বাংলাদেশের অর্থনীতি কি পশ্চাৎপদ - আলোচনা কর।

admin

ভূমিকা :

বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ। এ দেশের অর্থনীতি স্থবির নয়, গতিশীল। তবুও এ দেশের জনগণ তাদের মৌলিক চাহিদা যেমন- অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা ও অন্যান্য সামাজিক সুবিধা হতে বঞ্চিত।  সরকার এখন পর্যন্ত এ দেশের জনগণের এ সমস্ত মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম হয় নি। আবার উন্নত দেশসমূহ যেমন- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া এবং পশ্চিম ইউরোপের জনগণের মাথাপিছু আয় বাংলাদেশের তুলনায় অনেক বেশি এবং এসব দেশের জনগণ সম্পূর্ণভাবে তাদের মৌলিক চাহিদা ও সামাজিক সুযোগসুবিধা ভোগ করে। এসব আলোচনায় বলা যায়, বাংলাদেশের অর্থনীতি পশ্চাৎপদ।

বাংলাদেশের অর্থনীতি কি পশ্চাৎপদ

বাংলাদেশের অর্থনীতি পশ্চাৎপদ :

বাংলাদেশের অর্থনীতি পশ্চাৎপদ কি না তা উন্নত দেশের অর্থনীতির আর্থসামাজিক বৈশিষ্ট্যসমূহ পর্যালোচনা করার মাধ্যমে জানা সম্ভব। নিম্নে বাংলাদেশের অর্থনীতির আর্থসামাজিক বৈশিষ্ট্যসমূহ আলোচনা করা হল -


১. স্বল্প মাথাপিছু আয় : বাংলাদেশের জনগণের জীবনযাত্রার মান নিম্ন হওয়ায় মাথাপিছু আয়ের পরিমাণ অত্যন্ত অল্প। মার্কিন ডলারের হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশের বর্তমান মাথাপিছু আয়ের পরিমাণ ১১৯০ মার্কিন ডলার। অন্যান্য দেশের তুলনায় এ সংখ্যা অতি নগণ্য।


বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রতিবন্ধকতা দূরীকরণে তোমার পরামর্শ প্রদান কর


২. নিম্ন জীবনযাত্রার মান : বাংলাদেশের মানুষের  জীবনযাত্রার মান খুব নিম্ন। দরিদ্রতা ও স্বল্প মাথাপিছু আয়ের যা কারণে জীবনযাত্রার মান খুব নিম্ন। শহরাঞ্চলে যত্রতত্র বস্তি গড়ে উঠায় সেখানকার জনস্বাস্থ্যের অবনতি ঘটছে। খাদ্য, বস্ত্র,  বাসস্থান প্রভৃতি মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে বহু মানুষ। স্বাস্থ্য বিজ্ঞান অনুযায়ী একজন সুস্থ লোকের দৈনিক ৩,০০০ কিলোক্যালরি থেকে ৩৫০০ কিলোক্যালরি খাদ্য গ্রহণ করা দরকার। সেখানে বাংলাদেশের মানুষের দৈনিক গড় খাদ্য গ্রহণের পরিমাণ মাত্র ১৫০০ কিলোক্যালরি।


৩. কৃষির উপর অতি নির্ভরশীলতা : বাংলাদেশের অর্থনীতি কৃষির উপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল এবং কৃষিতে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহৃত না হওয়ায় কৃষি উৎপাদন কম। ফলে জাতীয় উৎপাদন কম হয়। সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী বর্তমানে বাংলাদেশের শতকরা ৪৭.৫ ভাগ মানুষ কৃষির উপর নির্ভরশীল।


৪. বৈদেশিক সাহায্যের উপর অতি নির্ভরশীলতা : উন্নয়নশীল দেশগুলো অতিমাত্রায় বৈদেশিক ঋণ সাহায্যের উপর নির্ভরশীল। বর্তমান বাংলাদেশও বৈদেশিক ঋণ, সাহায্যের উপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল। প্রত্যেক বছরের বাজেটের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ আসে বৈদেশিক ঋণ সাহায্যের মাধ্যমে।


বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের মুখ্য সমস্যাসমূহ বর্ণনা কর


৫. মূলধনের স্বল্পতা : বাংলাদেশের জনগণের মাথাপিছু আয় কম বলে সঞ্চয় প্রবণতা কম। সে কারণে কাঙ্ক্ষিত হারে মূলধন গঠিত হচ্ছে না।


৬. শিল্পে অনগ্রসরতা : স্বল্প মূলধন এবং দক্ষ উদ্যোক্তার অভাবে বাংলাদেশে শিল্পায়নের গতি ত্বরান্বিত হচ্ছে না। ব্যাপক শিল্পায়ন ছাড়া বর্তমানে কোন দেশের পক্ষেই অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধন করা সম্ভব নয়। মূলধনের স্বল্পতা, কাঁচামালের অভাব, কারিগরি জ্ঞানের অভাব প্রভৃতি কারণে বাংলাদেশে শিল্পায়নের গতি অত্যন্ত মন্থর।


৭. জনসংখ্যার বিশালায়তন : জনসংখ্যার বিশালায়তনের কারণে আমাদের সকল উন্নয়ন প্রচেষ্টা ব্যাহত হচ্ছে। ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী বাংলাদেশে প্রতি বর্গকিলোমিটারে | ১০১৫ জন লোক বসবাস করছে এবং প্রতি বছর ১.৩৭% হারে বেড়ে এর পরিমাণকে আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। দেশের এ বাড়তি লোকের ভরণপোষণ করতে গিয়ে দেশের অর্থনৈতিক দৈন্যতা আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে।


৮. ক্ৰমবৰ্ধমান বেকারত্ব :  বাংলাদেশে বেকার সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করছে। বর্তমানে মোট কর্মক্ষম লোকের প্রায় ৩৩% বেকার। কৃষিতে অতিরিক্ত লোকের চাপে যে উদ্বৃত্ত শ্রমিক সৃষ্টি হচ্ছে তা আবার কাঙ্ক্ষিত হারে শিল্পোন্নয়ন না হওয়ায় এ উদ্বৃত্ত শ্রমিক বেকারে পরিণত হচ্ছে।


বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে রাষ্ট্র ভূমিকা আলোচনা কর


৯. প্রাযুক্তিক অনগ্রসরতা : বর্তমান যুগ প্রযুক্তির যুগ। কিন্তু আমাদের দেশ এখনও প্রযুক্তির আর্শিবাদে পরিস্ফুটিত হয়ে উঠতে পারে নি। কৃষি ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হচ্ছে মান্ধাতার আমলের প্রযুক্তি। ফলে কৃষি উৎপাদন অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক কম ।


১০. কারিগরি জ্ঞানের অভাব : স্বপ্ন আয়, জীবনযাত্রার নিম্নমান ও দেশের কারিগরি শিক্ষা কেন্দ্রের অভাবে বাংলাদেশের শ্রমিকদের কর্মকুশলতা অত্যন্ত নিম্নমানের। কুশলি লোকের অভাব আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্তরায়।


১১. শিক্ষার নিম্নহার : বাংলাদেশের শিক্ষার হার অত্যন্ত নিম্ন। দেশের অধিকাংশ লোক এখনও অশিক্ষিত, কুসংস্কারাচ্ছন্ন। যারা লিখতে ও শুধু পড়তে পারে তাদের সংখ্যা হল ৬৫%। আর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার হার আরও কম। শিক্ষার এ নিম্নহারের কারণে এ দেশটি অর্থনৈতিক পশ্চাৎপদতার অবস্থান করছে।


১২. প্রাকৃতিক সম্পদের অপূর্ণ ব্যবহার : এ দেশ প্রাকৃতিক  সম্পদে সমৃদ্ধ না হলেও যতটুকু প্রাকৃতিক সম্পদ রয়েছে বলে । জানা গেছে তার প্রায় অধিকাংশই মূলধনের অভাব, কারিগরি জ্ঞান ও উদ্যোক্তার অভাবে পূর্ণভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে না। আবার |যথোপযুক্ত প্রাযুক্তিক সুবিধা না থাকায় আবিষ্কৃত ও অনাবিষ্কৃত | প্রাকৃতিক সম্পদ উত্তোলন করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে প্রাকৃতিক সম্পদ অব্যবহৃত থাকছে।


১৩. অনুন্নত অবকাঠামো : এদেশের অর্থনৈতিক অবকাঠামো যেমন- বিদ্যুৎ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা, বাঁধ এখন পর্যন্ত অনুন্নত। অনেক নদনদী আবার পলি জমে ভরাট হয়ে যাওয়ায় শুকনা মৌসুমে নৌ চলাচল বাছিত হয়। ব্যবসায় বাণিজ্যের অসুবিধা হয়। ফলে দেশের কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন সাধিত হয় না।


বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের উপায়সমূহ কী কী


১৪. বৈদেশিক বাণিজ্যের উপর অতি নির্ভরশীলতা : অন্যান্য অনুচ্যুত দেশের ন্যায় বাংলাদেশও অতিমাত্রায় বৈদেশিক বাণিজ্যের উপর নির্ভরশীল। বাংলাদেশের তৈরি পোশাকসহ  মুরিদের কয়েকটি কাঁচামাল ও খাদ্যশস্য রপ্তানি করে। কিন্তু ইরানি অপক্ষা বাংলাদেশকে আমদানি করতে হয় বেশি। এ | বৈদেশিক বাণিজ্যের ভারসাম্য সর্বদা প্রতিকূলে থাকে।


১৫. উদ্যোক্তার অভাব : অনুন্নত দেশগুলোর অর্থনৈতিক পশ্চাৎপদতার অন্যতম বৈশিষ্ট্যকরণ হল দক্ষ উদ্যোকা শ্রেণীর অভাব। বাংলাদেশে এখনও তেমন উল্লেখযোগ্য পরিমাণে উদ্যোক্তা শ্রেণী গড়ে উঠেনি। পাকিস্তান আমলে এদেশের উদ্যোক্তার পরিমাণ ছিল মাত্র ২২টি পরিবার। সে তুলনায় এখন বৃদ্ধি পেলেও তা যথেষ্ট নয়।


১৬. দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র : বাংলাদেশের অর্থনীতি দারিদ্রোর দুষ্টচক্রে আবদ্ধ হয়ে ঘুরপাক খাচ্ছে। স্বল্প মাথাপিছু আয়ের কারণে স্বল্প সঞ্চয়, ফলে যথেষ্ট মূলধন গঠিত হচ্ছে না। আবার স্বল্প মূলধনের কারণে স্বল্প বিনিয়োগ হওয়ায় স্বল্প উৎপাদন হচ্ছে।


১৭. উন্নত দৃষ্টিভঙ্গির অভাব : বাংলাদেশের অর্থনীতির পশ্চাৎপদতার অন্যতম কারণ হল উন্নত দৃষ্টিভঙ্গির অভাব। অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য মানুষের মনে প্রবল আকাঙ্ক্ষা থাকা চাই। এ জন্য উন্নয়নধর্মী বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়োজন। কিন্তু বাংলাদেশে উন্নয়নধর্মী দৃষ্টিভঙ্গির যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে।


১৮. বাজারের সংকীর্ণতা : বাংলাদেশ একটি ছোট দেশ। তাই এর বাজার খুব বিস্তৃত নয়। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে - উন্নত দেশগুলোর উন্নতমানের পণ্যের সাথে প্রতিযোগিতা করে টিকে থাকা বাংলাদেশের জন্য দুরূহ হয়ে পড়ছে। যে কারণে বিস্তৃত বাজারের অভাবে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নতি বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে।


১৯. প্রাকৃতিক দুর্যোগ : বাংলাদেশকে প্রায়ই প্রাকৃতিক দুর্যোগের দেশ বলা হয়ে থাকে। প্রত্যেক বছরেই ঝড়, জলোচ্ছ্বাস বাংলাদেশের উপকূলবর্তী অঞ্চলগুলোতে হানা দেয় এবং বন্যা এটি নিত্য ঘটনা; ফলে ফসলহানি ঘটে। নদী ভাঙনের ফলে হাজার হাজার মানুষ সহায়সম্বলহীন হয়ে পড়ছে।


২০. শ্রমবিভাগ ও বৃহদায়তন উৎপাদনের অভাব : অধিক দক্ষতার সাথে উৎপাদনের জন্য শ্রমবিভাজন, বিশেষায়ন ও বৃহদায়তন উৎপাদন অপরিহার্য। বাংলাদেশে এ ধরনের জটিল উৎপাদন ব্যবস্থা এখনও গড়ে ওঠে নি।


বাংলাদেশ কি একটি উন্নত অনুন্নত না উন্নয়নশীল দেশ? তোমার উত্তরের সপক্ষে যুক্তি দেখাও


২১. প্রাথমিক উৎপাদনের প্রাধান্য :  বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এখনও কৃষি ও আনুষঙ্গিক খাতের অবদান তুলনামূলকভাবে বেশি। কিন্তু শিল্পখাতে উৎপাদনের যে সম্ভাবনা আছে তা প্রাথমিক খাতে নেই। তাই বাংলাদেশের অর্থনীতির বর্তমান কাঠামো উন্নয়নের পথে অন্তরায়। তাই বাংলাদেশের অর্থনীতি পশ্চাৎপদ ।


২২. রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার অভাব : রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা প্রায় প্রতি দেশেই উন্নয়নের পথে প্রতিবন্ধক বাংলাদেশের রাজনীতি অস্থিতিশীল। প্রায়ই হরতাল লেগে থাকে। রাজনৈতিক সহিংসতায় প্রায়ই মারামারি, হানাহানি সংঘটিত হচ্ছে। এতে করে উন্নয়নের পরিবেশ বিঘ্নিত হচ্ছে।


উপসংহার : পরিশেষে উপযুক্ত আলোচনা থেকে মিশ্রিতভাবে বলা যায়, বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে পশ্চাৎপদ। এ উক্তিটি সম্পূর্ণভাবে সত্য। কারণ অনুন্নত বা উন্নয়নশীল দেশগুলোর সমস্ত বৈশিষ্ট্য বাংলাদেশে বিরাজমান। কিন্তু উন্নত দেশের কোন বৈশিষ্ট্যই এ দেশটিতে নেই।


#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Now
Ok, Go it!