সার্বভৌমত্ব সম্পর্কে বহুত্ববাদীদের মতবাদ উল্লেখ কর ।

admin

 

ভূমিকা : সার্বভৌমত্ব সম্পর্কে দু'ধরনের মতবাদের একটি হচ্ছে একত্ববাদ (Monism) এবং অন্যটি হচ্ছে বহুত্ববাদ (Pluralism)। একত্ববাদীদের মতে, রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব অবিভাজ্য, চরম, চূড়ান্ত, সীমাহীন, সর্বজনীন, অপ্রতিরোধ্য ও হস্তান্তরের অযোগ্য। রাষ্ট্রই ক্ষমতার একক উৎস। রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে সকল ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের উপর রাষ্ট্রই চরম ও নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী। কিন্তু বহুত্ববাদীদের মতে, রাষ্ট্রই একমাত্র সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী নয়। রাষ্ট্রের মধ্যে বহু সংঘ ও প্রতিষ্ঠান আছে যেগুলো আপন আপন ক্ষেত্রে স্বাধীন। লাস্কি (H. J. Laski), বার্কার (Earnest Barker), লিন্ডসে (Lindsay) প্রমুখ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী সার্বভৌমত্বের বহুত্ববাদের সমর্থক।

সার্বভৌমত্ব সম্পর্কে বহুত্ববাদীদের মতবাদ উল্লেখ কর ।


বহুত্ববাদ : যে তত্ত্ব রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বকে চরম, অবাধ, অসীম ও অবিভাজ্য বলে মনে করার পরিবর্তে একথা প্রচার করে যে, রাষ্ট্রের মতোই সমাজের বিভিন্ন সংঘ বা গোষ্ঠী বা প্রতিষ্ঠান সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী, তা সাধারণভাবে বহুত্ববাদ নামে পরিচিত। এ মতবাদের প্রবক্তাগণ রাষ্ট্রকে বিশেষ ক্ষমতা ও মর্যাদার অধিকারী বলে মনে করেন না। অনেকে মনে করেন চরম বহুত্ববাদীরা রাষ্ট্রের বিলোপ সাধনের পক্ষপাতী। তবে একথাই সত্য যে, বহুত্ববাদের মূল প্রবক্তরা রাষ্ট্রের বিলোপ সাধনের পক্ষপাতি নন। বহুত্ববাদীরা নৈরাজ্যবাদীদের মতো রাষ্ট্রের বিলোপ সাধনের পরিবর্তে রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতার বিলোপ সাধনের পক্ষপাতি। কে. সি. সিয়াও (K. C. Hsias) মন্তব্য করেছেন যে, বহুত্ববাদী রাষ্ট্রে চরম ও সর্বব্যাপী কর্তৃত্বসম্পন্ন কোন বিশেষ কর্তৃপক্ষ, 'সমন্বিত আইন ব্যবস্থা' (Unified system of law), কেন্দ্রীভূত প্রশাসন ব্যবস্থা প্রভৃতির কোন অস্তিত্ব থাকে না।


বহুত্ববাদের মূল বিষয় : অধ্যাপক গেটেল (Prof. R. G. Gettell) কে অনুসরণ করে বহুত্ববাদের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়গুলোকে এভাবে উপস্থাপন করা যেতে পারে :

১. বহুত্ববাদ রাষ্ট্রকে 'একটি অদ্বিতীয় সংস্থা (a unique organization) বলে মনে করে না।

২. বহুত্ববাদীদের মতে, সমাজের মধ্যে অবস্থিত বিভিন্ন ধরনের সংস্থা রাষ্ট্রের মতোই গুরুত্বপূর্ণ ও স্বাভাবিক (Equally important and natural) |

লক্ষ্যগত ক্ষেত্রে রাষ্ট্র যেমন সার্বভৌম, সমাজের অন্যান্য সংস্থাও তেমনি সার্বভৌম।

৪. রাষ্ট্রের অন্তর্গত বিভিন্ন গোষ্ঠীর বিরোধিতা সত্ত্বেও রাষ্ট্র তার ইচ্ছাকে জোর করে তাদের উপর চাপিয়ে দিতে পারে না।

৫. বহুত্ববাদীরা একথা মানতে রাজী নন যে, রাষ্ট্রের হাতে বলপ্রয়োগের ক্ষমতা থাকায় তা অন্যান্য সংঘ অপেক্ষা অধিক পরিমাণে জনগণের আনুগত্য দাবি করার অধিকারী।

৬. রাষ্ট্রের মতো সমাজের বিভিন্ন সংস্থা বা সংগঠন নিজ নিজ ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ কার্যাবলি সম্পাদন করে বলে বহুত্ববাদীরা ধারণা করে এবং

৭, রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতা কোন অর্থেই অবিভাজ্য (indivisible), অসীম (unlimited) ও চূড়ান্ত (absolute) নয়।


একত্ববাদের উপর বহুত্ববাদীদের আঘাত : বহুত্ববাদীরা তিনটি দৃষ্টিকোণ থেকে একত্ববাদের উপর আঘাত হেনেছেন। সেগুলো হলো:


১. বিভিন্ন সংঘ বা প্রতিষ্ঠানের দৃষ্টিকোণ হতে: রাষ্ট্রের ধরন যাই হোক না কেন মনোভাবের দিক থেকে আধুনিক রাষ্ট্র যুক্তরাষ্ট্রীয় প্রকৃতির । সমাজ হচ্ছে বিভিন্ন সংঘ ও প্রতিষ্ঠানের সমন্বিত রূপ। রাষ্ট্রের ইচ্ছায় নয় বরং সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয় প্রভৃতি প্রয়োজনে সংঘ বা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠে। মানুষ রাষ্ট্রের পাশাপাশি ঐ সকল সংগঠনেরও সদস্য। রাষ্ট্র যদি ব্যক্তির কাছ থেকে আনুগত্য লাভের অধিকারী হয় তাহলে সংঘ বা প্রতিষ্ঠানগুলোরও তা প্রাপ্য। যেহেতু রাই সমাজের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলোর মতো একটি তাই সবগুলো সংগঠনের মধ্যে সার্বভৌম ক্ষমতা ভাগ করে দেয়া উচিত। মানব জীবনের চাহিদা অফুরন্ত ও বিভিন্নমুখী। রাষ্ট্র মানব জীবনের এ বিভিন্নমুখী চাহিদা পূরণে সক্ষম নয়। ফলে রাষ্ট্রের ক্ষমতা বা কর্তৃত্ব সীমাহীন হতে পারে না। ম্যাকাইভার (MacIver) এর ভাষায়, রাষ্ট্রের ক্ষমতা তার কার্যের সমানুপাতিক হওয়া উচিত। সীমাবদ্ধ কার্যসম্পাদনের জন্য রাষ্ট্রকে অসীম ক্ষমতা ব্যবহারের অধিকার দান অযৌক্তিক।"


২. আইনের দৃষ্টিকোণ থেকে : রাষ্ট্রের যেমন স্বকীয় বৈশিষ্ট্য আছে, ব্যক্তিত্ব আছে এবং সচেতনতাবোধ আছে ঠিক তেমনি সামাজিক সংস্থাগুলোর ব্যক্তিত্ব ও সচেতন ইচ্ছা আছে। তারাও তাদের নিজস্ব আওতার মধ্যে নিজেদের উদ্দেশ্য সাধনের নিমিত্তে নিজস্ব রীতি-নীতি ও আইন-কানুন প্রণয়ন করতে পারে। এসব সংস্থার কতকগুলো বিশেষ অধিকার ও বাধ্যবাধকতা আছে যেগুলোর জন্য রাষ্ট্রের আনুষ্ঠানিক অনুমোদনের প্রয়োজন হয় না। তাছাড়া রাষ্ট্র সৃষ্টির পূর্বে সমাজবদ্ধ জীবনে মানুষ কতকগুলো সামাজিক নিয়ন্ত্রণ মেনে নিয়েছিল। এগুলোই আইন এবং রাষ্ট্রের ঊর্ধ্বে।


আইন মেনে চলা মানুষের সামাজিক ব্যবহারের অভিব্যক্তি। রাষ্ট্র কোনক্রমেই অপরিসীম ক্ষমতার অধিকারী নয়। সকল সংঘ বা প্রতিষ্ঠান যেমন আইন মেনে চলে, রাষ্ট্রও তেমনি আইন মেনে চলে। রাষ্ট্রের কর্মপরিধি আইন দ্বারা সীমাবদ্ধ রাষ্ট্র তাই অন্যান্য সংঘ বা প্রতিষ্ঠানের উপর কর্তৃত্ব করার অধিকার রাখে না।


রাষ্ট্র মানব জীবনের সামগ্রিক দিকের উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে পারে না। মানুষের অভ্যন্তরীণ সত্তার উপর তার কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। কিন্তু এক্ষেত্রে ধর্মীয় সংঘ বা প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়মাবলি মানুষের অন্তর্জীবনের সূক্ষ্ম অনুভূতিগুলোর বিকাশে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে থাকে। ফলে রাষ্ট্রের ক্ষমতার বিভাজন হওয়া বাঞ্ছনীয়।


৩. আন্তর্জান্তিক সম্পর্কের দৃষ্টিকোণ হতে : আন্তর্জাতিক সম্পর্কের দৃষ্টিকোণ থেকে সার্বভৌমত্বের একত্ববাদ সমালোচিত হয়েছে। বলা হয়েছে রাষ্ট্রের সীমাহীন ও চরম ক্ষমতা রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে ব্যক্তি স্বাধীনতা ও বিভিন্ন সামাজিক সংঘের অস্তিত্বের পক্ষে যেমন হুমকিস্বরূপ তেমনি রাষ্ট্রের অপরিসীম ক্ষমতা আন্তর্জাতিক শান্তির পক্ষেও বিপজ্জনক। রাষ্ট্রের সীমাহীন ক্ষমতা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সুসম্পর্ক স্থাপনের বিপরীতমুখী প্রবণতাকে উস্কে দেয়; এটা রাষ্ট্রের অহংবোধকে জাগ্রত করে। ফলে রাষ্ট্রের সীমাহীন ক্ষমতা মানব সমাজের সার্বিক কল্যাণ সাধনের পরিপন্থী। লাস্কির ভাষায়, “রাষ্ট্রের অবাধ কর্তৃত্ব স্বীকার করলে, চরমত্বের ধারণা মেনে নিলে সভ্যতার ধ্বংস অনিবার্য।"


সমালোচনা : সার্বভৌমত্বে চরমতা বা একত্ববাদিতাকে আক্রমণ করে যে বহুত্ববাদিতা সৃষ্টি হয়েছে তাও সমালোচনার ঊর্ধ্বে নয়। কয়েকটি দিক এরকম-


১. বহুত্ববাদ নৈরাজ্যবাদী ধারণা পুষ্ট : বহুত্ববাদ নৈরাজ্যবাদী ধ্যান-ধারণায় পুষ্ট। রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব বিভক্ত করা হলে রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের ক্ষেত্রে যে বিশৃঙ্খলা আসবে তা নৈরাজ্যবাদকে স্বাগত জানাবে।


২. সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষের অনুপস্থিতি : বিভিন্ন সংঘ বা প্রতিষ্ঠানের সার্বভৌম ক্ষমতা বিভক্ত হলে উক্ত সংঘগুলোর মধ্যে বিরোধ মীমাংসার জন্য কোন সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ থাকে না। যদি তাই হলে ব্যক্তি ও সংগঠনের সার্বিক নিরাপত্তা কে দেবে? এ ব্যাপারে বহুত্ববাদীরা নীরব। এটি বহুত্ববাদের মারাত্মক দুর্বলতা।


৩. আইনগত ও নৈতিক ধারণার পার্থক্যের অনুপস্থিতি : বহুত্ববাদ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার আইনগত ও নৈতিক ধারণার মধ্যে কোন পার্থক্য করে নি। রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বগত ধারণা আইনগত। কিন্তু সংঘ বা প্রতিষ্ঠানের যে স্বাধীনতার কথা বহুত্ববাদীরা বলে থাকেন তা বড়জোর নৈতিক অধিকার হতে পারে। বহুত্ববাদীরা সংঘের এ অধিকারকে আইনগত অধিকারের সাথে এক করে ফেলে মারাত্মক ভুল করেছেন।


৪. এ মতবাদ ভয়ঙ্কর : রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের অবসান হলে ব্যক্তি জীবন, সংঘ জীবন বা সমাজ জীবন যে সুখের হবে, বহুত্ববাদীরা এ রকম কোন গ্যারান্টি দিতে পারেন নি। তাছাড়া সংঘ বা প্রতিষ্ঠান যদি সার্বভৌম ক্ষমতা প্রাপ্ত হয় তবে এসব সংঘ বা প্রতিষ্ঠানের নিপীড়ন রাষ্ট্রের চেয়েও ভয়াবহ রূপ নিতে পারে। অন্যদিকে প্রতিষ্ঠানগুলো শ্রেষ্ঠত্বের লড়াইয়ে লিপ্ত হবে যার স্বাভাবিক বলি হবে সাধারণ মানুষ, যা কখনো কাম্য নয়।


উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, বহুত্ববাদী ধারণা রাষ্ট্রের একচেটিয়া কর্তৃত্বের বিরোধী, স্বৈর শাসকদেরও বিরোধী। রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব, জনগণের অধিকার সবকিছু আইন দ্বারা সীমাবদ্ধ। তাই রাষ্ট্র সচরাচর জনবিরোধী কাজ করে না বা কম করে। তবে, সার্বভৌমত্বের বিলীন চেয়ে তারা যেসব বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন তা যদি ব্যক্তির প্রাধান্যের কথা বলে থাকেন তাহলে সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ না থাকার কারণে ব্যক্তি অচিরেই তার স্বাভাবিক নাগরিকত্বও হারিয়ে ফেলবে।



#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Now
Ok, Go it!