ফরাসি বিপ্লবে দার্শনিকদের অবদান মূল্যায়ন কর ।

admin

ভূমিকা :

অষ্টাদশ শতকের শেষ দিকে প্রাচীন ব্যবস্থা তথা রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক অসন্তোষের জন্য যে রাজনৈতিক ঘটনা তথা সমগ্র ইউরোপের ইতিহাসের ধারাকে পাল্টে দেয় এবং সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতা ছিল যার মূলমন্ত্র তার নাম ফরাসি বিপ্লব। সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতাব্দীতে ইউরোপের জ্ঞান জগতে নতুন চিন্তাধারা প্রবাহিত হওয়ায় ‘মানসিক উৎকর্ষের যুগ' এর সূচনা হয় এবং সে যুগে বিজ্ঞান ও যুক্তির মানদণ্ডে রাজনীতি, অর্থনীতি ও সমাজবিজ্ঞান আলোচনার সূত্রপাত হয়। আর আধুনিক যুগে প্রতিটি গণঅভ্যুত্থানের পশ্চাতে দার্শনিকদের অবদান রয়েছে। কেননা কোনো বিপ্লবই দানা বাধতে পারে না যতক্ষণ না সেটা কোনো নির্দিষ্ট ভাবধারার উপর প্রতিষ্ঠিত হয়। পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতকে রেনেসাঁ ও বিফরমেশন এর প্রভাব ইউরোপের জনসাধারণের মধ্যে মানসিকতার প্রশ্নে যে নব জাগরণের উন্মেষ ঘটে এবং মানুষের চিন্তা জগতে যে রোমান্টিক ও যুক্তিবাদের সূচনা হয় তার পূর্ণ প্রকাশ পরিলক্ষিত হয় অষ্টাদশ শতাব্দীর ফরাসি দার্শনিকদের প্রভাবে। কেটেলবি বলেছেন সংসদবিহীন ফ্রান্সের এসব পণ্ডিতই হয়ে উঠেন রাজনৈতিক মঞ্চের নেতা। তারাই প্রথম চোখে আঙুল দিয়ে প্রচলিত ত্রুটিগুলো দেখিয়ে দেন।


ফরাসি বিপ্লবে দার্শনিকদের অবদান মূল্যায়ন কর ।


ফরাসি বিপ্লব সংগঠনে দার্শনিকদের অবদান :

চিন্তায় স্বাধীনতা না থাকলেও মুক্তবুদ্ধিসম্পন্ন লেখক গোষ্ঠী তাদের লেখনীর মাধ্যমে ফরাসি বিপ্লবে এক অমূল্য অবদান রাখেন। সমসাময়িক দার্শনিকদের মধ্যে মন্টেস্কু, ভলতেয়ার, রুশো, বিশ্বকোষ রচয়িতা দলসমূহের ভূমিকা ছিল অন্যতম। নিম্নে এদের অবদান সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :


১. ভলতেয়ার (১৬৯৪ – ১৭৭৮) : ফ্রান্সের বিখ্যাত চিন্তাবিদ ও দার্শনিক ছিলেন ভলতেয়ার। তাঁর আসল নাম মারিফ্রাসোঁরা আরুয়েৎ । তিনি ছিলেন একাধারে কবি, প্রবন্ধকার, নাট্যকার ও বিজ্ঞানের অনুরাগী, জনৈক প্রখ্যাত ঐতিহাসিক তাকে জ্ঞানদীপ্তির দৈবদূত বলে আখ্যায়িত করেছেন। ফ্রান্সের পরলোকগত রাজা চতুর্দশ লুইয়ের বিরুদ্ধে কবিতা লেখার অপরাধে ১৭১৭ সালে প্রথম বাস্তিল দুর্গে বন্দি থাকা অবস্থার Oedipe প্রকাশিত হয় এবং ১৭২৯ খ্রিষ্টাব্দে তিনি আবার কারারুদ্ধ হন। পরে ইংল্যান্ডে তিন বছর থাকার পর ১৭৩৪ সালে Letters philosophivues নামে বিখ্যাত দার্শনিক গ্রন্থ প্রকাশ করেন। ফরাসি সরকার তার Letters Philosophiaces নিষিদ্ধ ঘোষণা করলে তিনি সীমান্তবর্তী Cirey নামক স্থানে গমন করেন এবং সেখানে 'Elements of the philosophy of Newton', 'Essay on universal History' এবং 'Zadig' রচনা করেন। এই বিখ্যাত ব্যক্তি ১৭৭৮ সালে ফ্রান্সে মারা যান। তাঁর রাজনৈতিক দর্শন ছিল “সহস্র ইঁদুরের দ্বারা শাসিত হওয়ার চেয়ে একজন সিংহের দ্বারা শাসিত হওয়া ভালো।


২. মন্টেস্কু (১৬৮৯ – ১৭৫৫) : ভলতেয়ারের কয়েক বছর আগে জন্মগ্রহণ করেন অগ্রগামী চিন্তানায়ক ব্যারন দ্য মন্টেস্কু। পেশায় আইনজীবী হয়েও তিনি সমকালীন রাজনীতিতে যথেষ্ট অবদান রাখেন। তাঁর মতে ফ্রান্সের স্বৈরাচারী রাজতন্ত্র ও অভিজাতীয় সমাজ ছিল যুক্তি বহির্ভূত ব্যবস্থা। তিনি নিজে অভিজাত ছিলেন এবং অভিজাতদের সুযোগ সুবিধা রক্ষার জন্যই রাজ ক্ষমতা সীমাবদ্ধ করার কথা বলেন। তিনি তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ 'Persian Letter's এ ফ্রান্সের ঐ সময়ের সমাজব্যবস্থার ত্রুটিবিচ্যুতি ও শ্রেণি বৈষম্যের কঠোর সমালোচনা করে ফরাসিদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিেেত সক্ষম হন যে তারা শোষিত ও নির্যাতনের শিকার। এছাড়া মন্টেস্কু The Spirit of Laws গ্রন্থে রাজা কর্তৃক ঈশ্বর প্রদত্ত ক্ষমতা অধিকার নীতির তীব্র সমালোচনা করেন। এমনকি তিনি সরকারকে স্বৈরাচারের হাত থেকে রক্ষার জন্য আইন, শাসন, বিচার এ তিনটি বিভাগকে স্বতন্ত্র থাকার পরামর্শ দেন।


৩. রুশো (১৭১২ – ১৭৭৮) : ফরাসি বিপ্লব যার চিন্তাধারা দ্বারা সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হয়েছিল তাঁর নাম জ্যা জ্যাক রুশো। রুশোর আদর্শ হলো সভ্যতার কৃত্রিম বিধিব্যবস্থা পরিত্যাগ করে প্রকৃতির ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে এসে সহজ ও সরল জীবনযাপনই মানুষের স্বাভাবিক ধর্ম। তিনি তাঁর 'Discourse of Arts and Science' নামক গ্রন্থে উক্ত মতাদর্শ প্রচার  করেন। তিনি তাঁর 'Origin of Ineavality' নামক গ্রন্থে রাষ্ট্র ও সমাজ কর্তৃক মানুষে মানুষে পার্থক্য সৃষ্টির প্রাে সমালোচনা করেন। তিনি তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ 'Social Contract' গ্রন্থে বলেন, 'Man born free but everywhere be is in chains. পরবর্তীকালে তার এ বাণীই স্লোগানে পরিণত হয়। রুশো ভলতেয়ার অপেক্ষা অধিক আবেদন সৃষ্টি করেন। বলে বলা হয় যে, "Rousseau began where Voltaire left off the letter harnessed the hourses of reaso the farmar unchained the tigers of emotion."


৪. ফিজিওটি দর্শনের প্রভাব : ফরাসি বিপ্লবে ফিজিওক্র্যাট দর্শনের প্রভাব ছিল অসামান্য। ফিজ দার্শনিকদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলেন দুপো দ্যা নেমার, রবার্ট জ্যাক ভূগো। প্রথম থেকে ফিজিওৱালি প্রচলিত অর্থব্যবস্থা Merchantilism এর বিরুদ্ধে ছিলেন। তারা ব্যবসায় সংক্রান্ত প্রাচীন রীতি পরিবর্তন করে অনাদি অর্থনীতির উপর গুরুত্বারোপ করেন। তাঁদের মূলকথা ছিল “করতে দাও এবং একাই করতে দাও, কারণ পৃথিবী একং চলছে।” অ্যাডাম স্মিথ ছিলেন এ মতবাদের প্রবর্তক। তিনি অবাধ বাণিজ্য স্থাপনের পক্ষপাতী ছিলেন এবং ভূমির ব্যক্তির মালিকানা স্বত্বের বিরোধিতা করেন। অ্যাডাম স্মিথ ও মিরাকের ভাবধারাও ফরাসি বিপ্লবকে পরোক্ষভাবে প্রভাবিত করে।


৫. বিশ্বাকোষ প্ৰণেতা দল : বিশ্বকোষ রচয়িতাগণও ফ্রান্সে যুক্তিবাদী দৃষ্টি গঠনে সহায়তা করেন। দিদেরো ছিলেন যুগের দার্শনিকদের মধ্যে একজন শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি। তিনি ডি. এলেমবার্টসহ কতিপয় পণ্ডিতবর্গের সহযোগিতায় বিশ্বকোষ রচনা করে মানুষের জ্ঞানভাণ্ডার বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। এ গ্রন্থে তাঁরা সামাজিক অনাচার, দাসত্ব প্রথা, কর ব্যবস্থায় অসামঞ্জসাজ - প্রভৃতির নিন্দা করে শোষণহীন ও প্রগতিশীল সমাজ প্রতিষ্ঠার প্রেরণা দেন।


মূল্যায়ন :

উপর্যুক্ত আলোচনা হতে একথা বুঝা যায় যে, ফরাসি দার্শনিকগণ স্বৈরাচারী সামাজিক ও রাজনৈতির ব্যবস্থার যাবতীয় অবাঞ্ছিত বিধিনিষেধ, অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার নীতিগত অধিকার যে জনসাধারণের আছে বুঝিয়ে দেন। এ অবদান প্রত্যক্ষভাবে না হলেও পরোক্ষভাবে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে জনসাধারণকে দাঁড়াবার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে অবহিত করেছিল। একদল ঐতিহাসিকের মতে ফরাসি বিপ্লবের মূল কারণ ছিল দার্শনিক ও বুদ্ধিজীবীদের চিন্তাধারা এবং এর প্রভাব। আরেকদল ঐতিহাসিকের মতে দার্শনিকদের প্রভাব নয় অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক পরিস্থিতি এ বিপ্লবের প্রধম কারণ। তবে এ সম্পর্কের বিপরীতে মতামতও আছে। যথা ১. দার্শনিকদের অধিকাংশ প্রবক্তার বিপ্লবের আগে মৃত্যু হয়। তার বিপ্লবে অংশগ্রহণ করেন নি, ২. দার্শনিকদের মধ্যে প্রখর যুক্তিবাদ থাকলেও তারা সবাই ঐক্যবদ্ধ ছিলেন না, ৩. দার্শনিকর আসলে পুরানো তন্ত্রের সংস্কারে কথা ভাবেন, ভেঙ্গে ফেলার কথা ভাবেন না। ৪. দার্শনিকদের রচনা অল্পসংখ্যক লোকই পড়া সুযোগ পেত, এছাড়া তারা মতামত খুব জোরালো বিমূর্ত ভাষায় প্রকাশ করেন, যা সর্বসাধারণের বুঝা সম্ভব ছিল না। সুতরাং এসব বিচারে ফ্রান্সেরর সমকালীন অবস্থা হতে বিপ্লবের জন্ম হয়, দার্শনিকদের আদর্শ বা মতবাদের জন্য নয়। কিন্তু তাই বলে ফরাসি বিপ্লবের ক্ষেত্রে দার্শনিকদের অবদানকে অস্বীকার করা যায় না।


ফ্রান্সে ফরাসি বিপ্লব সংঘটিত হয় কেন :

ফরাসি স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থা অপরাপর দেশের রাজতন্ত্র অপেক্ষা অধিকতর হীন বল হয়ে পড়েছিল। ফরাসি রাজতন্ত্র দেশে শাসনের নৈতিক অধিকার নিজ অকমর্ণতা হেতু হারিয়ে ফেলেছিল। প্রাক বিপ্লব যুগে ফ্রান্সের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ব্যবস্থার যেসব ত্রুটিবিচ্যুতি সমালোচকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল, অপর কোনো দেশে তা হয়নি। একমাত্র ফ্রান্সে তখন শিক্ষিত, সচেতন, জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ এক মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের উদ্ভব হয়েছিল। ইংল্যান্ড ও সুইডেন ভিন্ন অপর কোনো দেশে তখন মধ্যবিত্ত সমাজের উৎপত্তি হয়নি। ফরাসি মধ্যবিত্ত সমাজ ফরাসি দার্শনিক ভলতেয়ার, মন্টেস্কু, দিদেরো প্রমুখের মতবাদ দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিল। বুদ্ধি বিবেচনায় এমনকি অর্থ বলে তাদের অপেক্ষা নিকৃষ্ট অভিজাত শ্রেণির সামাজিক ও রাজনৈতিক মর্যাদা ও সর্বাত্মক প্রাধান্য তারা স্বভাবতই স্বীকার করতে রাজি ছিল না। ফরাসি কৃষক সম্প্রদায় তদানীন্তন ইউরোপের অপরাপর দেশের কৃষক অপেক্ষ নিজ অধিকার ও মর্যাদা সম্পর্কে অধিকতর সচেতন ছিল। তাদের মধ্যে শোষণ, অত্যাচার ও অবিচারের বিরুদ্ধে এক স্বাভাবিক চেতনা জেগেছিল। ফরাসি বিপ্লবের আগে ভূমিদাসরা সকলে স্বাধীন কৃষকের মর্যাদা পান। ফলে সমাজের অপরাপর শ্রেণির সাথে সমমর্যাদাভুক্ত হতে চান। ফরাসি দার্শনিকদের দান এ বিষয়ে উল্লেখযোগ্য। তাঁরা তাদের রচনা দ্বারা ফরাসি জাতীয় জীবনের প্রতিটি স্তরের দোষত্রুটিগুলো লোকচক্ষুর সামনে তুলে ধরেন এবং ভবিষ্যতে অধিকতর সহজ, সচেতন এবং মর্যাদাপূর্ণ জীবনের এক আদর্শ তাদের সম্মুখে উপস্থাপিত করেন। এছাড়া আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধে ফরাসি নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ দেশে ফিরে আসলে তাদের অভিজ্ঞতার সুযোগ জাতি গ্রহণ করেন এবং তাঁরা বিপ্লবে নেতৃত্ব গ্রহণ করেন ।


উপসংহার :

উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষান্তে ইউরোপে তথা ফ্রান্সে এমন কয়েকজন দার্শনিক ও চিন্তাবিদের আবির্ভাব হয়েছিল, যাদের লেখনীর আঘাতে মধ্যযুগীয় সমাজব্যবস্থার কাঠামো প্রকম্পিত হয়। সি. ডি. হাজেনের মতে “তারা বিপ্লব সংঘটিত করেন নি সত্য তবে তারা দক্ষতার সাথে কারণগুলে আলোকপাত ও সেগুলোর বিশ্লেষণ করে জনমত গঠনে সহায়তা করেন।


#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Now
Ok, Go it!