রেঁনেসার কতিপয় প্রধান প্রধান কারণগুলো ব্যাখা কর।

admin

 

ভূমিকা : পঞ্চদশ শতাব্দি থেকে অষ্টাদশ শতাব্দির মধ্যে সংঘটিত একাধিক ঘটনা বুর্জোয়ার যাত্রাপথ ও জ্ঞান- বিজ্ঞানের যাত্রাপথকে সুগম করে। এসব ঘটনার মধ্যে রেঁনেসা অন্যতম। সভ্যতার ইতিহাসে রেঁনেসা এক যুগান্তকারি অধ্যায়। তবে এই রেঁনেসা একদিনেই সংঘটিত হয় না। দীর্ঘপথ অতিক্রম করে জ্ঞানের জগতের এই বিস্তার বা নবজাগরণের সূচনা হয়। এর ফলে মানুষ মুক্তভাবে চিন্তা করতে পারে ও তার স্বাধীনতা প্রকাশ করতে পারে। তবে এই নবজাগরণ সংঘটিত হবার পিছনে একাধিক কারণ বিদ্যমান।


রেঁনেসার কতিপয় প্রধান প্রধান কারণগুলো ব্যাখা কর।

রেঁনেসার কারণ : নানাবিধ কারণে পঞ্চদশ থেকে অষ্টাদশ শতাব্দির মধ্যে রেঁনেসা সংঘটিত হয়। নিম্নে রেঁনেসার কারণগুলো আলোচনা করা হলো :


১. রোমান সাম্রাজ্যের পতন : ৪৭৬ খ্রিস্টাব্দে বিভিন্ন জার্মানি উপজাতি বর্বর আক্রমণের ফলে রোমের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক শৃঙ্খলা ভেঙ্গে পড়ে। মানুষ চরম নিরাপত্তাহীনতায় দিনযাপন করে। এ সময় সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়ায় রোমান যাজক, পোপ ও রোমান চার্চ। দীর্ঘকাল রোমান চার্চ ও পোপদের অনুশাসনে মানুষের জীবনে ধর্মীয় প্রভাব ছিলো সবচেয়ে বেশি। এর ফলে মানুষ মুক্তভাবে কোনো কিছু চিন্তা ও প্রকাশ করতে পারত না। সার্বিক দিয়ে রোমান সভ্যতা, সংস্কৃতির পতনের কারণে রেঁনেসার সূত্রপাত হয়।


২. কনস্টান্টিনোপলের পতন : কনস্টান্টিনোপল ছিলো তৎকালীন খ্রিস্টান জ্ঞান-সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র। ১৪৫৩ খ্রিস্টাব্দে সুলতান দ্বিতীয় মোহাম্মদ কর্তৃক কনস্টান্টিনোপল বিজয় হলে এখানকার গ্রীক পণ্ডিতগণ ইতালি চলে যান। এখানে তারা বিভিন্ন স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। ফলে ইতালিকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন জ্ঞান-বিজ্ঞানের সূচনা। হয়। ফলে রেঁনেসার পুনর্জাগরণ প্রথম ইতালিতে শুরু হয়।


৩. ক্রুসেডের প্রভাব : যীশুখ্রিষ্টের পবিত্র সমাধিস্থল জেরুজালেমকে উদ্ভারকে কেন্দ্র করে একাদশ থেকে ত্রয়োদশ শতাব্দী পর্যন্ত ঈর্ষান্বিত ও বিক্ষুদ্ধ খ্রিস্টান সম্প্রদায় মুসলমানদের বিরুদ্ধে ধর্মযুদ্ধে লিপ্ত হয়। বানস এবং রালফ মনে করেন, “মুসলিম ভ্রাতৃত্ববোধ উন্নতমানের কৃষি পদ্ধতি ইউরোপের মনোজগতে আলোড়ন সৃষ্টি করে যা রেঁনেসা সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখে ।


৪. ভৌগোলিক প্রভাব : রেঁনেসার পিছনে ভৌগোলিক প্রভাব বিদ্যমান। মধ্যযুগে ইউরোপে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নগররাষ্ট্রের উদ্ভব হয়। বিশেষ করে জেনেভা, ভেনিস, ব্যবসা-বাণিজ্য করে সমৃদ্ধশালী হয়। এর ফলে বিভিন্ন স্থানে দেশ-বিদেশের সাথে সংস্কৃতির আদান-প্রদান হয় এবং এক দেশের জ্ঞান-বিজ্ঞানের সাথে অন্য দেশের জ্ঞান-বিজ্ঞানের পরিচয়ের মাধ্যমেও রেঁনেসার সূচনা হয়। অর্থাৎ ভৌগোলিক কারণ রেঁনেসার পিছনে বিশেষ ভূমিকা পালন করে।


৫. মুসলিম সভ্যতার অবদান : মধ্যযুগে মুসলমানগণ বিভিন্ন সভ্যতা গড়ে তোলেন। খলিফা আল মামুনের সময় গ্রীক ভাষায় জ্ঞান-বিজ্ঞানের মুক্ত বুদ্ধির বিকাশ দানের আগ্রহ বেড়ে যায়। তারা মুসলিম সুলতানের পৃষ্ঠপোষকতায় গ্রীক ভাষার জ্ঞান-বিজ্ঞান ও পাণ্ডুলিপি আরবি ভাষায় অনুবাদ করে। পরবর্তী কালে স্পেন ও সিসিলির মাধ্যমে মুসলিম জ্ঞানভান্ডার ইউরোপে সম্প্রসারিত হয়। যা রেঁনেসার ক্ষেত্র প্রস্তুত করে।


৬. মানবতাবাদীদের অবদান : রেঁনেসা আন্দোলনে হিউম্যানিস্টরা গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলেন। মানুষের মধ্যে জ্ঞান চর্চা ও মুক্ত বুদ্ধির সাধন করাই ছিলো হিউম্যানিস্টদের প্রধান উদ্দেশ্য। তারা এক্ষেত্রে সফল হন। সাহিত্যে পেট্রাক, বোকামিও, সেলিনি, ইয়াসমুস, চর্মার, শিল্পে লিওনার্দো দ্যা ভিঞ্চি রাষ্ট্রবিজ্ঞানে মেকিয়াভেলী, বিজ্ঞানে কপারনিকাস, গ্যালিলিও প্রমুখ বিশেষ প্রভাব বিস্তার করে।


৭. মুদ্রণযন্ত্রের আবিষ্কার : মুদ্রণযন্ত্রের আবিষ্কার রেঁনেসার ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রাখে। কেননা মুদ্রণযন্ত্র আবিষ্কারের ফলে জ্ঞান-বিজ্ঞান দ্রুত সম্প্রসারিত হয়। স্থানীয় ভাষায় রচিত সাহিত্যগুলো মুদ্রণ আকারে রচিত ও ছাপা হয় । গ্রীক ও রোমান পুস্তকও ছাপা হয়। ১৪৫৬ সালে প্রথম বাইবেল মুদ্রণ করে প্রকাশ করা হয় ।


৮. জাতীয় ভাষা ও সাহিত্য : সে সময়ে ইউরোপে গ্রীক ও ল্যাটিন ভাষা সাহিত্য ও সংস্কৃতির মাধ্যম হিসেবে থাকলেও বিভিন্ন দেশে ভাষা ও সাহিত্যের চর্চা শুরু হয়। জ্ঞান-বিজ্ঞান চারিদিকে ছড়িয়ে যেতে থাকে। মানুষ খ্রিস্টান গীর্জার গন্ডির মধ্যে আবদ্ধ না থেকে জাতীয় ভাষার মাধ্যমে সাহিত্য রচনায় আগ্রহী হয়। ফলে রেঁনেসার সূত্রপাত হয়।


৯. রোমান ও গ্রীক সভ্যতার প্রভাব : রেঁনেসার পিছনে যে দুই সভ্যতা বিশেষ প্রভাব বিস্তার করে তা হলো রোমান ও গ্রীক। সমগ্র ইউরোপে ঐ সময় রোমান শিল্প, সাহিত্য গুলো স্থানীয় ভাষায় অনুবাদ করে। ইউরোপের প্রধান প্রধান শহরে যে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হয়েছিলো সেখানে রোমান পুস্তক জ্ঞান চর্চার জন্য পড়ানো হতো। ফলে এর মাধ্যমেও রেঁনেসার সূত্রপাত হয়।


১০. মানবতাবাদ : রেঁনেসার উল্লেখযোগ্য কারণ হলো মানবতাবাদের বিকাশ। মানবতাবাদে স্বয়ং মানুষ এবং মানুষের কর্মকাণ্ডকে পরকালের ঊর্ধ্বে স্থান দেওয়া হয়েছিল। মানবতাবাদের মূলকথা হলো সবকিছুর উপরে মানুষ শ্রেষ্ঠ। মধ্যযুগে মানুষের সব কর্মকাণ্ড ছিল পারলৌকিক মোক্ষ। কিন্তু মানবতাবাদে মানুষ এবং তার কর্মকাণ্ডকে প্রাধান্য দেওয়া হয়।


১১. ব্যবসা-বাণিজ্য ও পৃষ্ঠপোষকতা : রেঁনেসার পিছনে তৎকালীন ব্যবসায়ীদের অবদান ছিল উল্লেখযোগ্য। তারা তাদের মর্যাদা, সম্মান, সুখ্যাতি অর্জনের জন্য বিজ্ঞান, সাহিত্য, দর্শন, কলা, চিত্র, ভাস্কর ইত্যাদি বিষয়ে পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করতে থাকে। তাদের পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে বিজ্ঞান, চিত্র, কলার, সাহিত্য শিল্পীরা ক্রমাগত তাদের মুক্ত চিন্তার বিকাশ ঘটাতে থাকে। যা রেঁনেসার যাত্রাপথকে সুগম করে দেয়।


উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, উপরিউল্লেখিত কারণে মধ্যযুগে পরবর্তী সময়ে রেঁনেসার সূত্রপাত হয়। যা ছিলো মানব সভ্যতার ইতিহাসে যুগান্তকারী ঘটনা। বস্তুত রেঁনেসার মধ্যেই আধুনিক সভ্যতার বীজ নিহিত ছিলো। যে কারণে আধুনিক সভ্যতায় পদার্পণ করতে মানব সভ্যতাকে বেশি দিন অপেক্ষা করতে হয়নি।


#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Now
Ok, Go it!