জগতে শত্রুতা শত্রুতার জন্ম দেয়, কিন্তু মিত্রতার দ্বারা শত্রুতার উপশম হয়।কালিযক্ষিনীর কাহিনী অবলম্বনে এ সত্যতা প্রমাণ কর।

admin

ভূমিকা:

ধম্মপদ গ্রন্থটি সম্যক সম্বুদ্ধের বহু অমূল্য উপদেশ সম্ভারে পরিপূর্ণ। এটি সুত্ত পিটকের খুদ্দক নিকায়ের অন্তর্গত সুপ্রসিদ্ধ গ্রন্থ। এতে ৪২৩ টি গাথা বা শ্লোক আছে। ধম্মপদের এক একটি গাথার উপমা যুক্তি সমন্বয়ে উপাখ্যান যুক্তি বিস্তৃত ব্যাখ্যাকে ধম্মপদটঠকথা বলে। এই ধম্মপদ বৌদ্ধদের অমূল্য সম্পদ।সিংহল,ব্রহ্ম,শ্যাম, চীন, জাপান, তিব্বত প্রভৃতি দেশে এটি খুব সমাদৃত।ধম্মপদ গ্রন্থটি ২৬ টি বর্গে বিভক্ত।

কালিযক্ষিনীর কাহিনী অবলম্বনে সত্যতা প্রমাণ:

একদা জনৈক ব্যক্তি পিতার মৃত্যুর পর ক্ষেতের কাজ করে মায়ের ও নিজের ভরন-পোষণ করছিলেন।কিছুদিন পর তার মাতার একান্ত ইচ্ছে হল ছেলেকে বিবাহ করাতে।ছেলে প্রথমে রাজি হয়নি।কিন্তু মায়ের পিড়াপিড়িতে অবশেষে রাজি হলেন।



ছেলের পছন্দমত পরিবার থেকে কন্যা এনে ছেলেকে বিয়ে করালেন।কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ তার স্ত্রী বন্ধ্যা হল।তাই তার মা তাকে আর একটি বিয়ে করবার জন্য বললেন।কিন্তু ছেলে রাজি হলেন না।অবশেষে স্ত্রীর অনুরোধে আর একটি বিয়ে করতে রাজি হলেন।


স্ত্রীর পছন্দমত পরিবার থেকে কন্যা এনে স্বামীকে বিয়ে করালেন।কিছুদিন পর দ্বিতীয়া স্ত্রী গর্ভবতী হলেন।তখন প্রথমা স্ত্রী দ্বিতীয়া স্ত্রীল উপর ঈর্ষাপরায়ন হল।তাই সে ঔষধ প্রয়োগে গর্ভ নষ্ট করে দিল। এভাবে দ্বিতীয় বারও গর্ভ নষ্ট করে দিল।এভাবে তৃতীয় বারও গর্ভ নষ্ট করলে পাড়া-পড়শীদের পরামর্শে দ্বিতীয়া স্ত্রী গর্ভ গোপন করল।


কিন্তু প্রথমা স্ত্রী লক্ষণ দেখে বুঝতে পারল যে,দ্বিতীয়া স্ত্রী গর্ভবতী হয়েছে। তখন সে আবার ঔষধ প্রয়োগ করল।দ্বিতীয় স্ত্রী গর্ভপাত হওয়ার সময় মারা গেল।মারা যাবার পর দ্বিতীয়া স্ত্রী প্রথমা স্ত্রীর উপর প্রতিশোধ পরায়ন হয়ে সে গৃহেই বিড়ালী হয়ে জন্মগ্রহন করল।স্বামী প্রথমা স্ত্রীর ষড়যন্ত্র বুঝতে পেরে তাকে বেদম প্রহার করলেন।সে প্রহারেই প্রথমা স্ত্রীর মৃত্যু হল।মৃত্যুর পর সে ঐ গৃহে মুরগী হয়ে জন্মগ্রহন করল।মুরগী ডিম পারলেই বিড়ালী খেয়ে ফেলত। এভাবে মুরগী যতবার ডিম পাড়ে বিড়ালী ততবার খেয়ে ফেলে। তখন মুরগী মরে বিড়ালীর উপর ঈর্ষাপরায়ন হয়ে চিতা বাঘিনীরুপে জন্মগ্রহন করল এবং বিড়ালী মরে হরিণী হয়ে জন্মগ্রহণ করল।হরিণীর বাচ্চা হলেই চিতা বাঘিনী খেয়ে ফেলত। এভাবে তাদের শত্রুতা বৃদ্ধি পেতে লাগল।


তখন হরিণী হরিণী চিতাবাঘিনীকে সন্তানাদিসহ খাওয়ার সংকল্প করে মৃত্যুর পর যক্ষিনী হয়ে জন্মগ্রহণ করল।আর চিতাবাঘিনী মারা যাবার পর শ্রাবন্তীতে কোন এক শ্রেষ্ঠীর কন্যারূপে জন্ম নিল।যথাসময়ে তার বিবাহ হল।


বিবাহ হবার কিছুদিন পর সে গর্ভবতী হল এবং যথাসময়ে সন্তার প্রসব করল। প্রসব করার কিছুদিন পর যক্ষিনী এসে তার সন্তানকে খেয়ে ফেলল।দ্বিতীয়বারও প্রিয় সখীরুপে এসে সন্তানটি খেয়ে ফেলল।তৃতীয়বার যখন তারা বুঝতে পারল যে যক্ষিনী এসে তাদের সন্তান খেয়ে ফেলে।তখন স্ত্রী স্বামীকে বলল-এবার আমার বাপের বাড়ি গিয়ে সন্তান প্রসব করতে হবে,তা না হলে যক্ষিনী এসে আমার সন্তানকে খেয়ে ফেলবে। তার স্বামী এ প্রস্তাবে সম্মত হলেন।তখন সে তার বাপের বাড়ি চলে গেল।


যথাসময়ে সে সন্তান প্রসব করল।কিছুদিন সেখানে থাকার পর ছেলের নামকরন করে স্বামীসহ শ্বশুর বাড়িতে ফিরে আসছিল।কিছুদূর আসার পর একটি পুকুর পাড়ে এসে বিশ্রাম করতে লাগল। সেখানে সন্তানটিকে স্বামীর কোলে দিয়ে স্নান করার জন্য পুকুরে নামল।


এদিকে যক্ষিনী তাদের যথাস্থানে না পেয়ে সে পথে আসছিল।যক্ষিনী এদিকে আসছে দেখে সে চিৎকার করতে করতে দৌড়াতে লাগল।তখন ভগবান বুদ্ধ শ্রাবস্তীর জেতবন বিহারে ধর্মদেশনা করছিলেন।শ্রাবন্তীর জেতবন বিহার অতি নিকটে ছিল।সে দৌঁড়ে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে সন্তানটিকে বুদ্ধের পাদমূলে রেখে প্রাণ ভিক্ষা চাইল। এদিকে যক্ষিনীও দৌড়াতে দৌড়াতে সেখানে উপস্থিত হল।

তখন ভগবান বুদ্ধ ধর্মোপদেশ দেবার সময়ে এ গাথা দেশনা করলেন- নহি বেরেন বেরানি সম্মন্তীধ কুদাচনং

অবেরন চ সম্মান্তি এস ধম্মো সনন্তনো ৷

অর্থাৎ,জগতে শত্রুতার দ্বারা কখনো শত্রুতার উপশম হয় না,মিত্রতা দ্বারাই শত্রুতার উপশম হয়,এটাই সনাতন ধর্ম।



গাথা দেশনার পর যক্ষিনী ও সভার অন্যান্যদের অনেকেই স্রোতাপত্তি ফল লাভ করলেন।তখন থেকে তাদের জন্ম-জন্মান্তর ব্যাপী শত্রুতার অবসান হল।যক্ষিনীকে যাগুভাত দিয়ে সবাই রেখে দিল।যক্ষিনীও গ্রামবাসীকে অতিবৃষ্টি অনাবৃষ্টির কথা বলে দিত।তাতে গ্রামবাসীরা সুখে শান্তিতে বাস করতে লাগল।


উপসংহার:

ক্রোধ,হিংসা প্রভৃতি রিপুগুলি আবর্জনার মত মানুষের হৃদয়কে আবিল করে রাখে। এদের থেকে মুক্ত করতে না পারলে হৃদয় কখনও শান্তি পাবে না। ক্রোধ, হিংসাকে জয় করতে হয় মৈত্রী আর ভালবাসা দিয়ে।সেই জয়ই হল স্থায়ী জয়,প্রকৃত জয়।কারন এর দ্বারা হৃদয় প্রসার ঘটে,চিত্ত উদার হয়। এটা আবহমানকালের পরীক্ষিত চিরন্তন সত্য।



#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Now
Ok, Go it!