ম্যাক্স ওয়েবারের কর্তৃত্ব (নেতৃত্ব) তত্ত্বটি আলোচনা কর ।

admin

 

ভূমিকা : জার্মান সমাজতত্ত্ববিদ ম্যাক্স ওয়েবার (Max Weber)তার The Theory of Social and Economic Organizations গ্রন্থে কর্তৃত্ব তথা রাজনৈতিক কর্তৃত্ব বিষয়ে আলোচনা করেছেন। তার মতে, কর্তৃত্ব হচ্ছে এক ধরনের ক্ষমতাগত সম্পর্ক, যেখানে শাসক অপরাপর জনগণের উপর নিজের ইচ্ছাকে চাপিয়ে দিতে পারে এ বিশ্বাস থেকে যে, ক্ষমতা ব্যবহারে তার অধিকার রয়েছে। আর শাসিত জনগোষ্ঠী শাসক ও তার আদেশ-নিষেধ-নির্দেশকে মেনে নেয় এ বিশ্বাস থেকে যে, শাসক তাদের সম্মত উপায়ে ক্ষমতার ব্যবহার করেছে। ম্যাক্স ওয়েবার কর্তৃত্বকে বৈধ ক্ষমতা নামে অভিহিত করেছেন। ক্ষমতা ব্যবহারের বৈধতার নিরিখে তিনি কর্তৃত্বকে তিন শ্রেণিতে বিভক্ত করেছেন। ক্ষমতা ব্যবহারের কর্তৃত্বগুলো হলো : (১) সাবেকী বা ঐতিহ্যগত কর্তৃত্বে (Traditional Authority), (২) ক্যারিসম্যাটিক বা সম্মোহনী বা বিমোহনী কর্তৃত্ব (Chaismatic Authority) ও (৩) আইনানুগ-যুক্তিসঙ্গত বা আইনানুগ আমলাতান্ত্রিক কর্তৃত্ব (Legal rational or Legal bureaucratic Authority)।


ম্যাক্স ওয়েবারের কর্তৃত্ব (নেতৃত্ব) তত্ত্বটি আলোচনা কর ।


ওয়েবারের কর্তৃত্ব তত্ত্ব : নিম্নে এ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :

১. সাবেকী বা ঐতিহ্যগত কর্তৃত্ব : সাবেকী বা ঐতিহ্যগত কর্তৃত্বের উদ্ভব ঘটে প্রাচীন সময়ে যখন কোন রাজা বা উপজাতীয় গোষ্ঠী প্রধানের মতো কোন ব্যক্তি দীর্ঘদিন ধরে ঐতিহ্যের জোরে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেন এবং বাকিরা ঐতিহ্যগতভাবেই তাকে মেনে চলে। কোন দেশের বংশানুক্রমিক শাসন ব্যবস্থা এর পর্যায়ভুক্ত। এখানে বহুদিনের ঐতিহ্যের অনুমোদনের মধ্যে কর্তৃত্ব বৈধতা লাভে সমর্থ হয়। ওয়েবারের মতে কর্তৃত্বের এরূপটিই 'সর্বজনীন' এবং 'আদিম' রূপ। অনেক আধুনিক রাষ্ট্রে রাজনৈতিক ঐতিহ্যের প্রভাব অপরিসীম। গ্রেট ব্রিটেন এর উদাহরণ। এখানে ঐতিহ্যবাহী রাজতন্ত্র আজো টিকে আছে। তবে এটি নিয়মতান্ত্রিক। এ ধরনের ব্যবস্থায় প্রথা ও রীতিনীতির প্রভাবও লক্ষণীয় । প্রচলিত রীতি অনুযায়ী রাজার ছেলে বা মেয়ে রাজা বা রাণী হলে স্বাভাবিকভাবে মেনে নেয়া হয় ।


২. সম্মোহনী কর্তৃত : শব্দগত অর্থে 'ক্যারিসমা (Charisma) হচ্ছে 'ঐশ্বরিক' বা 'সৃষ্টিকর্তার' দান। অর্থাৎ সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত অসাধারণ গুণাবলি ও ব্যক্তিগত গুণাবলির সমন্বয়ে গঠিত রাজনৈতিক কর্তৃত্ব হচ্ছে 'সম্মোহনী কর্তৃত্ব' বা Charismatic authority। কোন নির্দিষ্ট ব্যক্তির অসাধারণ ব্যক্তিগত গুণাবলি, বীরত্ব, চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ইত্যাদি দ্বারা জনগণ তার শিষ্যত্ব গ্রহণ করে তাকে নেতা হিসেবে মেনে তাঁর কর্তৃত্ব স্বীকার করে নেয়। ব্যক্তিগত সম্মোহনী ক্ষমতাই এখানে প্রয়োগের বৈধতা ও ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করে। সাধারণ সম্মোহনী কর্তৃত্বে ঐতিহ্য ও আইন দ্বারা সীমাবদ্ধ নয়।


এ ধরনের নেতৃত্ব বা কর্তৃত্ব বৈপ্লবিক ধরনের হয়। এ জাতীয় কর্তৃত্বের অধিকারী নেতাদের নেতৃত্বে স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে পৃথিবীর নানা দেশে। যেমন ভারতের মহাত্মা গান্ধী। আবার এ জাতীয় কর্তৃত্বের সাথে আনুষ্ঠানিক সরকারি। ক্ষমতার সমন্বয়ে রাজনৈতিক কর্তৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। যেমন-পাকিস্তানে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ। ইন্দোনেশিয়ায় আহমদ সুকর্ণ, বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রমুখ। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সম্মোহনী কর্তৃত্ব দীর্ঘস্থায়ী হয় না। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, উল্লিখিত সম্মোহনী কর্তৃত্বের নেতারা হয় নিহত হয়েছেন, নতুবা ক্ষমতাচ্যুত হয়েছেন।


৩. আইনানুগ যুক্তিসঙ্গত বা আইনানুগ আমলাতান্ত্রিক কর্তৃত্ব : আইনানুগ যুক্তিসঙ্গত কর্তৃত্ব বলতে এমন রাজনৈতিক কৰ্তৃত্বকে বুঝায় যেখানে কর্তৃত্ব কোন নির্দিষ্ট আইনের সুস্পষ্ট কাঠামোকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠে। কর্তৃত্ববান ব্যক্তিকে বা তার আদেশ-নির্দেশকে মেনে চলা হয়। কারণ, আইনের অনুমোদনের মাধ্যমে তিনি ক্ষমতা প্রয়োগ করেন। এখানে কর্তৃত্বের উৎস হচ্ছে রাজনৈতিক ও শাসনতান্ত্রিক বা সাংবিধানিক পদমর্যাদা । কোন ব্যক্তিগত গুণাবলি বা কৃতিত্ব নয়। ওয়েরার মনে করেন, আইনের আনুগত্যই হচ্ছে বৈধতার ভিত্তি (Legality is the usual basis of legitimacy)। কাজেই যে সকল নেতা আইনানুগ কাজ করবেন না তাদের বৈধতার বিষয়ে সন্দেহ দেখা দিবে। আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় আমালাতন্ত্র হচ্ছে আইনানুগ কর্তৃত্বের উৎকৃষ্ট উদাহরণ। এ জাতীয় কর্তৃত্ব সাধারণত স্থিতিশীল প্রকৃতির হয়।


ম্যাক্স ওয়েবারের মতে, উল্লিখিত তিন প্রকার কর্তৃত্বের কোনটিকেই বিশুদ্ধ রূপে পাওয়া সম্ভব নয়। তিনি এ ধরনের কর্তৃত্বকে 'আদর্শ নমুনার' (Ideal types) তত্ত্ব বলে চিহ্নিত করেছেন। মিশ্র রাজনৈতিক কর্তৃত্বের উপরই তিনি প্রকৃত পক্ষে জোর দিয়েছেন। কারণ তিন প্রকার কর্তৃত্বের কোন একটিরও অবিকল বা অবিমিশ্র রূপ পরিলক্ষিত হয় না। বাস্তরে এর মিশ্ররূপ ব্রিটেনে লক্ষ করা যায়। ব্রিটেনে রাজতন্ত্র হচ্ছে সাবেকী বা ঐতিহ্যগত কর্তৃত্বের উপাদান, প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভা আইনানুগ কর্তৃত্বের উপাদান (ক্যারিসমা থাকতেও পারে) এবং অমলাতন্ত্র পরিপূর্ণ রূপে আইনানুগ যুক্তিসঙ্গত উপাদানের উপর প্রতিষ্ঠিত ।


ওয়েবারের মতে, ব্যক্তিগত গুণের উপর প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক কর্তৃত্ব অন্য দু'প্রকার কর্তৃত্বের তুলনায় দুর্বল ও অস্থায়ী। অনেকের মতে এ তিন প্রকার কর্তৃত্বের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। প্রথম ও দ্বিতীয় প্রকার কর্তৃত্ব আদেশ দানের অধিকার এবং তৃতীয় প্রকার কর্তৃত্ব আদেশ ঘোষণা করার দক্ষতার উপর নির্ভরশীল।


উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, ম্যাক্স ওয়েবারের এ আদর্শ নমুনার কর্তৃত্ব মিশ্র বলেই একে বা এর গুরুত্বকে অস্বীকার করা যায় না। পুরোপুরি বাস্তবায়নযোগ্য না হলেও তার এ মানদণ্ড ব্যবহার করে রাজনৈতিক ব্যবস্থার কর্তৃত্বের তুলনামূলক আলোচনা করা যায় এবং ভালো দিকগুলো গ্রহণ করা যায়। এ জন্যই ওয়েবারের কর্তৃত্ব তত্ত্ব উপকারী এবং ফলপ্রসূ একটি বিষয়। 


#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Now
Ok, Go it!