ভূমিকা : রাজনৈতিক তত্ত্বের অবনয়নের বা অবনমনের বা গুরুত্ব হ্রাসের ধারণাকে বিশেষ অর্থে প্রয়োগ করা হয়। এ অবনয়নের ধারণা সকল তত্ত্বের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। সাবেকী রাজনৈতিক তত্ত্বের (Traditional political theory) ক্ষেত্রে এ ধারণা প্রযোজ্য। সাবেকী রাজনৈতিক তত্ত্বের সাথে রাজনৈতিক দর্শন জড়িত।
আধুনিককালের অনেক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মনে করেন যে, রাজনৈতিক দর্শন কেন্দ্রিক রাজনৈতিক তত্ত্বের অবসান ঘটেছে। ডেভিড ইস্টন, আলফ্রেড কোব্বান (Alfred Cobban) এবং আরো অনেকে এ মত পোষণ করেন। তাদের মতে, জন স্টুয়ার্ট মিল (John Stuat Mill) ও কার্ল মার্কসের (Karl Marx) পর কোন প্রভাবশালী রাজনৈতিক দর্শনের আবির্ভাব ঘটেনি। ইস্টনের মতে, সামাজিক বিশৃঙ্খল অবস্থা ও সমাজ পরিবর্তনের সময়েই সাধারণত রাজনৈতিক চিন্তার বিকাশ। ঘটে। প্রাচীন গ্রিস ও ষোড়শ ও সপ্তদশ শতকের ইংল্যান্ড এর প্রমাণ। তবে লক্ষণীয় বিষয় হলো এ যে, গত শতাব্দী এবং চলমান শতাব্দীতে বিশ্বব্যাপী ব্যাপক সামাজিক সংঘাত লক্ষ করা গেলেও নতুন রাজনৈতিক চিন্তার বিকাশ ঘটে নি। ইস্টন আচরণবাদে বিশ্বাসী হলেও মূল্যবোধের বিরোধী নন। তবে তিনি মনে করেন এ মূল্যবোধজনিত তত্ত্ব ও অবক্ষয়ের সম্মুখীন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগণ রাজনৈতিক তত্ত্বের অবনয়ন বা অবক্ষয় বা গুরুত্ব হ্রাসের নানাবিধ কারণ চিহ্নিত করেছেন।
রাজনৈতিক তত্ত্বের অবনমনের কারণ : রাজনৈতিক তত্ত্বের অবনয়নের কারণগুলো নিম্নরূপ :
১. ইতিহাস সর্বসত্তা বা ঐতিহাসিকতা : প্রফেসর ডানিং (Dunning), প্রফেসর জর্জ এস. সেবাইন (G.H.Sabine), লিন্ডসে (Lindsay), প্রমুখ রাজনৈতিক তত্ত্বের ঐতিহাসিকতা বা ইতিহাস সর্বস্বতায় কাজ করেছেন। তারা অতীতের রাজনৈতিক ধ্যান-ধারণার বিষয়ে গবেষণা করেছেন। তারা আধুনিকতার পরিবর্তে মূল্যবোধের আলোচনার উৎসাহী ছিলেন। মূল্যবোধের ইতিহাসকে রাজনৈতিক লক্ষ্যের পুনর্বিন্যাসের জন্য তাদের চিন্তাধারাকে কাজে লাগান নি। এর ফলে মূল্যবোধজনিত তত্ত্বের জীবন প্রদীপই প্রায়-নির্বাপিত। তাই অধিকাংশ রাষ্ট্রবিজ্ঞনী রাজনৈতিক তত্ত্বের অবনয়ের জন্য ইতিহাস-সর্বসত্তাকে দায়ী করেছেন।
২. নৈতিক আপেক্ষিকতাবাদ : ডেভিড ইস্টন রাজনৈতিক তত্ত্বের অবনয়নের জন্য নৈতিক আপেক্ষিকতাবাদকে দায়ী করেছেন। নৈতিক আপেক্ষিকতাবাদের লক্ষ্য হলো মূল্যবোধকে রাজনৈতিক ঘটনার বিশ্লেষণ থেকে নির্বাসিত করা। হিউমের তত্ত্বে এ ধারণার উন্মেষ ঘটলেও ম্যাক্স ওয়েবার'র (Max Weber) তত্ত্বে এর পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটে। ম্যাক্স ওয়েবার অভিজ্ঞতাবাদী গবেষণা থেকে রাজনৈতিক মূল্যবোধকে বিচ্ছিন্ন করার উপর গুরুত্বারোপ করেছেন। অবশ্য কার্ল ম্যানহেইম (Karl Mannhiem) অনেকে ভিন্নমত পোষণ করেন। ম্যানহেইমের মতে, মূল্যবোধ ব্যক্তিত্বের একটি অপরিহার্য অংশ এবং মানুষ যেভাবে তার পোশাক পরিবর্তন করে সেভাবে তার মূল্যবোধ ত্যাগ করতে পারে না। ইস্টনের মতে, প্রত্যেক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর পক্ষে মূল সমস্যার প্রতি সংবেদনশীল হওয়া উচিত। এর জন্য প্রয়োজন একটি মূল্যবোধের ব্যবস্থা গড়ে তোলা । মূল্যবোধজনিত তত্ত্বের প্রতি অবহেলা এবং অভিজ্ঞতাবাদী তত্ত্ব গড়ে তোলার প্রতি অনীহা রাজনৈতিক তত্ত্বের অবনয়নে সাহায্য করেছে।
৩. বিজ্ঞান ও তত্ত্বের মধ্যে বিভ্রান্তি : বিজ্ঞান ও তত্ত্বের মধ্যে বা বিষয়ে বিভ্রান্তি রাজনৈতিক তত্ত্বের অবনয়নের একটি কারণ। দীর্ঘদিন ধরে বিজ্ঞান ও তত্ত্বকে সমার্থক হিসেবে গণ্য করা হতো। কোন বিষয়ে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি প্রয়োগ করা আর গবেষণার মাধ্যমে তত্ত্ব গড়ে তোলা সম্পূর্ণ আলাদা। বহু রাষ্ট্রবিজ্ঞানী সংগৃহীত তথ্যের আলোকে বিকল্প পন্থা বা ব্যবস্থা গঠনের মাধ্যমে রাজনৈতিক কাঠামো ও পদ্ধতি উন্নয়নের চেষ্টা করেছেন। কেবল তথ্য সংগ্রহের মাধ্যমে তত্ত্ব গড়ে উঠে না। রাজনৈতিক জীবনের প্রধান প্রধান উপাদান যা চলক বা পরিবর্তননীয় (Variable) সনাক্তকরণ এবং তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক অনুধাবন ব্যতিরেকে তত্ত্ব গঠন সম্ভব নয়। আচরণবাদীগণ ঘটনা বা তথ্যের উপর গুরুত্বারোপ করেন, কিন্তু কী কারণে কোন ঘটনার উন্মেষ ঘটে তা ব্যাখ্যা করেন না।
৪. অতিপ্রবণতা : রাজনৈতিক ঘটনা ও তথ্যের প্রতি অতিপ্রবণতা রাজনৈতিক তত্ত্বকে দুর্বল করে দিয়েছে। বিংশ শতাব্দীতে রাজনৈতিক গবেষকগণ তথ্য সংগ্রহে নতুন কৌশলের উদ্ভাবন করেছেন। কিন্তু তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে তারা কোন উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে পারেন নি। তত্ত্ব ছাড়া তথ্য অর্থহীন হয়ে পড়ে।
৫. আমলাতান্ত্রিক ও সামরিক প্রভাব : অনেকের মতে বর্তমান বিশ্বের পরিস্থিতি রাজনৈতিক তত্ত্বের বিরোধী। রাষ্ট্রের কার্যাবলির প্রসার, সকল প্রকার সামাজিক কার্যাবলির উপর আমলাতন্ত্রের নিয়ন্ত্রণ এবং সামরিক প্রভাবের প্রবণতা ও ব্যাপকতা রাজনৈতিক চিন্তার প্রসারে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে।
৬. অন্যান্য : আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের উদ্দেশ্যহীনতা ও রাজনৈতিক তত্ত্বের অবনয়নে প্রত্যক্ষভাবে সহায়তা করছে। তাছাড়া সমাজবিজ্ঞানের দৃষ্টবাদের (Pesitivism) প্রসার পাশ্চাত্যে কোন গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক পরিবর্তনের অনুপস্থিতি তত্ত্বের ভিত্তিকে দুর্বল করে দিয়েছে।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, রাজনৈতিক তত্ত্বের অবনয়নে উল্লিখিত কারণগুলো মূল্যবান তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু, বাস্তবিকপক্ষে রাজনৈতিক তত্ত্বের কোন অবসান ঘটে নি। পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাথে সামঞ্জস্য বিধানের জন্য এর কাঠামোর পরিবর্তন ঘটেছে মাত্র। প্রত্যেক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীই তাঁর বক্তব্যকে কোন না কোন তত্ত্বের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেন।