রাজনৈতিক তত্ত্ব সম্পর্কে আচরণবাদী দৃষ্টিভঙ্গি আলোচনা কর।

admin


ভূমিকা : সাবেকী তথা ভাববাদী দর্শনের রাজনৈতিক পর্যালোচনা ও গবেষণার প্রতিবাদ হিসেবে সাম্প্রতিককালের রাজনৈতিক তত্ত্বের যথার্থ অনুধাবন ও মূল্যায়নের জন্য রাষ্ট্রবিজ্ঞানে যে তাত্ত্বিক বিপ্লব (Theoritical Revolution) সংঘটিত হয়েছে তাই আচরণবাদী বিশ্লেষণ ধারা (Behaveoralism)। 'আচরণবাদের অন্যতম লক্ষ্য রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে প্রকৃত বিজ্ঞানভিত্তিক ধ্যান-ধারণার উপর প্রতিষ্ঠিত করা। চার্লস মেরিয়াম (Charles Marrium), ডি. ও. কী (V. O. Key) ভেভিড ট্রুম্যান ( David Truman), হার্বার্ট সিমন (Herbert Simon), গ্যাব্রিয়েল অ্যালমন্ড (Gabrial Almond), ডেভিড ইস্টন (David Easton), ডেভিড, ই. আপটার (David E Apter), জোশেফ লা পালোমবারা (Joshef La Palombara) প্রমুখ রাষ্ট্রবিজ্ঞানের উন্নয়নে এ নতুন তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ ধারা তৈরি ও বিকাশে সহয়তা করেছেন।


রাজনৈতিক তত্ত্ব সম্পর্কে আচরণবাদী দৃষ্টিভঙ্গি আলোচনা কর।


রাজনৈতিক তত্ত্ব সম্পর্কে আচরণবাদী দৃষ্টিভঙ্গি : আচরণবাদী বিশ্লেষকদের মতে, বিশ্বাসযোগ্য রাজনৈতিক জ্ঞানের সমৃদ্ধির জন্য রাজনৈতিক তত্ত্ব গড়ে তোলা প্রয়োজন। অতীতের রাজনৈতিক সমস্যা, কার্যকলাপের প্রকৃতি ও মানুষের রাজনৈতিক কার্যকলাপের লক্ষ্য সম্বলিত ব্যবস্থার সাথে রাজনৈতিক তত্ত্ব জড়িত ছিল। কিন্তু আচরণবাদী মনে করেন লক্ষ্য ও মূল্যবোধ বর্জিত তথ্য ও ঘটনার বিশ্লেষণ সম্ভব এবং বাস্তব ঘটনার আলোচনা ও মূল্যায়নের মাধ্যমেই মূল্যবোধকে আবিষ্কার করা সম্ভব। মূলত ডেভিড ইস্টনের আলোচনাতে আচরণবাদী তত্ত্ব স্পষ্ট হয়ে উঠে।


ডেভিড ইস্টনের 'The Political System' বইতে আচরণবাদ স্পষ্ট হয়ে উঠে। এ বইতে তিনি রাজনৈতিক। গঠনের উপর গুরুত্বারোপ করেন। তিনি তাত্ত্বিক ভিত্তি বিশ্লেষণের পূর্বে এ অভিমত ব্যক্ত করেন যে, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সীমাবদ্ধতার অন্যতম কারণ হলো, রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ঘটনা ও রাজনৈতিক তত্ত্বের প্রকৃত সম্পর্ক বিশ্লেষণ এবং তত্ত্বের ভূমিকার আলোচনায় ব্যর্থ হয়েছে।


প্রকৃত সত্য বের করতে হলে ঘটনা ও জ্ঞানের সুবিন্যস্ত, প্রয়োজন যাতে ঘটনা ও জ্ঞানের পারস্পরিক আলোচনার সম্পর্ক অনুধাবন কর সম্ভব হয়। পারস্পরিক আলোচনায় সর্বজনীনতা যত বেশি থাকবে, ব্যাখ্যা ও জ্ঞানের প্রসার তত বেশি থাকবে। এ জন্য রাজনৈতিক ঘটনাবলি সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য ও বিশ্বাসযোগ্য জ্ঞান আহরণের জন্য সুসংবদ্ধ তত্ত্ব গঠন আবশ্যক। ডেভিড ইস্টন একেই The highest order of generalization বা 'সর্বজনীন অনুমানের সর্বোচ্চ স্তর' বলে। চিহ্নিত করেছেন। ইস্টন মনে করেন, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিজ্ঞানসম্মত পর্যালোচনার জন্য একটি সাধারণ বা সর্বজনীন (general theory) গঠন করা অবশ্যক।


ডেভিড ইস্টনের মতে, যে কোন তত্ত্বই রাজনৈতিক ব্যবস্থার আলোচনার জন্য একটি ধারণা কাঠামো গড়ে তোলে। প্রত্যেক রাজনৈতিক তত্ত্বে ঘটনা সংক্রান্ত (factual), নৈতিক (Moral), ফলিত বা ব্যবহারিক (applied) ও তাত্ত্বিক (Theoritical) এ চারটি অনুমান উপস্থিত থাকে। ডেভিড ইস্টন অভিজ্ঞতাবাদী তত্ত্ব গঠন করতে চাইলেও মূল্যবোধকে অস্বীকার করেন নি। তিনি মনে করেন, কোন রাজনৈতিক তত্ত্বের উপাদানকে সূক্ষ্মভাবে বিচার করলে কেবল মূল্যবোধজনিত তত্ত্বই নয়, অভিজ্ঞতাবাদী তত্ত্বের উপাদানও লক্ষ করা যায়।


ডেভিড ইস্টন রাজনৈতিক তত্ত্বে দু'ধরনের ব্যবস্থা লক্ষ করেন-

১. মূল্যবোধজনিত তত্ত্ব বা Value theory এবং

২. সাময়িক বা হেতুবাদী তত্ত্ব বা Casual or causal theory.

মূল্যবোধ জনিত তত্ত্বের লক্ষ্য হলো মানুষের অগ্রাধিকার সম্পর্কিত বক্তব্যকে উপস্থাপন করা। মূল্যবোধ নিঃসন্দেহে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মূল্যবোধকে যদি চূড়ান্ত লক্ষ্য হিসেবে স্থির করা হয় তাহলে মূল্যবোধজনিত তত্ত্বের পাশাপাশি হেতুবাদী তত্ত্বকেও রাখা উচিত। কেননা হেতুবাদী জ্ঞান কার্যকারণ সম্বন্ধে সুষ্ঠুরূপে বিশ্লেষণ করতে পারে। বিশ্বাসযোগ্য জ্ঞান অর্জনের ক্ষেত্রে এ তত্ত্বের অবদান দৃশ্যমান। ইস্টন মনে করেন, আমাদের জ্ঞানের নির্ভরশীলতা ও বিশ্বাসযোগ্যতাকে উন্নত করার ক্ষেত্রে হেতুবাদী তত্ত্ব একটি নির্ভরযোগ্য মাধ্যম।


আচরণবাদীদের মতে, রাজনৈতিক আচরণকে তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের আওতায় আনয়ন সম্ভব। রাজনৈতিক আচরণের মধ্যে এমন কিছু সাদৃশ্য লক্ষ করা যায় যা ভবিষ্যৎ নির্দেশের ভিত্তি হিসেবে ব্যবহার করা যায়। একমাত্র তাত্ত্বিক বিশ্লেষণই উদ্দেশ্য পূরণে সহায়তা করতে পারে। তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ তিন রকম হতে পারে।


১. তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ একটি মাত্র অনুমানের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠতে পারে। একটি মাত্র অনুমানের ভিত্তিতে গঠিত তত্ত্বের ক্ষেত্রে বিচ্ছিন্ন এবং সহজে সনাক্ত করা যায় এমন দুটি উপাদানের (Variables) সাদৃশ্য লক্ষ করা যায়।


২. তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ সমন্বয়সাধনকারী (Synthetic) অথবা সঙ্কীর্ণ ধারণা বিশিষ্ট (narrow-gauge) হতে পারে। এ বিশ্লেষণ পারস্পরিক জড়িত কয়েকটি ধারণার সমষ্টি। এর লক্ষ্য হলো একক সর্বজনীন অনুমানের (Singular generalization) মধ্যে নিহিত তথ্য ও উপাত্তের (data) সমন্বয় সাধন করা ।


৩. তাত্ত্বিক বিশ্লেষণকে ব্যাপক ধারণা বিশিষ্ট তত্ত্বে (broad-gauge theory) পরিণত করা যায়। ডেভিড ইস্টন সর্বজনীন বা সাধারণ তত্ত্ব (General theory) গঠন উদ্যোগ নিয়েছিলেন। এ তত্ত্ব হেতুবাদী তত্ত্বের একটি ধরন। হেতুবাদী বা কজাল তত্ত্বের বিভিন্ন ধরন রয়েছে, সর্বজনীন তত্ত্ব তার একটি। তবে সর্বজনীন তত্ত্বের প্রয়োজনীয়তা ব্যাপক স্বীকৃতি লাভ করে নি। সামাজিক বিজ্ঞানেও (Socialscience) কোন প্রতিষ্ঠিত ধারণা গড়ে উঠে নি। হেতুবাদী তত্ত্ব বিভিন্ন ধরনের বিষয় নিয়ে গঠিত যা গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয়। বিষয়গুলো হচ্ছে : ধারণাগত ব্যাখ্যা (Conceptual clarification); অনুসন্ধান পদ্ধতি (Methodology); অভিজ্ঞতাবাদী বিষয়সমূহের আবিষ্কারমূলক এবং কাল্পনিক ব্যাখ্যা (Inventive and speculative expanations of emperical subjects); সাধারণ অনুসিদ্ধান্ত (Generalizations) ইত্যাদি ।


ডেভিড ইস্টন অপরাপর তত্ত্ব থেকে সাধারণ বা সর্বজনীন তত্ত্বকে দুটি অর্থে স্বতন্ত্র বলে বিবেচনা করেছেন। আলোচনার পরিধিগত দিক থেকে সর্বজনীন তত্ত্বের পরিধি অনেক ব্যাপক ও সংহত। সর্বজনীন তত্ত্বের তিনটি অনন্য সাধারণ বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায়।

প্রথমত, সব ধরনের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় অনুসন্ধান কাজ চালিয়ে যাবার জন্য প্রয়োজনীয় গুরুত্বপূর্ণ উপাদান বা চলকের (Variables) উপযুক্ত মানদণ্ড প্রতিষ্ঠা করা।

দ্বিতীয়ত, ঐ সকল উপাদান বা চলক বা পরিবর্তনীয়ের পারস্পরিক সম্পর্ক গড়ে তোলা। তৃতীয়ত, যুক্তিসঙ্গত ঐক্য এবং পারস্পারিক নির্ভরশীলতার উপর প্রতিষ্ঠিত সর্বজনীন অনুমানের (generalization) দ্বারা লক্ষ্য অর্জন করা।


উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, বিভিন্ন ধারণা এবং সর্বজনীন অনুমানের মধ্যে ঐক্য এবং সামঞ্জস্য গড়ে তোলার জন্য সাধারণ তত্ত্ব বা সর্বজনীন তত্ত্বের গুরুত্ব রয়েছে। ইস্টন এ তত্ত্বের ক্ষেত্রে অবরোহী চিন্তা (deductive system of thorght) অনুসরণের পক্ষে। কারণ, এর ফলে সীমিত অনুমানের ভিত্তিতে অভিজ্ঞতাবাদী এবং অনেক সঠিক সর্বজনীন বা সাধারণ অনুমান বা অনুসিদ্ধান্ত (generalization) গড়ে তোলা সম্ভব। এ কারণে সাধারণ তত্ত্বের গাণিতিক বিন্যাস সাধন পদ্ধতিকে কাম্য মনে করা হয়।


#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Now
Ok, Go it!