“মার্কিন সিনেট পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী দ্বিতীয় কক্ষ”- ব্যাখ্যা কর।

admin

 

ভূমিকা : মার্কিন আইনসভার নাম কংগ্রেস। বিশ্বের অন্যান্য যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থার মতো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় আইনসভা কংগ্রেসও দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট। এর উচ্চ কক্ষের নাম সিনেট এবং নিম্ন কক্ষের নাম প্রতিনিধি সভা। সিনেটের প্রতিনিধিগণ অঙ্গরাজ্যসমূহ থেকে নির্বাচিত হন। তাই এ .কক্ষকে অঙ্গরাজ্যসমূহের প্রতিনিধিত্বমূলক কক্ষও বলা হয়ে থাকে ।



রাজনৈতিক সংগঠন এবং ব্রিটেন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক সিনেটের ক্ষমতা ও কার্যাবলি :


সিনেট আইন, শাসন ও বিচারসংক্রান্ত কতকগুলো বিষয়ে এমন অসাধারণ ক্ষমতা ভোগ করে, যা সিনেটকে বিশ্বের সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী দ্বিতীয় কক্ষের নি মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করেছে। সিনেটের ক্ষমতা ও কার্যাবলি - আলোচনা করলেই এর প্রমাণ পাওয়া যায়। সিনেট যেসব ক্ষমতা ও কার্যাবলির জন্য সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী দ্বিতীয় কক্ষ বলা হয় তা নিম্নরূপ :


১. আইনসংক্রান্ত ক্ষমতা : আইনের ক্ষেত্রে সিনেটের যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। সকল প্রকার সাধারণ বিল সিনেটে প্রথম উত্থাপিত হয়। সিনেটের অনুমোদন ছাড়া কোনো বিলই পাস হয়। না। কোনো বিল যদি সিনেট কর্তৃক প্রত্যাখ্যান হয়, তবে তা আইনে পরিণত হওয়ার আর কোনো সুযোগ থাকে না। তবে অর্থসংক্রান্ত কোনো বিল প্রথমে সিনেটে উত্থাপন করা যায় না। প্রতিনিধি সভার অনুমোদনের পর বিলটি সিনেটে পাঠানো হয়। তথাপিও শিরোনাম ছাড়া সিনেট বিলের বাকি অংশের আমূল পরিবর্তন করতে পারে।


২. শাসনসংক্রান্ত ক্ষমতা : সরকারি কর্মচারী নিয়োগের ক্ষেত্রেও মার্কিন সিনেট ব্যাপক ক্ষমতা ভোগ করে। সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি, মন্ত্রিসভার সদস্য, পদস্থ কর্মচারী, রাষ্ট্রদূত, বাণিজ্যিক প্রতিনিধি প্রভৃতি উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারীদের নিয়োগের ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে ন্যস্ত থাকলেও সিনেটের অধিকাংশ সদস্যের অনুমোদন ছাড়া ঐ নিয়োগ কার্যক, হয় না। কার্যত সিনেটই নিয়োগসংক্রান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে আর রাষ্ট্রপতি সে সিদ্ধান্তকে অনুমোদন ও কার্যকর করেন। এ প্রসঙ্গে Allen Potter, "The cheek so developed into the system of organized political blackmail known as, senatorial courtesy."


৩. পররাষ্ট্রসংক্রান্ত ক্ষমতা : রাষ্ট্রপতি সাধারণত বৈদেশিক ও সামরিকসংক্রান্ত যে কোনো বিষয়ে সিনেটের Foreign Relations Committee' এর পরামর্শ গ্রহণ করে। থাকেন। রাষ্ট্রপতি কর্তৃক সম্পাদিত যে কোনো বৈদেশিক চুক্তি বা সন্ধি সিনেটের অনুমোদন সাপেক্ষ সিনেটের দুই- তৃতীয়াংশ সদস্যের অনুমোদন ছাড়া কোনো আন্তর্জাতিক চুক্তি বা সন্ধি কার্যকর করা সম্ভব নয়। এসব বিষয়ে সিনেটের অনুমোদন এতই গুরুত্বপূর্ণ যে, প্রেসিডেন্ট উইলসন কর্তৃক স্বাক্ষরিত ‘ভার্সাই চুক্তি' এবং 'লীগ অব নেশন্স' এর চুক্তি সিনেটের অনুমোদনের অভাবে স্বাক্ষরিত হওয়া সত্ত্বেও কার্যকরী হয়নি।


৪. নির্বাচনসংক্রান্ত ক্ষমতা : মার্কিন সংবিধান অনুসারে উপরাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ক্ষমতা সিনেটের হাতে ন্যস্ত। এ নির্বাচনের কোনো প্রার্থী নির্বাচকমণ্ডলীর নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোট না পেলে সিনেট অধিক ভোট প্রাপ্ত প্রথম দু'জন প্রার্থীর মধ্যে থেকে একজনকে উপরাষ্ট্রপতি নির্বাচন করেন।


৫. বিচারসংক্রান্ত ক্ষমতা : সিনেট গুরুত্বপূর্ণ বিচারবিষয়ক ক্ষমতার অধিকারী। মার্কিন রাষ্ট্রপতি, উপ-রাষ্ট্রপতি এবং উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারীদের বিরুদ্ধে প্রতিনিধি সভা কোনো ‘অভিশংসন প্রস্তাব' আনলে সংবিধানের ৩নং ধারার ৬নং উপধারা অনুযায়ী সিনেটই ঐ অভিযোগের সন্ধান ও বিচার করেন। সিনেটের দুই-তৃতীয়াংশের সদস্যের ভোটে 'অভিশংসন' প্রস্তাব পাস হলেই অভিযুক্ত কর্মকর্তা পদ থেকে অপসারিত হতে বাধ্য।


৬. তদন্ত ক্ষমতা : শাসনসংক্রান্ত বিষয়ে তদন্ত বা অনুসন্ধান পরিচালনা করা সিনেটের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। সিনেটের তদন্ত কমিটি সরকারি কর্মচারীদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের অথবা প্রশাসনিক বিষয়ের তদন্ত চালাতে পারেন। অতএব এস. জে.সি. ভিল এর মতে, "The senate is the most powerful and certainly the most prestigious of the | American legislature.'


সিনেটের উপর্যুক্ত ক্ষমতা ও কার্যাবলির পর্যালোচনা থেকে সহজেই অনুধাবন করা যায় যে, সিনেট আইনসভার একটি শক্তিশালী কক্ষ। এছাড়া আরো কতকগুলো কারণে এটি অধিক শক্তিশালী কক্ষে পরিণত হয়েছে। সেগুলো নিয়ে আলোচিত হলো:


১. সিনেটের মেয়াদকাল দীর্ঘ : সিনেটের সদস্যদের কার্যকাল ছয় বছর ফলে তারা অধিক সময় সরকারি নীতিনির্ধারণ ও তাদের প্রভাব প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠায় সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করতে পারেন। এছাড়া সিনেট একটি স্থায়ী পরিষদ এবং এটি কখনো একসাথে ভেঙে যায় না। এ স্থায়িত্ব সিনেটকে শক্তিশালী করে তুলেছে।


২. সিনেটের সদস্যসংখ্যা স্বল্প : সিনেটের সদস্যসংখ্যা মাত্র একশত। সদস্যসংখ্যা স্বল্প বলে তারা ব্যাপক আলোচনার মাধ্যমে যে কোনো সিদ্ধান্ত দ্রুত নিতে পারেন। তাই জনগণের নিকট সিনেট অধিক গ্রহণযোগ্য কক্ষ।


৩. প্রত্যক্ষ নির্বাচন : সিনেটের সদস্যগণ জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হন। এরূপ নির্বাচন ব্যবস্থা সদস্যদের মর্যাদা বৃদ্ধিতে খুবই সহায়ক হয়েছে এবং তাদের ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি বিস্তারে সহায়তা করেছে।


৪. অভিজ্ঞ ও প্রবীণ সদস্যদের নিয়ে গঠিত কক্ষ : দলের মধ্যে অভিজ্ঞ, সুযোগ্য ও প্রবীণ রাজনীতিবিদদেরকেই সিনেটের সদস্য নির্বাচন করা হয়। এজন্য সিনেটকে প্রবীণদের কক্ষও বলা হয়। সুতরাং সিনেটের মর্যাদা খুবই বেশি।


৫. সচেতন মনোভাব : সিনেটের সকল সদস্যই তাদের নিজ কক্ষের মর্যাদা ও ক্ষমতা রক্ষার ব্যাপারে খুবই সচেতন। এ উদ্দেশ্যে অনেক ক্ষেত্রে তারা দলীয় রাজনীতির কথা চিন্তা না করে এক দলের সদস্য অন্য দলের প্রস্তাবও সমর্থন করেন ।


বিশ্বের সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী দ্বিতীয় কক্ষ হিসেবে সিনেট আমেরিকার সিনেট শুধু প্রতিনিধি সভা থেকেই বেশি ক্ষমতা ভোগ করে না, বরং পৃথিবীর অন্যান্য দেশের দ্বিতীয় কক্ষের তুলনায় এত বেশি ক্ষমতাশালী যে, সিনেটকে বিশ্বের সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী দ্বিতীয় কক্ষ বলা হয়।


সিনেটকে বিশ্বের সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী দ্বিতীয় কক্ষ বলার কারণসমূহ নিম্নে উল্লেখ করা হলো :


১. আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে : রাশিয়া ও সুইজারল্যান্ডের আইনসভার উভয় কক্ষ সমক্ষমতাসম্পন্ন। ভারত ও ব্রিটেনের উচ্চকক্ষ নিম্নকক্ষ অপেক্ষা দুর্বল। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চকক্ষ সিনেট নিম্ন কক্ষ প্রতিনিধি সভার চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী। এছাড়া অর্থবিলের উপর সিলেটের যে ক্ষমতা রয়েছে ভারত, ব্রিটেনের এবং আরো অনেক রাষ্ট্রের উচ্চ কক্ষের সেরূপ ক্ষমতা নেই। এজন্য J. P. Harris বলেছেন, "The United chamber of any legislature in the world." States senate is by all odds the most powerful upper


২. প্রশাসনিক ক্ষেত্রে : ভারত ও ব্রিটেনের সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা আইনসভার নিম্ন কক্ষের হাতে ন্যস্ত। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সিনেট রাষ্ট্রপতি কর্তৃক কোনো নিয়োগ বৈদেশিক চুক্তি অনুমোদন না করলে তা কার্যকরী হয় না। অন্য কোনা দেশের দ্বিতীয় কক্ষকে এরূপ ক্ষমতা দেওয়া হয়নি ।


৩. বিচারের ক্ষেত্রে : সিনেট প্রতিনিধি সভা কর্তৃক অভিযুক্ত ব্যক্তিদের অভিযোগ অনুসন্ধান ও বিচার করে থাকেন। কিন্তু ভারতের উচ্চ কক্ষ অভিযোগ আনলে নিম্ন কক্ষ তার বিচার করে। সুতরাং সিনেটের বিচারসংক্রান্ত ক্ষমতা ভারতের উচ্চ কক্ষের তুলনায় অনেক বেশি।


উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আইনসভা কংগ্রেসের উচ্চ কক্ষ সিনেট একটি শক্তিশালী কক্ষ। তাছাড়া বিভিন্ন দেশের উচ্চ কক্ষের সাথে তুলনামূলক আলোচনাতে দেখা যায় যে, সিনেট বিশ্বের সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী দ্বিতীয় কক্ষ। এ কারণে Prof. C.F Strong বলেছেন, "The powers of the senate are very great probably no second chamber in the world today has an influence so real and direct. "


#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Now
Ok, Go it!