণতন্ত্রের সহাবস্থান। তিনি ছিলেন মূলত নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্রে বিশ্বাসী এবং তিনি এটাও বিশ্বাস করতেন যে, রাজশক্তিকে সীমিত করে গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রা সুনিশ্চিত করা সম্ভবপর ।


১৪. যুক্তিবাদ ও অভিজ্ঞতাবাদের সমন্বয়সাধন: অসংলগ্ন ও বিক্ষিপ্ত চিন্তাধারাকে সুসংহত করতে হলে যে অসাধারণ বোধশক্তির প্রয়োজন হয় তা জন লকের আদৌ কমতি ছিল না। প্রফেসর স্যাবাইন-এর মতে, একটি চলমান ঘটনা বা ধারাকে সাধারণ বুদ্ধি দিয়ে ব্যাখ্যা করা এবং বাস্তবের সঙ্গে প্রাসঙ্গিকতা খুঁজে বের করতে লক অসাধারণ বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছেন ।


পরিশেষে বলা যায়, রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসে লকের অবদান প্রসঙ্গে ওয়েপার (C. L. Wayper) বলেছেন, "He is the last voice of one great tradition and first of great voice of another great tradition." লকের রাজনৈতিক তত্ত্বের বিশ্লেষণ করলে ওয়েপারের বক্তব্যের যথার্থতা খুঁজে পাওয়া যায়। পরবর্তী সময়ের চিন্তাবিদগণ কোনো না কোনভাবে লকের তত্ত্ব দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন। মন্টেস্কুর ক্ষমতা-স্বতন্ত্রীকরণ নীতি, মার্কসের মূল্যতত্ত্ব, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ ইত্যাদির ধারণা লকের তত্ত্ব থেকে জন্ম নিয়েছে। মানুষের চিন্তা ও প্রতিষ্ঠানের ওপর অন্য কোনো দার্শনিক লকের মতো এত প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হননি। সামাজিক, রাজনৈতিক এবং দার্শনিক প্রশ্নসমূহের প্রগতিশীল এবং বাস্তববাদী সমাধানে লকের চিন্তাধারার প্রভাব তৎকালীন সময়ে সুদূরপ্রসারী ছিল।


শিল্পায়ন বলতে কী বুঝ? শিল্পায়নের কী কী বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায়? আলোচনা কর।


উদারবাদী চিন্তাবিদ হিসেবে জন লকের মূল্যায়ন :

আমাদের বর্তমান আলোচনার মুখ্য বিষয় হলে একজন উদারবাদী চিন্তাবিদ হিসেবে জন লকের মূল্যায়ন। নিম্নলিখিত দিকসমূহ বিবেচনার মাধ্যমে এ বিষয়টি সম্পর্কে আলোচনা উত্থাপন করা হলো :


১. মানবপ্রকৃতি : জন লকের উদার চিন্তাধারার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো মানবপ্রকৃতি। তাঁর মতে, জন্মকালীন সময় মানুষের মন থাকে সাদা কাগজের ন্যায় কিন্তু পারিপার্শ্বিকতার প্রভাবে মানব চরিত্র কলুষিত হয়। পর্যায়ক্রমে মানুষ হয়ে উঠে স্বার্থপর ও আত্মকেন্দ্রিক।


২. প্রাকৃতিক অধিকার : শুধু মানবপ্রকৃতি বিশ্লেষণ করেই এ ক্ষণজন্মা দার্শনিক থেমে যাননি। তিনি ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন প্রকৃতির রাজ্য সম্পর্কেও। তাঁর মতে, প্রকৃতির রাজ্য হলো শান্তি, সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্যের স্থান। এখানে মানুষ সুখেশান্তিতে বসবাস করে। তিনি তাঁর প্রাকৃতিক অধিকার তত্ত্বের মাধ্যমে জীবন, স্বাধীনতা ও সম্পত্তি এ তিনটি অধিকারকে মানুষের পবিত্রতম অধিকার বলে ঘোষণা করে মানবজাতির ব্যাপক কল্যাণ সাধন করেছেন।


৩.নিয়মতান্ত্রিক গণতন্ত্র : জন লকের উদারপন্থি চিন্তাধারার অন্যতম দিক হলো নিয়মতান্ত্রিক গণতন্ত্র। তিনি সরকারকে শাসিতের সম্মতি ও সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসনের উপর প্রতিষ্ঠিত করে নিয়মতান্ত্রিক গণতন্ত্রকে একটি মজবুত ভিত্তিন্ন উপর দাঁড় করিয়েছেন। তাঁর এ তত্ত্বের দ্বারা তিনি স্বৈরাচারী শাসনের অবসান ঘটিয়েছেন এবং রাজাদের ঐশ্বরিক অধিকার তত্ত্বের বিলোপ সাধন করেছেন।


৪. সরকারের দায়িত্বশীলতা : জন লক সরকারের দায়িত্বশীলতার কথা উল্লেখ করেন। তাঁর মতে, জনগণের জীবন, স্বাধীনতা ও সম্পত্তি ইত্যাদি রক্ষার মৌলিক দায়িত্ব সরকারের। সরকার তাদের কাজের জন্য জনগণের নিকট দায়ী থাকবে। দায়িত্বহীনতার কারণে সরকারের পতন অবশ্যম্ভাবী হবে। শাসিতের পক্ষে মত দিয়ে এক্ষেত্রেও তিনি উদার চিন্তাধারার পরিচয় দেন।


৫. আইন বিভাগের শ্রেষ্ঠত্ব : জন লক আইন বিভাগের শ্রেষ্ঠত্বের কথা বলেছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি আইনের সপক্ষে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সংজ্ঞা হিসেবে বর্ণনা করে সংসদীয় রীতির কথাই পুনর্ব্যক্ত করেন। আইন বিভাগের কাছে নির্বাহী বিভাগকে দায়ী করে আধুনিক সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রথম পথিকৃতের গৌরব অর্জন করেছেন। তাঁর মত হলো, "আইনসভা হচ্ছে রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণের পুরোধা। আইনসভার সদস্যগণ জনগণের দ্বারা নির্বাচিত হতে হবে। একমাত্র তাহলেই আইনসভা কর্তৃক জনকল্যাণমূলক আইন প্রণয়ন সম্ভব।"


৬. ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি : লক ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির উপর গুরুত্বারোপ করেছেন। ফরাসি দার্শনিক মন্টেস্কু এ নীতির প্রবক্তা হলেও ব্যক্তি ও স্বাধীনতায় বিশ্বাসী লক রাষ্ট্রের সামগ্রিক কল্যাণার্থে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত না করে পৃথকীকরণের মাধ্যমে সামগ্রিকতা বজায় রাখার পক্ষপাতী ছিলেন। তাঁর ভাষায়, "The power of government naturally divided themselves into those which were legislative in character, those which were executive and those which were federative that in diplomatic."


৭. ধর্মীয় সহনশীলতা : ধর্ম ও নৈতিকতার প্রতি লক ছিলেন সহনশীল। ধর্মীয় ব্যাপারে তিনি রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ পছন্দ করতেন না। তাঁর মতে, রাষ্ট্রের কল্যাণ ও সংহতি রক্ষায় ধর্ম একটি নিছক ব্যক্তিগত ব্যাপার। তিনি ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলেছেন গণতন্ত্রের স্বার্থেই। এটি তার উদার মনমানসিকতারই পরিচয় বহন করে। তাঁর বক্তব্য হলো, “ধর্মান্ধতা রাষ্ট্রীয় ঐক্য জটিলতার সৃষ্টি করে, মানুষে মানুষে অবিশ্বাস গড়ে তোলে, ধর্মীয় উন্মাদনার মাধ্যমে মানুষ রাষ্ট্রের শৃঙ্খলাবিরোধী কার্যকলাপে লিপ্ত হতে পারে, যাতে গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক পরিবেশ বিঘ্নিত করার সমূহ সম্ভাবনা থাকে।


৮. সম্পত্তি সম্পর্কে মত : সম্পত্তি সংক্রান্ত মতবাদ জন লকের একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অবদান। তাঁর মতে, সম্পত্তির অধিকার হলো জনগণের প্রাকৃতিক অধিকার। তাঁর সম্পত্তি তত্ত্ব নানাভাবে সমালোচিত হলেও একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, এ তত্ত্বের মাধ্যমেই মধ্যবিত্ত শ্রেণির প্রভাব প্রতিপত্তি সুদৃঢ় করতে তিনি সক্ষম হন।


১. গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা : জন লককে বলা হয় গণতন্ত্রের জনক। স্বৈর শাসনের বিরুদ্ধে তিনি সোচ্চার ছিলেন। তাঁর মতে, “জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস।” তিনি জনগণের কল্যাণকামী শাসনব্যবস্থার উপর গুরুত্বারোপ করেছেন এবং সংসদীয় গণতন্ত্র কায়েমের কথা বলেছেন। এটি তার উদারতারই পরিচায়ক।


১০. স্বাধীনতা : স্বাধীনতা হলো জন লকের উদার চিন্তাধারার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। তাঁর মতে, রাষ্ট্র জনগণের স্বাধীনতা সংরক্ষণের ব্যবস্থা করবে। সরকারকে, প্রত্যেক মানুষকে তার সর্বোত্তম জীবন গড়ে তোলার সুযোগ দিতে হবে। নিরাপত্তা, মুক্তি, সুখ বা জাতীয় সংহতির চেয়ে স্বাধীনতাই অধিকতর মূল্যবান, এগুলো প্রত্যেক ব্যক্তির জীবনে অপরিহার্য বিষয়। মানুষ স্বাধীনভাবে জন্মগ্রহণ করবে এবং স্বাধীনভাবে বসবাস করবে।


উপসংহার :

উপর্যুক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, জন লকের বিভিন্ন তত্ত্বের যদিও কিছু সমালোচনা রয়েছে তথাপি রাষ্ট্রচিন্তা বা রাষ্ট্রদর্শনের ক্ষেত্রে তাঁর অবদান অবিস্মরণীয়। কেননা মানুষের চিন্তা ও প্রতিষ্ঠানের উপর অন্য কোনো দার্শনিক এত প্রভাব বিস্তার করতে পারেননি। রাষ্ট্রদর্শন সম্পর্কে তাঁর উদারনৈতিক চিন্তাধারা মূল্যায়ন করতে গিয়ে অধ্যাপক ওয়েপার বলেছেন, "He is the last great voice of one great tradition and first great voice of another great tradition.


#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Now
Ok, Go it!