গণতন্ত্রের সফলতার পূর্বশর্তগুলো আলোচনা কর।

admin

 

ভূমিকা : গণতন্ত্র আধুনিক বিশ্বে সবচেয়ে সমাদৃত র শাসনব্যবস্থা। খ্রিষ্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীতে গ্রিস দেশে সর্বপ্রথম ‘গণতন্ত্র' শব্দটি ব্যবহৃত হয়। সে সুদূর অতীতকাল থেকে আজ | পর্যন্ত নতুন ধ্যানধারণা একে প্রভাবিত করেছে। এর ফলে গণতন্ত্র সম্পর্কে ধারণা আরো জটিল রূপ গ্রহণ করেছে। এ কারণে Mobbott মন্তব্য করেছেন যে, "Democracy is the most  elusive and ambiguous of all political terms." তবুও আধুনিক বিশ্বে জনপ্রিয়তার দিক দিয়ে গণতন্ত্রের স্থান সর্বোচ্চে। র গোটা বিশ্ব আজ গণতন্ত্রের জয়গানে মুখর। সাম্য, মৈত্রী ও া স্বাধীনতার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত বলে গণতন্ত্র মানুষকে মর্যাদা গৌরবের আসনে প্রতিষ্ঠা করেছে ।

অথবা,গণতন্ত্রের সফলতার পূর্বশর্তগুলো আলোচনা কর।


গণতন্ত্রের সফলতার শর্তসমূহ : তত্ত্বগত বিচারে গণতন্ত্র | আদর্শ ও সর্বোৎকৃষ্ট শাসনব্যবস্থা হিসেবে রাজনৈতিক চিন্তাজগতে স্বীকৃত। তবে এর সাফল্যের জন্য কতকগুলো শর্ত পালন করা আবশ্যক। নিম্নে শর্তগুলো আলোচনা করা হলো :


১. গণতান্ত্রিক জনগণ : গণতন্ত্রকে সাফল্যমণ্ডিত করতে 8 হলে সর্বার্থে যে জিনিসটির প্রয়োজন তাহলো জনগণের মধ্যে গণতান্ত্রিক ধারণার উপস্থিতি। Ivor Brown গণতান্ত্রিক ধারণাকে 'An action of will বলে উল্লেখ করেছেন গণতান্ত্রিক চেতনাই জনগণকে শাসনকার্যে অংশগ্রহণের জন্য উৎসাহিত করে। আবার গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা তার সাফল্যের জন্য নাগরিকদের কাছে বিশেষ যোগ্যতাও দাবি করে। এর পরিবর্তে নাগরিকরাও সমৃদ্ধ জীবনের সন্ধান পায়। লর্ড ব্রাইস মন্ত ব্য করেছেন, "No government demands so much from citizens as democracy and nonages so much back."


২. একাধিক রাজনৈতিক দল : গণতন্ত্রের সাফল্যে একাধিক রাজনৈতিক দল এবং বিরোধী দলের ভূমিকা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। একাধিক রাজনৈতিক দল ছাড়া গণতন্ত্র চলতে পারে না। এছাড়া একটি শক্তিশালী বিরোধী দল থাকলে সরকার সবসময় সতর্ক থাকে এবং জনস্বার্থ সাধনে আত্মনিয়োগ করতে বাধ্য হয়।


৩. গণতান্ত্রিক পরিবেশ : মানুষের ব্যক্তিসত্তার পরিপূর্ণ বিকাশের উপযোগী পরিবেশই হলো গণতান্ত্রিক পরিবেশ। এর জন্য প্রয়োজন সকল সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অধিকারের স্বীকৃতি ও সংরক্ষণ। সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বৈষম্য এবং অন্যায় ও শোষণ গণতন্ত্রের সমাধি রচনা করে। সুতরাং সমাজতান্ত্রিক তথা গণতান্ত্রিক পরিবেশ ছাড়া গণতন্ত্রের সাফল্য সুনিশ্চিত হতে পারে না।


৪. আইনের শাসন : গণতন্ত্রের সফলতার একটি অন্যতম শর্ত হলো আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা। আইনের চোখে সবাইকে সমানভাবে দেখতে হবে। এতে সকলে সমান অধিকার ভোগ করতে পারবে এবং গণতন্ত্র সফল হবে।


৫. গণতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থা : গণতন্ত্রের সাফল্যের জন্য জনগণের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা একান্তভাবে অপরিহার্য। দারিদ্র্য এবং অর্থনৈতিক বৈষম্য হলো গণতন্ত্রের প্রধান বাধা। শোষিত ও বঞ্চিত ব্যক্তির নিকট অধিকার, কর্তব্য ও স্বাধীনতা মূল্যহীন ও অবান্তর। অধ্যাপক লাস্কির মতে, "Political democracy is meaningless without economic democracy." সুতরাং অর্থনৈতিক সাম্য এবং জনগণের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি গণতন্ত্রের সাফল্যের সহায়ক।


৬. যোগ্য নেতৃত্ব : রাজনৈতিক নেতৃবর্গের ন্যায়নীতি ও বিবেকবোধের ওপর গণতন্ত্রের সাফল্য বহুলাংশে নির্ভরশীল। স্বার্থপর ও স্বেচ্ছাচারী নেতৃত্ব গণতন্ত্রের কবর রচনা করে। এছাড়া দুর্বল নেতৃত্বের কারণে বহু দেশেই গণতন্ত্র আজ বিপদের সম্মুখীন এ হয়েছে। এ কারণে রাষ্ট্রীয় নেতাগণের ন্যায়পরায়ণতা, সততা, উদারচিত্ত, বিবেক প্রভৃতি গুণাবলি গণতন্ত্রের সাফল্যের পূর্বশর্ত হিসেবে গণ্য হয়।


৭. সৎ ও দক্ষ সরকারি কর্মচারী : গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার সাফল্যের জন্য সৎ, সুদক্ষ ও উৎসাহী সরকারি কর্মচারী আবশ্যক। গণতন্ত্রে প্রশাসনিক দায়দায়িত্ব জনগণের ভাষা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ওপর ন্যস্ত থাকলেও বাস্তব ক্ষেত্রে স্থায়ী সরকারি কর্মচারিগণই হলো প্রশাসন যন্ত্রের যন্ত্রী। সুতরাং তাদের সততা, গুণগত যোগ্যতা এবং উৎসাহ উদ্দীপনার ওপর গণতান্ত্রিক সরকারের সাফল্য বিশেষভাবে নির্ভরশীল।


৮. উপযুক্ত শিক্ষা : শিক্ষার ব্যাপক বিস্তারকে গণতন্ত্রের  সাফল্যের মূলমন্ত্র হিসেবে গণ্য করা হয়। গণতন্ত্র হলো সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের শাসন। আর জনগণের অধিকাংশ যদি অশিক্ষিত হয় তবে তাদের পক্ষে যোগ্য ও বিজ্ঞ প্রতিনিধি নির্বাচিত করা সম্ভব হয় না। ফলে অজ্ঞ ও অযোগ্য ব্যক্তির হাতে পড়ে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। সেজন্য বলা হয়, প্রতিনিধিত্বমূলক শাসনব্যবস্থায় সাফল্যের জন্য জনগণের মধ্যে | শিক্ষার ব্যাপক বিস্তার প্রয়োজন।


৯. জনমত : গণতন্ত্রের সাফল্যের জন্য আর একটি অপরিহার্য শর্ত হলো সুস্থ, সবল ও সদাজাগ্রত জনমত। সদাসতর্ক এবং সক্রিয় জনমত সরকারের স্বৈরাচারিতা রোধ করে এবং সরকারকে গণমুখী করে। তাই গণতন্ত্রের সাফল্য জনমতের ওপর বহুলাংশে নির্ভরশীল।


১০. সহিষ্ণুতা : পরমতসহিষ্ণুতা গণতন্ত্রের প্রাণ। গণতন্ত্র সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন। এ শাসনব্যবস্থাকে সফল করতে হলে সংখ্যালঘিষ্ঠরা যেমন সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন মেনে নেবে, তেমনি সংখ্যাগরিষ্ঠকেও সংখ্যালঘু তথা বিরোধী দলের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও সহিষ্ণু মনোভাব পোষণ করতে হবে। এজন্য বলা হয়ে থাকে, "Majority must be granted, Minority | should be respected. "


১১. সংখ্যালঘুর প্রতিনিধিত্ব : JS. Mill এর মতে, গণতন্ত্রকে সার্থক করে তোলার জন্য সংখ্যালঘুর প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থা থাকা দরকার। কারণ জনগণের একটি বিরাট অংশ সরকারি সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া থেকে দূরে থাকলে গণতান্ত্রিক সরকার সফল হতে পারে না। তাই গণতন্ত্রের সাফল্যের জন্য | সংখ্যালঘুর প্রতিনিধিত্ব প্রয়োজন।


১২. ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ : গণতন্ত্রের সাফল্যের জন্য ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণকে অন্যতম শর্ত হিসেবে গণ্য করা হয়। ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে জনগণ রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষেত্রে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণের সুযোগ পায়। অধ্যাপক ব্রাইস (Prof. Bryce) যথার্থই বলেছেন, "Democracy needs local self | government as its foundation." স্বায়ত্তশাসন ব্যবস্থার মাধ্যমে প্রশাসনিক ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ ঘটে। আর জনসাধারণ স্থানীয় শাসনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণে ব্যাপক সুযোগ পায় ।


১৩. লিখিত সংবিধান : হেনরি মেইন, লেকি প্রমুখ রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতানুসারে, সংবিধান লিখিত হলে জনসাধারণ | সরকারের কর্তৃত্বের পরিধি এবং নিজেদের অধিকার ও কর্তব সম্পর্কে অবহিত থাকতে পারে। ফলে জনগণ সতর্ক থাকে এবং সরকার স্বৈরাচারী হতে পারে না। গণতন্ত্রের সাফল্যের জন্য তাই লিখিত সংবিধানের যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে।


১৪. গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য : গণতন্ত্রের সাফল্যের স্বার্থে গণতান্ত্রিক ঐতিহ্যের উল্লেখযোগ্য প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার স্বরূপ ও সার্থকতা সঠিকভাবে অনুধাবন করার ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য জনসাধারণকে সাহায্য করে। সুতরাং গণতান্ত্রিক আদর্শ ও নীতির সাথে জনগণের বহুদিনের পরিচয় থাকলে অর্থাৎ গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য গড়ে উঠলে গণতন্ত্রের সফল প্রতিষ্ঠা সম্ভব।


১৫. সামাজিক ঐক্য : গণতন্ত্রের সফলতার জন্য সামাজিক তথা জাতীয় সংহতি ও ঐক্য আবশ্যক। J. S. Mill এর মতানুসারে, জাতীয় ভিত্তিতে রাষ্ট্র গঠন গণতন্ত্রের বিকাশের হ পক্ষে সহায়ক। তাই জনগণের মধ্যে জাতীয় ও সামাজিক সু ঐক্যবোধ ছাড়া গণতন্ত্র সফল হতে পারে না ।


উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, গণতন্ত্রকে বাস্তবে কার্যকর করে তুলতে হলে বহুবিধ শর্ত পালন করতে হয়। তবে সকল শর্তের মধ্যে সবচেয়ে বড় শর্ত হলো জনগণ। J. S. Mill অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে বলেছেন যে, জনগণকে গণতন্ত্র গ্রহণ করতে, এর সংরক্ষণে প্রয়োজনীয় ত্যাগ স্বীকার করতে এবং তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে এগিয়ে আসতে হবে। তাহলেই কেবল একটি দেশে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা সাফল্য অর্জন করতে পারে ।


#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Now
Ok, Go it!