মঠ বা সন্ন্যাস জীবনের নিয়ম-কানুনগুলো আলোচনা কর।

admin

 

ভূমিকা : মঠতন্ত্র তথা সন্ন্যাসবাদের প্রতি মানুষের ভক্তি ও শ্রদ্ধা বেড়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গে সন্ন্যাসবাদীদের সংখ্যাও বাড়তে থাকে। এবং একই সাথে বিকশিত হতে থাকে মঠতন্ত্র। ফলে মঠ জীবনের শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য কিছু নিয়ম-কানুন অত্যাবশ্যক হয়ে পড়ে। আর এই আবশ্যকতা থেকেই একটি সংঘবদ্ধ মঠ জীবন পরিচালনা উপযোগী রীতি- নীতি, নিয়ম-কানুন মঠতন্ত্রে গড়ে ওঠে।


মঠ বা সন্ন্যাস জীবনের নিয়ম-কানুনগুলো আলোচনা কর।


মঠ জীবনের নিয়ম-কানুন : নিম্নে মঠ জীবনের নিয়ম-কানুন উল্লেখ করা হলো।


১. মঠ গঠন : ৩১৫ খ্রিস্টাব্দে মিশরে সেন্ট অ্যান্টিনীর ধর্মনুসারীদের জন্য মঠ গড়ে ওঠে। মিশরবাসী সেন্ট প্যাকোনিয়াম খ্রিস্টীয় ৩য় শতকে সমাজ সংসার ত্যাগ করে মিশরের নীল নদের তীরে তার কিছু শিষ্য নিয়ে মঠ নির্মাণ করে। তিনি তার শিষ্যদের জন্য অবশ্যই পালনীয় কিছু নিয়ম কানুন তৈরি করে। যার মধ্যে ছিল- আনুগত্য, নিরবতা, শারীরিক শ্রম, ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান বাধ্যতা মূলক ছিল।


২. সন্ন্যাস জীবন : প্যাকোমিয়াস ছিলেন সিনোবাইট সন্ন্যাসী, খ্রিস্টীয় চার শতকে সিরিয়া, প্যালেষ্টাইন সহ প্রাচ্য এ প্রথার প্রসার ঘটান। মূলত তার প্রচেষ্টার যোগী সন্ন্যাসী সম্প্রদায় নিঃসঙ্গতা পরিহার করে গোষ্ঠীবদ্ধ জীবন যাপনে এগিয়ে যান। এই সন্ন্যাস জীবন পূর্বে ছিল নিঃসঙ্গ ও নির্জন স্থানে। ফলে সন্ন্যাসী সংখ্যা বেড়ে গেলে অবশ্য পালনীয় নিয়ম তৈরি হয়।


৩. বন পরিহারের নিয়ম চালু : সন্ন্যাসবাদী সংঘবদ্ধ জীবনের উপযোগী কিছু নিয়ম প্রথম প্রচলন করেন সেন্ট বেসিল নামক একজন বিশপ। বেসিল ছিলেন ইতালির ক্যাম্পাডোসিয়া একজন বিশপ, ক্যাপ্পাভোসিয়াতে তিনি সন্ন্যাসদের জন্য মঠ নির্মাণ করেন। তিনিই প্রথম সন্ন্যাসদের জন্য বনে যাওয়ার প্রথা নিষেধ করেন।


৪. ন্যায়নীতি অনুসরণ করে সংবদ্ধ জীবন যাপন করা : সেন্ট বেসিল ছিলেন একজন ন্যায় পরায়ণ খ্রিস্টান ধর্মের বিশপ। ন্যায়ের জন্য তিনিই প্রথম ইতালিতে সন্ন্যাস জীবন বেছে নেন। তার ফলে তার আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে অন্যান্য সন্ন্যাসী তার অনুসরণ করতে থাকনে। ফলে তার সন্ন্যাস জীবনে প্রচুর অনুসারী তিনি তৈরি করেন । তিনি প্রথম মঠ নির্মাণ করে সন্ন্যাসদেরকে বনে যাওয়া নিষিদ্ধ সহ ন্যায়-নীতি অনুসরণ করে সংঘবদ্ধভাবে বসবাসের নির্দেশ প্রদান করেন ।


৫. প্রয়োজনীয় দৈহিক পরিশ্রম করা : সেন্ট বেসিল সন্ন্যাসদের আধ্যাত্মিক সাধনার এবং ধ্যান মগ্নতার পাশাপাশি শারীরিক পরিশ্রম করাকেও বিশেষভাবে উৎসাহিত করেন। সেন্ট বেসিল ছিলেন অত্যন্ত কর্মঠ একজন বিশপ। তিনি কখনো নিজের কাজ অন্যকে দিয়ে করাতেন না। এখানে শারীরিক পরিশ্রম বলতে জাগতিক কাজে সক্রিয় অংশগ্রহণ করাকেই বোঝানো হয়েছে। আর এই জাগতিক কাজের অংশ হিসেবে সন্ন্যাসীরা মঠকেন্দ্রিক বিভিন্ন ক্ষুদ্র শিল্প গড়ে তুলেছিল। এগুলোর মধ্যে বয়ন, চর্ম, নির্মান শিল্প অন্যতম ।


৬. নিজের দেহের কষ্ট না দেওয়া : ইতালির সেন্ট বিশপ তার মঠ জীবনের তার অনুসারীদের কোনো প্রকার অনাহার কিংবা অন্যকোন কারণে নিজ দেহের নির্যাতন বা কোনো প্রকার কষ্ট দেবার বিরোধী ছিলেন। তিনি মনে করেন সুস্থ্য জীবন ছাড়া কখনো মনোযোগ দিয়ে ঈশ্বরের আরাধনা করা সম্ভব নয়। তাই ভালোভাবে সুস্থ থেকে ধর্মবারণ করতে হবে।


৭. দরিদ্র বরণ করা : মঠকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন শিল্প গড়ে উঠলে সন্ন্যাসদের সম্পদ বেড়ে যেতে থাকে। কিন্তু সেন্ট বেসিল তার বিপক্ষে ছিলেন। তিনি অধিক সম্পদ অর্জনকে নিরুৎসাহিত করে দরিদ্র বরণ করতে বলেন। কারণ অধিক সম্পদ মানুষকে লোভী করে তোলে। তাই নিজস্ব ব্যক্তিগত বস্ত্র ও জুতা ব্যতীত সকল ব্যক্তিগত সম্পদ নিষিদ্ধ করা হয়েছিল।


৮. ঈশ্বরের আরাধনায় নিজেকে সর্বদা নিয়োজিত করা : সাধু বেসিল সেখানে ক্যাপ্পাভোসিয়াতে মঠ প্রতিষ্ঠা করেন। সেখানে মঠে উপযুক্ত নিয়ম প্রবর্তন করেন। তিনি আত্মনির্যাতনের পরিবর্তে বিভিন্ন নিয়ম কানুন অনুসরণ করে বেসিল সন্ন্যাসীদের মধ্যে ঈশ্বরের প্রেমের মূল আদর্শ সমুন্নত রাখতে চেয়েছিলেন, তার জন্য তিনি তার শিষ্যদেরকে মনোযোগ দিয়ে আরাধনা, ধ্যান-মগ্ন করতে বলেন।


৯. অধিক সম্পদের মালিক না হওয়া : পূর্ব ইতালির সেন্ট বেসিলের মঠের নিয়মকানুন অনুসরণ করে পশ্চিমে সেন্ট বেনিডিক্ট নামক একজন বিশপ তার মঠে নিয়ম প্রবর্তন করে। তিনি তার অনুসারীদের ধনী হতে নিরুৎসাহিত করেন। কারণ হিসেবে তিনি তার সন্ন্যাসীদের মধ্যে প্রচার করেন জাগতিক সম্পদ মানুষকে লোভী করে তোলে। যা ঈশ্বরের আরাধনায় বিঘ্ন সৃষ্টি করে ।


১০. বিবাহিত জীবন যাপন না করা : পশ্চিম ইতালিতে সেন্ট বেনিডিক্ট তার অনুসারীদেরকে বিবাহিত জীবন যাপনে। বাধ সাধেন। তিনি তাদেরকে ধৈর্যের সাথে কৌমার্য ব্রত এবং ব্রাহ্মচর্য পালন অর্থাৎ বিবাহিত জীবন-যাপন না করার নির্দেশ দেন। কারণ হিসেবে তিনি প্রচার করেন। সংসার জীবনে সন্ন্যাস ব্রত পালন সম্ভব নয়।


১১. কঠোর শৃঙ্খলা : সেন্ট বেনিডিক্ট তার মঠের জন্য কঠোর নিয়ম শৃঙ্খলা মেনে চলার নির্দেশ প্রদান করেন। তিনি তার মঠে কোনো প্রকার শৃঙ্খলা ভঙ্গকারী সন্ন্যাসকে পরিহার করতেন। তিনি মনে করে সংঘবদ্ধ জীবন-যাপনে যদি নেতৃত্বে ও শৃঙ্খলা না থাকে তবে সন্ন্যাস ব্রত পালন ও ধ্যানে নিমগ্ন থাকা সম্ভব নয় ।


এছাড়াও সেন্ট বেনিডিক্ট তার মঠ পালনীয় নিয়ম জারি করে তার মধ্যে ছিল ।

১. আশ্রমাধ্যক্ষ ও আশ্রমের বিধির প্রতি আনুগত্য।

২. প্রার্থনা ও উপাসনায় নিমগ্ন হওয়া তা কঠোর শৃঙ্খলা মেনে চলা,

৪. নৈতিক শ্রমের মর্যাদা দান,

৫. দিনের সময়কে বিভক্ত করে কাজ ও উপাসনার সময় নির্ধারণ করা,

৬. মঠে বিদ্যালয় ও চাষীর মত কাজ করা।


উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, মঠযুগে ইউরোপে গড়ে ওঠা মঠ নানাবিধ কল্যাণকর ও হিতকরণ নিয়ম-কানুন প্রবর্তন করে। কিন্তু ধর্ম প্রচার-প্রসার বেড়ে গেলে এবং সন্ন্যাস সংখ্যা বেড়ে গেলে এই নিয়ম মেনে চলা সবার জন্য সম্ভব হয়নি। তাছাড়া গোপতন্ত্রের আবির্ভাবে মঠের নিয়ম-কানুন ও আদর্শের মৃত্যু ঘটে।


#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Now
Ok, Go it!