মানব কল্যাণে ইসলামি অর্থনীতির গুরুত্ব আলোচনা কর।

admin

ভূমিকা :

ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান। মানবজীবনের এমন কোন দিক নেই যা ইসলামে বর্ণিত হয় নি। মানুষের ব্যক্তিগত জীবন থেকে শুরু করে পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয়, ধর্মীয় এমনকি আন্তর্জাতিক বিষয়ের যাবতীয় সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান দিয়েছে ইসলাম। ইসলামি অর্থনীতির মূল এবং একমাত্র উৎস হচ্ছে কোরআন এবং সুন্নাহ। আল্লাহ প্রদত্ত ও রাসুল (স) প্রদর্শিত মানুষের ইহলৌকিক ও পারলৌকিক মঙ্গলের জন্য যে একমাত্র পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা আল-ইসলাম, তার একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে ইসলামি অর্থনীতি। ইসলাম মানুষকে কর্মবিমুখ করে না, বরং নিজ জীবিকা হালালভাবে অর্জন করতে উৎসাহিত করে । ইসলাম নিয়েছে একটি পূর্ণাঙ্গ অর্থনৈতিক নীতিমালা যা অনুসরণ করলে একটি সুখী, সমৃদ্ধশালী দেশ গড়া সম্ভব।


মানব কল্যাণে ইসলামি অর্থনীতির গুরুত্ব আলোচনা কর।


মানব কল্যাণে ইসলামি অর্থনীতি :

ইসলামি অর্থনীতিতে মানব কল্যাণের বহুবিধ কৌশল আলোচনা করা হল :


১. আল-কোরআন এর ভাষা : “আমি আমার রাসূলগণকে সুস্পষ্ট নিদর্শনসহ প্রেরণ করেছি এবং তাঁদের সাথে অবতীর্ণ করেছি কিতাব ও মানদণ্ড, যাতে মানুষ ইসলাম প্রতিষ্ঠা করে।”

এ কথাটির অর্থ নিম্ন


প্রথমত, আর্থসামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য সমাজের সকল মানুষের মৌলিক প্রয়োজন মেটাতে আল্লাহ সম্পদের অবশ্যই সুষ্ঠু ব্যবহার করতে হবে। “সে ব্যক্তি প্রকৃত মুমিন নয়, যে প্রতিবেশীকে অভুক্ত রেখে নিজে পেট ভরে খায় [বোখারি]।” সীমিত সম্পদের মধ্যে ইসলামের এ লক্ষ্য বাস্তবায়ন করা সম্ভবপর নয়, যতক্ষণ পর্যন্ত না তার ব্যবহার মানবতা এবং সাধারণ মানুষের কল্যাণের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে (সোলায়ান ১৯৭৬, পৃঃ ২০।। ফকিহগণ এ বিষয়ে সম্পূর্ণ একমত যে, দরিদ্র জনগণের মৌলিক প্রয়োজনের প্রতি লক্ষ্য রাখা মুসলিম সমাজের সমষ্টিগত কর্তব্য ফরজে কিফায়াহ)।


দ্বিতীয়ত, ইসলামি অর্থনীতির নীতি অনুসারে একজন ব্যক্তিকে নিজের জীবিকানির্বাহের জন্য অবশ্যই চেষ্টা করতে হবে। প্রত্যেক মানুষের জন্য স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে সৎ ও নেক জীবনযাপনের সমান সুযোগ সৃষ্টির সম্মিলিত দায়িত্ব মুসলিম সমাজের। যারা আপ্রাণ চেষ্টা সত্ত্বেও জীবনধারণের ন্যূনতম ব্যবস্থা করতে পারবে না তাদের সাহায্য করা সমাজের কর্তব্য।


তৃতীয়ত, ন্যায়বিচারের দাবি হচ্ছে আর এবং সম্পন্ন মুষ্টিমেয় ব্যক্তির হাতে পুঞ্জিভূত হতে পারবে না। আ কোরআনে এ বিষয়ে বলা হয়েছে, "যাতে ধনৈশ্বর্য কেবল তোমাদের বিত্তশালীদের মধ্যেই পুঞ্জীভূত না হয়।" ইসলামি অর্থনীতিবদগণ এ বিষয়ে একমত যে, যদি সামাজিক আচরণের প্রকৃতি এবং ফাইন্যান্সিয়াল অবস্থা শরীয়ার আলোকে পুনর্বিন্যাস করা হয় তাহলে সমাজে আয় এবং সম্পদের বৈষম্য থাকতে পারে না।


চতুর্থত, ন্যায়বিচারের দাবি হচ্ছে ইসলামি সমাজ যথাসম্ভব উঁচু হারে প্রবৃদ্ধি অর্জন এবং অধিকতর স্থিতিশীলতা বজায় রাখার চেষ্টা করবে। সত্যিকার অর্থে প্রবৃদ্ধি ও স্থিতিশীলতা ছাড়া কাঙ্ক্ষিত মাত্রার মানব কল্যাণ সম্ভব নয়।


২. ভোগের উপর হালাল-হারামের নিয়ন্ত্রণ: ইসলামি অর্থনীতিতে মানুষের অসীম চাহিদার মূলে আঘাত করে তা সসীম পর্যায়ে নিয়ে আসা হয়। ইসলাম মানুষের ভোগের উপর হালাল-হারামের নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছে। মানুষের জন্য কল্যাণকর পণ্য ও সেবাই আল্লাহ হালাল করেছেন ও অকল্যাণকর ক্ষতিকর জিনিস হারাম করেছেন।

আল্লাহ বলেছেন, "খাও, পান কর কিন্তু ইসরাফ করা না। আল্লাহ ইসরাফকারীদের পছন্দ করেন না।" [সূরা আল আরাফ: ৩১/


. ইসলামি অর্থনীতিতে ইহকালীন ও পরকালীন কল্যাণ সাধিত হয় : ইসলামি অর্থনীতিতে জাগতিক ও পারলৌকিক উভয় জগতের কল্যাণ অর্জনের মটিভেসন সৃষ্টি করা হয়। একমাত্র আখেরাতের জবাবদিহির অনুভূতিই মানুষকে সামাজিক কল্যাণমূলক কাজে উদ্বুদ্ধ করতে পারে। লটারির টিকেট কিনে দুনিয়াতে লাভ হতে পারে, কিন্তু তা আখেরাতের জন্য ক্ষতিকর। ইসলামি অর্থনীতিতে দুনিয়ার কল্যাণ ও আখেরাতের কল্যাণ এ দুটোই কাম্য।


৪. সুদ হারাম : রিবা বা সুদ হারাম হওয়া ইসলামি অর্থনীতির একটি মৌলিক বিষয়। সুদ হারাম হলে গোটা অর্থনৈতিক ব্যবস্থাই পরিবর্তিত হয়ে যায়। ইসলামি অর্থনীতি সুদকে মূলোৎপাটিত করে বিনিয়োগ ও উৎপাদনকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করেছে। এতে সুদের মাধ্যমে সৃষ্ট শোষণ ও বৈষম্যের অবসান ঘটে, ভোক্তাগণ সুনজনিত ব্যা থেকে মুক্তি পায়। তাদের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ে। সুদ মূলোৎপাটনের ফলে বণ্টন ক্ষেত্র বেইনসাফি ও জুলুম হতে মুক্তি পায়।


৫. দরিদ্রতার অবসান : সমাজে শান্তি ও নিরাপত্তা বিধানে প্রথম পদক্ষেপ হওয়া উচিত সমাজ থেকে দারিদ্র্যতার অবসান ঘটানো। ইসলাম শান্তির ধর্ম, ইসলাম নিরাপত্তার ধর্ম। আর তাই ইসলামি অর্থনীতির মূল লক্ষ্যও হল সমাজ থেকে দরিদ্রতা দূর করে স্বনির্ভর দেশ ও সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখা। এখানে যাকাত, দান, সদকা করার কথা বলা হয়েছে, যার মাধ্যমে দারিদ্রতা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। ইসলামি অর্থনীতি একমাত্র অর্থনীতি যেখানে স্বচ্ছল মুসলমানদের জন্য যাকাত আদায় বাধ্যতামূলক মৌলিক ইবাদতগুলোর অন্যতম। গরিব, অসহায় ও অভাবগ্রস্ত বনী আদমের আর্থিক কল্যাণের জন্য তথা তাদের আর্থিক ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য এ যাকাত আদায় ও বিলি-বণ্টন ইসলামি রাষ্ট্রব্যব অপরিহার্য কর্তব্য হিসেবে বিবেচিত। এছাড়াও সাদাকাতুল ফিতর, কাফ্ফারা, ফিদিয়া, ওয়াকফ, ওয়াসিয়াত, সাদাকাতে সাফেলা ইত্যাদির মাধ্যমে বিচে মানব কল্যাণ সাধনের ব্যবস্থা রয়েছে।


৬. ন্যায় পথে আয় করার বিধান : আল্লাহ তাআলা মানবজাতিকে তার জীবিকানির্বাহের জন্য বহুবিধ ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। তবে তা অবশ্যই হালালভাবে হতে হবে। আল্লাহ তাআলা ব্যবসায়কে হালাল করেছেন। অন্যের সম্পদকে অন্যায়ভাবে ভোগ করাকে হারাম করেছেন। ইসলামি অর্থনীতিতে মনোপলি, কার্টেল, অলিগপোলিকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। মজুদদারি, মুনাফাখোরি, কালোবাজারি ইসলামে নিষিদ্ধ, আর এসবই মানুষের কল্যাণের জন্য। এসব নিষিদ্ধ থাকায় এমন পরিবেশ সৃষ্টি হয় যাতে মানুষ কর্মপ্রেরণা পায়। ফলে সঞ্চয়, বিনিয়োগ ও ব্যবসায়ে কোনরূপ বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয় না।


৭. অর্থের মোহ দূরীকরণ : ইসলামি অর্থনীতি সব মানুষের কল্যাণে নিয়োজিত। অর্থের মোহ মানুষকে অন্ধ করে দেয়। মানুষকে অমানুষ করে তোলে। যদি সমাজে অর্থের মোহ দূর করা সম্ভব হয় তবে সেখানে শান্তি ও নিরাপত্তা আসতে বাধ্য। এক্ষেত্রে ইসলামি অর্থব্যবস্থার কোন বিকল্প নেই।


৮. ভ্রাতৃত্বের বন্ধন সৃষ্টি : ইসলামি অর্থনীতি পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন সম্ভব হলে একে অপরের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন সৃষ্টি হতে বাধ্য। এখানে একে অপরের সাহায্য সহযোগিতার কথা বলা হয়েছে। ইসলামি অর্থনীতি মুসলমানদের মধ্যে বিশ্বভ্রাতৃত্বের সৃষ্টি করে।


৯. উত্তরাধিকার আইন : ইসলামি অর্থনীতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল উত্তরাধিকার আইনের মাধ্যমে সবার অধিকার সুনিশ্চিত করা। এ নীতির মাধ্যমে নারী-পুরুষ উভয়ে তাদের অধিকার পুরোপুরিভাবে প্রাপ্ত হয়। এখানে কারো প্রতি সামান্যটুকুও প্রতারণার সুযোগ নেই। ফলে সমাজে শান্তি আসবেই।


১০. রাষ্ট্রের ভূমিকা : ইসলামি অর্থনীতিতে রাষ্ট্রের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আর্থসামাজিক কর্মসূচি বাস্তবায়নের দায়িত্ব এ রাষ্ট্রই পালন করে। বায়তুলমাল হচ্ছে ইসলামি রাষ্ট্রের বীমাব্যবস্থা। বায়তুলমাল অক্ষম, দুঃস্থ, বৃদ্ধ, এতিম ও বিত্তহীনদের মৌলিক অধিকার পূরণের গ্যারান্টি। মহানবী (স) বায়তুলমাল প্রতিষ্ঠার পর ঘোষণা করেছিলেন, “যদি কেউ সম্পত্তি রেখে মারা যায়, তবে তা তাদের উত্তরাধিকারীর। আর যদি কেউ সহায়হীন এতিম ও বিধবা রেখে মারা যায়, তবে তার উত্তরাধিকারী আমি।”


১১. অর্থনৈতিক ভারসাম্য : সমাজে শাস্তি আনয়নে প্রয়োজন সমাজের সকলের মধ্যে অর্থনৈতিক ভারসাম্য। অর্থনৈতিক ভারসাম্য বজায় রাখতে না পারলে সমাজে দেখা দিবে হিংসা, বিদ্বেষ, মারামারি, ধনী-গরিব বিভেদ। এজন্য ইসলামি অর্থনীতি অর্থনৈতিক ভারসাম্য আনয়নে সদা সচেষ্ট। এখানে কেউ অঢেল ধনসম্পদের মালিক হবে, আবার কেউ নিঃস্ব হবে এমনটি হওয়ার নয়। কেননা, ধনীদের সম্পদে গরিবদের অংশ রাখা হয়েছে। এভাবেই ভারসাম্য রক্ষা করা হয়েছে।


১২. আল্লাহর পথে ব্যয় : ইসলামি অর্থনীতি ইনফাক ফি সাবিলিল্লাহর প্রতি জোর দেয়। আল্লাহর পথে খরচ মানুষের কল্যাণের জন্যই করা হয়। এর মাধ্যমে সম্পদের মোহমুক্ত করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। ইসলামি অর্থনীতিতে সম্পদ খরচের মধ্যেই কল্যাণ নিহিত রয়েছে বলে মনে করা হয়।


উপসংহার : উপরিউক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, ইসলামি অর্থনীতিই পারে সমাজে শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে; যেখানে মানব রচিত অর্থনীতি ব্যর্থ হয়েছে। কেননা, ইসলামি অর্থনীতি আল্লাহর বিধান অনুযায়ী রচিত। ইসলামি আইন মেনে চললে সমাজে শাস্তি ও নিরাপত্তা আসতে বাধ্য। কারণ, ইসলামি অর্থনীতিতে সম্পদ এমনভাবে বণ্টন করা হয় যাতে ব্যাপক জনগণের মৌলিক চাহিদা যথাযথভাবে পূরণ সম্ভব হয়, বেইনসাফি থেকে জনগণ রক্ষা পায়।



#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Now
Ok, Go it!