কিভাবে পোপতন্ত্রের উদ্ভব হয়েছিল? রোমান চার্চের প্রাধান্য অর্জনের কারণ ব্যাখা কর।

admin

ভূমিকা : পোপতন্ত্র উদ্ভব ও বিকাশ মধ্যযুগের ইউরোপের ইতিহাসে খুবই গুরুত্বপূর্ণ এক অধ্যায়। পোপ শব্দটির উৎপত্তি গ্রীক শব্দ Papa থেকে। যার অর্থ পিতা বা Father. Papa থেকে Papatia এবং তা থেকে কালক্রমে Papacy শব্দের উদ্ভব যার শাব্দিক অর্থ পোপতন্ত্র। পোপতন্ত্র হচ্ছে পোপ এর সংস্থার নাম। অর্থাৎ রোমান ক্যাথলিক চার্চের কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ ও প্রশাসন ব্যবস্থায় হচ্ছে পোপতন্ত্র। রোমান ক্যাথলিক চার্চ এবং অধিকর্তা পোপকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছিল পোপতন্ত্র ।


কিভাবে পোপতন্ত্রের উদ্ভব হয়েছিল? রোমান চার্চের প্রাধান্য অর্জনের কারণ ব্যাখা কর।


পোপতন্ত্রের উদ্ভব : পোপতন্ত্র Papa বা papacy এর উদ্ভব ঘটেছিলো চার্চকে কেন্দ্র করে। চার্চ হলো খ্রিস্টানদের ধর্মীয় উপাসনালয় । প্রথম দিকে চার্চ কেন্দ্রিক খ্রিস্টান ধর্ম ছিল সহজ, সরল ও আড়ম্বরহীন। ক্রমে নানাবিধ কর্মকাণ্ড ও অনুষ্ঠানের উপস্থিতি তা জটিল ও আড়ম্বরপূর্ণ হয়ে ওঠে এবং চার্চ একটি সাংগঠনিক শক্তিতে পরিণত হয়। শিশুকে খ্রিস্টান ধর্মে দিক্ষা দান; বিবাহ অনুষ্ঠান, মৃত্যুর অন্তঃক্রিয়া, সম্পন্ন করা ইত্যাদি ছাড়াও প্রাত্যহিক, সাপ্তাহিক, মাসিক ও বাৎসরিক বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠান পরিচালনার জন্য পুরোহিত বা পোপের প্রয়োজন হতো। প্রথম দিকে একজন ধর্ম যাজক গ্রামে গ্রামে ঘরে ঘরে মানুষের মধ্যে ধর্ম বাণী প্রচার করতেন। কিন্তু দায়িত্ব বৃদ্ধি পাওয়ায় গ্রামে গ্রামে চার্চ প্রতিষ্ঠা করে ঐ চার্চের পুরোহিতের (যাজক) উপর উপযুক্ত কাজগুলো সার্বক্ষণিক দায়িত্ব দেওয়া হয়।


কালক্রমে গ্রামের চার্চগুলো শহরের চার্চের অধীন হয়ে পড়ে। শহরের চার্চের অধিকর্তা ছিলেন প্রেমবাইট। আবার প্রাদেশিক চার্চের প্রধান ছিলেন আর্চ বিশপ যার প্রধান ছিলেন প্যাট্রিয়াক। এভাবে নিচু থেকে ক্রমশ উপরের দিকে গড়ে উঠেছিল গীর্জা সংগঠন। সমগ্র রোমে ৫টি প্যাট্রিয়াকেট বিদ্যমান ছিলো যথা রোম, আলেকজান্দ্রিয়া, কনষ্টান্টিনোপল, জেরুজালেম ও অ্যান্টিওয়ার্ক। আর এই চার্চ ব্যবস্থার ও সর্বোচ্চ অধিকর্তাকে বলা হতো পোপ। পোপই ছিলেন খ্রিস্টান জগতের ধর্মগুরু ও সর্বোচ্চ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত।


রোমান চার্চের প্রাধান্য অর্জনের কারণ : রোমান চার্চের প্রাধান্য অর্জনের বিষয়টি ছিলো সমগ্র খ্রিস্টজগৎ ও মধ্যযুগে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। নিয়ে এ বিষয়ে আলোচনা করা হলো :


১. খ্রিস্ট ধর্মের পতাকা সমুন্নতকরণ : রোমান চার্চ বা খ্রিস্ট ধর্মের উপসনালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যীশু খ্রিস্টের প্রধান সহচর সেন্ট পিটার পিটারও রোমে তার পরবর্তী উত্তরাধিকারী বিশ্বপগণ রোমান শাসক ও ইহুদিবাদের প্রচন্ড অত্যাচার ও নির্যাতন সহ্য করেও রোমান খ্রিষ্টের পতাকা সমুন্নত রেখেছিলেন। এ কারণে রোম ও রোমান চার্চ খ্রিস্ট জগতে বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছিলো। 1


২. রোমের সর্বাধিক গুরুত্ব : রোম ছিলো রোমান সম্রাজ্যর রাজধানী। তাছাড়া রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রও ছিলো রোম এবং তৎকালীন ইউরোপের বড় শহরও ছিলো রোম। রোম ছিলো নগর রাষ্ট্র। আর এ কারণেই রোম ও'রোম চার্চ গির্জার গুরুত্ব ছিলো সর্বাধিক।


৩. ক্ষমতার অধিকারী : রোমান সাম্রাজ্যের খ্রিস্টধর্ম প্রচারের নেতৃত্ব গ্রহণ করেছিল রোমে অবস্থিত সেন্ট পিটার। তিনি ছিলেন যীশু খ্রিষ্টের প্রধান সহচর। এর এ কারণে রোম ইউরোপে সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারি হয়। ফলে খ্রিস্ট ধর্মের কেন্দ্রবিন্দুতেও পরিণত হয় রোম। তাছাড়া সেন্ট পিটার গীর্জার প্রতিষ্ঠা ও যীশু খ্রিষ্টের প্রধান সহচর হিসেবে তিনি পাপ ও পূণ্যের শাস্তি দিতে পারতেন। এ ক্ষমতা দিয়েই তাকে স্বর্গের চাবি দেওয়া হয়েছিল।


৪. ধর্মীয় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড : কনস্টান্টিনোপল রোমান সাম্রাজ্যের রাজধানী প্রতিষ্ঠিত হবার পর থেকে পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্যের রাজধানী রোমান সিংহাসন প্রায় শূন্য থাকত। এই সময় ধর্মীয় বিষয়ের পাশাপাশি রাজনৈতিক বিষয়েও পোপ নির্দেশ দিতেন। তার নির্দেশে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হতো। এ কারণে রোমান চার্চ তথা প্রধান পোপের গুরুত্ব বাড়তে থাকে।


৫. বর্বর আক্রমণ প্রতিরোধ : বর্বর আক্রমণ প্রতিরোধে রোমান ধর্মগুরুর ভূমিকা ছিলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বর্বর জার্মান উপজাতিসমূহের ক্রমাগত আক্রমণে রোমের মানুষের জীবন ও সম্পদ যখন নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়েছিলো তখন অসহায় মানুষের জীবন ও সম্পদ রক্ষা করা এবং একই সাথে খ্রিস্ট ধর্ম রক্ষা করা ও ধর্ম ও সংস্কৃতির একমাত্র রক্ষক ও আশ্রয়দাতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলো রোমান পোপ এভাবে রোমান পোপ জনগণের আস্থা অর্জনের মাধ্যমে প্রাধান্য বিস্তার করে।


৬. রোম নগরী রক্ষা : দুর্ধর্ষ হুন নেতা এ্যাটিলাকে রোম আক্রমণ হতে বিরত রাখার কৃতিত্ব পোপ প্রথম লিওর। লাম্নাউগণের আক্রমণ প্রতিহত করে রোম নগরি রক্ষা করেন পোপ মহান গ্রেগরী সর্বোপরি ফ্রাঙ্ক, এ্যাংলো, ম্যাক্সানসহ দুর্ধর্ষ বর্বরদের মধ্যে ধর্ম প্রচার করে তাদেরকে খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষিত ও তাদেরকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার সকল কৃতিত্ব রোমান পোপ ও ধর্মযাজকদের। ফলে স্বাভাবিকভাবেই তারা রোমান সাম্রাজ্যের উপর প্রাধান্য বিস্তার করে।


৭. রোমের গুরুত্ব : রোম ছিলো খ্রিস্টানদের নিকট ঐতিহ্যবাহী ও পবিত্র স্থান। যীশুকে ক্রুশবিদ্ধ করে হত্যা করলে গুজব রটে যীশু জীবিত হয়ে উঠেছেন এবং তিনি রোম নগরিতে অবস্থান করবেন। এর ফলে রোম নগরী জনগণের নিকট গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। তাছাড়া যীশু খ্রিষ্টের শ্রেষ্ঠ উত্তরাধিকারি সেন্ট পিটার নিজেই রোমে এসে বিশপ পদ গ্রহণ করেছিলেন এবং রোমকে খ্রিস্ট ধর্ম প্রচারের প্রধান কেন্দ্রে পরিণত করেছিলেন। ফলে স্বাভাবিকভাবেই রোমে পোপতন্ত্রের নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব বেড়ে যায়।


৮. রোমান চার্চ মুক্তকরণ : রোমে পোপের প্রাধান্য বিস্তারের ক্ষেত্রে পোপ গ্রেগরীর অবদান কম গুরুত্বপূর্ণ নয় । প্রথম গ্রেগরি ছিলেন খুবই দুরদর্শী। তিনি জানতেন রোমে প্রাধান্য বিস্তার করতে চাইলে রোমের সম্রাট ও সাম্রাজ্যের রাজধানী কনষ্টান্টিনোপলের চার্চে নিয়ন্ত্রণ হতে রোমান চার্চকে মুক্ত করতে হবে। ফলে তার বিচক্ষণতায় চার্চের প্রাধান্য বেড়ে যায় ।


৯. ধর্ম প্রচার : প্রথম গ্রেগরীসহ অধিকাংশ পোপ ও ধর্ম যাজক অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে গ্রামে গ্রামে যেয়ে মানুষের মধ্যে ধর্মের বাণী প্রচার করে। ফলে তারা খুব সহজেই মানুষের আত্মার সাথে মিশে যায়। মানুষ তাদের ক্রমাগত অনুসারি হলে পোপের প্রাধান্য ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে।


১০. ধর্ম বিস্তার : ক্রমাগত খ্রিষ্টিয় ধর্মের প্রতি মানুষের আসক্ত হবার ফলে অল্প সময়ে খ্রিস্ট ধর্মের প্রচার ও প্রসার বেড়ে এর বিস্তৃতি ঘটতে থাকে। পোপের নেতৃত্বে মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়। যেকোন সংকট মোকাবেলায় পোপের একটা ভাষণই যথেষ্ট ছিলো। এ অবস্থায় সম্রাটকেও মানুষ অগ্রাহ্য করে। ফলে রোমান চার্চের প্রাধান্য বাড়তে থাকে।


উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, মধ্যযুগে ইউরোপে পোপতন্ত্র ছিলো সাম্রাজ্যের মতই প্রধান আলোচ্য বিষয় । তাই ক্রমাগত উদ্ভাবনের পর তার বিস্তৃতি ঘটতে থাকলে রোমে চার্চের প্রাধান্য বেড়ে যায়। পোপের নেতৃত্বে মানুষ ধর্মীয় অমৃত বাণীর আকর্ষণে যেকোন কাজ করতেও প্রস্তুত ছিলো। ফলে সম্রাট নিজেও পোপের বিরুদ্ধাচরণ করতে সাহস পেত না।


#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Now
Ok, Go it!