মধ্যযুগে যে সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠেছিল তা আলোচনা কর।

admin

 

ভূমিকা : মধ্যযুগের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী ঘটনা হলো বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা। মধ্যযুগে গড়ে ওঠা যে সমস্ত প্রতিষ্ঠান মানুষের জীবনে অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে বিবেচিত তার মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় অন্যতম। মধ্যযুগে মানুষের অধিকার থেকে আলোর পথে নিয়ে আসে যে প্রতিষ্ঠানটি তা হলো বিশ্ববিদ্যালয়। মধ্যযুগের এ বিশ্ববিদ্যালয় হতেই জ্ঞান- বিজ্ঞান, দর্শন, সাহিত্য, কলা, চিকিৎসা বিজ্ঞান প্রভৃতির চর্চার সূত্রপাত ঘটে।


মধ্যযুগে যে সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠেছিল তা আলোচনা কর।

মধ্যযুগে ইউরোপের সেরা বিশ্ববিদ্যালয় : পৃথিবীর ইতিহাসে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন স্থানে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এর মধ্যে কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয় অত্যন্ত খ্যাতি অর্জন করে। মধ্যযুগে এরকম সেরা কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় হলো -


১. স্যালারনো বিশ্ববিদ্যালয় : স্যালারনো বিশ্ববিদ্যালয়কে ইউরোপের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে চিহ্নিত করা চলে। সম্ভবত দশ শতকে স্যালারানোতে একটি চিকিৎসা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। এই প্রাচীন বিদ্যালয় পরবর্তীকালে স্যালারানো বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হয়। গ্রীক, ল্যাটিন, আরব, ইহুদি, চিকিৎসা সমন্বয়ে এখনো চিকিৎসাবিদ্যা শিক্ষা দেওয়া হতো।


২. বোলোনো বিশ্ববিদ্যালয় : বোলোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব একটি ইতিহাস রয়েছে। বার শতকে প্রথমে কিছু সংখ্যক স্বচ্ছল ও পরিণত বয়স্ক শিক্ষার্থী মিলে একটি সংস্থা গড়ে তোলে যা পরবর্তী সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হয়। বিশ্ববিদ্যালয় আজও আইন শাস্ত্র অধ্যয়নের জন্য বিখ্যাত। বিখ্যাত রোমান আইনবিদ ইরনেরিয়াস এর নেতৃত্বে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন শাস্ত্রের শীর্ষস্থানে পরিণত হয়।


৩. বোলোনোর শিক্ষা কার্যক্রম : ১১৪০ খ্রিস্টাব্দে গ্যাটিয়ান এর একজন বোলোনো সন্ন্যাসীর উদ্যোগে এখানে প্রথম ক্যানন আইন শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করা হয়। বারো শতকে বিখ্যাত পোপ আলেকজান্ডার ছিলেন বোলোনো বিশ্ববিদ্যালয় এবং গ্যাটিয়ানের সরাসরি স্থান। পোপ তৃতীয় ইনোসেন্টও ছিলেন বোলোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ক্যাননিষ্টারাই পরবর্তীকালে পোপের আধ্যাত্মিকতা ও জাগতিক উভয় বিষয়ে সর্বময় ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা করেছিলেন। বোলোনো আর্চ ডেকনের সম্মতিতে উপাধি দান করা হতো। বোলোনোর ছাত্ররা শিক্ষা ক্ষেত্রে পোপের নিয়ন্ত্রণের বিরোধিতা করলেও মধ্যযুগের শেষ দিকে পোপের কর্তৃত্বের নিকট বিশ্ববিদ্যালয় তার স্বাধীন সত্তা বিসর্জন দিতে বাধ্য হয়েছিলো।


৪. প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয় : আলপস ও উত্তরাঞ্চলে ঘটনাক্রমে বহু পণ্ডিত ব্যক্তির আগমনে প্যারিস ধর্ম চর্চা ও দর্শন চর্চার প্রাণ কেন্দ্রে পরিণত হয়। ফলে প্যারিসের প্রাচীন স্কুলগুলো আরো সংঘবদ্ধ হয়ে সংস্থায় পরিণত হয় এবং পরবর্তি সময়ে এই স্কুলগুলোর স্থলে প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। পিটার অ্যাবেলার নামক একজন গৃহী যাজক প্যারিসের ক্যাথেড্রাল স্কুল সন্নিকটে শিক্ষাদান করতেন। তার শিক্ষাদানের নৈপুণ্য চিন্তার স্বাতন্ত্র্য এবং মৌলিকতার জন্য ইউরোপের বিভিন্ন এলাকা থেকে বিদ্যার্থীদের প্যারিসে আগমন করতে থাকে।


৫. শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয় : কালক্রমে মধ্যযুগে প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়টি শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হয় এবং একই সাথে ইউরোপের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে গড়ে ওঠে। ১১৫০-১১৭০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয় একটি পূর্ণাঙ্গ প্রতিষ্ঠানে রূপ লাভ করে। এখানে প্রথমে ধর্ম ও দর্শনতত্ত্ব শিক্ষা দেওয়া হতো। কালক্রমে কলাকে ব্যুৎপত্তি অর্জন ধর্মতত্ত্ব অধ্যয়নের প্রাথমিক উপাদান হিসেবে বিবেচিত হতো। অবশ্য কলা বিদ্যাকে কিছুটা হয় বিবেচনা করা হতো। কিন্তু তা সত্ত্বেও কলাবিদ্যার জনপ্রিয়তা ছিলো সর্বাধিক।


৬. প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংখ্যা : ছাত্র সংখ্যা প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ে সবচেয়ে বেশি ছিলো। ১৩৬২ সালে প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ে কলাবিদ্যায় উত্তীর্ণ ছাত্র সংখ্যা ছিলো ৪৪১ জন, ধর্মতত্ত্বের ছাত্র সংখ্যা ছিলো ২৫ জন, ক্যানন আইনে ১১ জন। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাবিদ্যার ছাত্র-শিক্ষকরা ভাব জগতে বিস্ফোরণ ঘটাতে সক্ষম হয়েছিলো তের শতকে প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রধানত কলা, আইন, দর্শন এই তিনটি বিভাগেই শিক্ষাদান সীমাবদ্ধ ছিলো। অবশ্য চিকিৎসা শাস্ত্র তখনো কলা বিভাগের অর্ন্তগত ছিলো।


৭. ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় : আধুনিক যুগের বিখ্যাত প্রথম সারির বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে অক্সফোর্ড অন্যতম। আজকের এই চির বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্ম আধুনিক কালে নয়। খ্রিস্টীয় ১৩ থেকে ১৪ শতকের দিকে। ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ড ছিলো দর্শন ও কলার প্রাণকেন্দ্র। প্রতিষ্ঠাকালীন ব্যাপক সুখ্যাতি অর্জন করে বিশ্ববিদ্যালয়টি ।


৮. কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় : মধ্যযুগে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠার একই সময়ে জ্ঞান-বিজ্ঞানের চারণভূমি নামে খ্যাত ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ও প্রতিষ্ঠিত হয়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রথম দিকে বেসরকারি উদ্যোগে ও মঠ সন্ন্যাসী দ্বারা গড়ে ওঠে। কিন্তু পরবর্তীতে তা সম্রাটদের পৃষ্ঠপোষকতা পায়। এছাড়াও মধ্যযুগে ইউরোপের বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে ইতালির ফ্লোরেন্স, ন্যাপলস, টুলুজ এবং রোম ও জার্মানির প্রাগ, ভিয়েনা, কলোন বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদি। মধ্যযুগের শেষের দিকে ইউরোপে ৮০টির মত বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়।


উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, মধ্যযুগে যে সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠেছিলো তার মধ্যে উল্লেখিত তিন বিশ্ববিদ্যালয় ছিলো সবচেয়ে সেরা। এছাড়া এ সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের আদলে এমন মানুষের জ্ঞান অন্বেষণের আগ্রহে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় কালক্রমে গড়ে ওঠে। যার মাধ্যমে মানুষ ধর্ম, দর্শন, কলা, ফিকাহ, ইতিহাস, চিকিৎসা শাস্ত্রের শিক্ষাদানসহ আইন শিক্ষা প্রদান করা হতো। তাই জ্ঞান-বিজ্ঞানের অন্যতম মাধ্যম ছিলো মধ্য যুগের বিশ্ববিদ্যালয়।


#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Now
Ok, Go it!