বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পটভূমি আলোচনা কর।

admin

ভূমিকা : মধ্যযুগে সৃষ্ট যে সমস্ত প্রতিষ্ঠান আজও মানুষের জীবনের অপরিহার্য অঙ্গ হিসেবে রয়ে গেছে-বিশ্ববিদ্যালয় তার মধ্যে অন্যতম। এ বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রসূত ও ললিত জ্ঞান-বিজ্ঞান মধ্যযুগে ইউরোপীয় সংস্কৃতির একটি ধারক ও বাহক। মধ্যযুগে এ বিশ্ববিদ্যালয় হতেই আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান, সাহিত্য-দর্শন, কলা, চিত্র, প্রভৃতি চর্চার সূত্রপাত ঘটে। এক সময় মানুষ ছিলো অজ্ঞ, অদক্ষ ও অশিক্ষিত, মধ্যযুগে এই বিশ্ববিদ্যালয়ই মানুষের মধ্যে শিক্ষা ও জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দিয়েছে।


বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পটভূমি আলোচনা কর।

বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পটভূমি : মানুষের জ্ঞান-বিজ্ঞানের অপরিহার্য অঙ্গ হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠার পটভূমি আলোচনা করা হলো :


১. বিশ্ববিদ্যালয় শব্দের উৎপত্তি : বিশ্ববিদ্যালয় শব্দের উৎপত্তি Universities নামক ল্যাটিন শব্দ হতে। যার অর্থ ছাত্র-শিক্ষক সমাবেশ বা বিদ্যার্থীদের সংঘ। বিশ্ববিদ্যালয় বলতে আমরা বুঝি একটি প্রতিষ্ঠানকে যার প্রধান হবে একজন চ্যান্সেলর এবং যা কতগুলো কলেজ দ্বারা বিভক্ত থাকবে। পরিচালিত হবে ডীন বা রেক্টরগণ দ্বারা। আর সেগুলো প্রতিটি শিক্ষানুষদ দ্বারা নির্দিষ্ট কারিকুলাম অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময়ে ডিগ্রি লাভে আগ্রহী বিদ্যার্থীদের শিক্ষা দান করা হবে। মধ্যযুগে এ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ফলে ক্রমবর্ধমান বুদ্ধিবৃত্তি জাগ্রত, বিক্ষিপ্ত জ্ঞান চর্চার পরিবর্তে সংঘবদ্ধ ও পদ্ধতিগতভাবে জ্ঞান চর্চা শুরু হয় ।


২. বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক ইতিহাস : বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভব ঠিক কবে হয়েছিল তা সঠিকভাবে বলা কঠিন। তবে একথা সত্য যে, বারো শতকে এগুলো পূর্ণতা পায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো প্রতিষ্ঠাতা ছিলো না এবং তা কোনো রাজা বা পোপের কোনো চার্চের প্রাপ্তও ছিলো না। বারো শতকে জ্ঞানের উন্মেষ ঘটে তারই ফলশ্রুতিতে ক্রমান্বয়ে এগুলো গড়ে ওঠে। নয় শতকে সম্রাট শার্লামেনের সময় হতেই মঠ স্কুল ও ক্যাথেডল স্কুলগুলোতে পড়ালেখা চলে আসছিল ৮০০ শতকে শার্লামেন মঠ প্রতিষ্ঠার নির্দেশ দেন। ভাইকিং আক্রমণে ইউরোপে শিক্ষা কার্যক্রম ব্যবহৃত হয়। কিন্তু ধীরে ধীরে অবস্থার উন্নতি ঘটে। পরে শহর বিস্তারের সাথে সাথে বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষার ব্যাপক বিস্তার ঘটে।


৩. শহর বিকাশ ও বিশ্ববিদ্যালয় কার্যক্রম : মধ্যযুগে শহর বিকাশের ফলে যে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও স্থিতিশীলতা আসে তার ফলে ইউরোপের সর্বত্র, শিক্ষা বিস্তারের পথ সুগম হয়। বিভিন্ন মঠ দ্রুত বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপ লাভ করে। বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বিদ্যার্থীরা শিক্ষার আগ্রহ নিয়ে ইউরোপের ভূমিতে জড় হয়। বারো শতকে মঠের বাইরেও বেশ কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করা হয়। এগার শতকে মঠ স্কুলগুলো থেকে ক্যাথেড্রাল এর শিক্ষার মান উন্নত হয়। তাই আলোপথ পর্বতের উত্তর হতে ক্যাথেড্রাল স্কুলগুলো মধ্যযুগের সর্বোৎকৃষ্ট ইউনিভারসিটির উত্থান ঘটেছিলো।


৪. সংঘবদ্ধ সংগঠন : প্রাথমিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ছিলো চার্চের বিধি নিষেধ ও সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্ত লেখক সংঘ। উল্লেখ্য, সেসময়ে মানুষের কোনো সংঘ বা সংস্থাকে বলা হতো Universities প্রবাসি শিক্ষার্থী ছাত্র ও শিক্ষকগণ নিজেদের নিরাপত্তার জন্য সংঘবদ্ধভাবে বসবাস করত। বোলোনোতে জার্মান, ইংলিশ এবং ফরাসী শিক্ষার্থীদের সংস্থা হিসেবে Universities গড়ে উঠেছিলো। এভাবে ক্রমেই মানুষ সংশ্লিষ্ট স্কুলেই শিক্ষার জন্য সুসংগঠিত প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে।


৫. নির্দিষ্ট স্থানে জামায়েত : বার শতকে বিদ্যার্থীরা ভ্রাম্যমাণ শিক্ষার্থীদের নিকট হতে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন স্থানে শিক্ষা লাভ করত। কিন্তু এটা ছিলো একটি কষ্টের ব্যাপার। তাই শিক্ষার্থীরা তাদের সুবিধার্থে একটি নির্দিষ্ট স্থানে জমায়েত হয়ে শিক্ষালাভ করতে থাকে। আর এসব স্থানেই পরবর্তী সময়ে প্রথমে বিদ্যালয় এবং সেগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হয় ।


৬. মুসলিম সভ্যতা সংস্কৃতি : মধ্যযুগে ইউরোপের বিশাল অংশ মুসলীম শাসনের অধিনে চলে যায়। এ সময় সা বিশ্ব মুসলিম শাসনের আওতায় আসে। মুসলমানদের উন্নত সভ্যতা ও সংস্কৃতির সংস্পর্শে এসে স্কুলের ছাত্রদেরকে উচ্চ শিক্ষা প্রদানের উদ্দেশ্যে ইউরোপকে বিশেষ করে ইতালির ধর্ম নিরপেক্ষ স্কুলগুলোকে পরবর্তিতে বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে গড়ে তোলা হয়।


৭. রাজকীয় নিয়ন্ত্রণ : মধ্যযুগে রাজকীয় নিয়ন্ত্রণেও বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যায়। যে, ১২৮১ সালে দক্ষিণ ইতালিতে রাজার অনুপ্রেরণায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। তবে এগুলো রাজকীয় নিয়ন্ত্রণেই বেশি ছিলো।


৮. পণ্ডিতদের আগমন ও সমাবেশ : মধ্যযুগে ইউরোপে অনেক সময় স্থান ত্যাগকারি পণ্ডিতদের নতুন স্থানে আগমন ও সমাবেশের ফলে উচ্চ শিক্ষার তাগিদে নতুন নতুন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। বিদ্যার্থীরা এ সমস্ত পণ্ডিতদের থেকে দিক্ষা দিয়ে তাদের নিজ অঞ্চলেও শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় ও অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস এমনই।


৯. সমাজের সংঘবদ্ধ প্রতিষ্ঠান : সমাজ দ্বারা সংঘবদ্ধভাবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়। যে, ক্রুসেডের ফলে ইতালির বিভিন্ন স্থানে চিকিৎসাবিদদের ঘটেছিল তাদের প্রচেষ্টায় চিকিৎসাবিদ্যা শেখার জন্য এবং শিক্ষা দেয়ার জন্য স্যালারনো নামক বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠেছিলো।


১০. ধর্মীয় বিশ্বাস অক্ষুণ্ণ রাখা : বারো শতকে ধর্ম বিশ্বাসী ছাত্রদেরকে গোঁড়া ধর্মীয় ভাবধারায় শিক্ষিত করে সমাজে প্রচলিত ধর্ম বিশ্বাসের প্রতি পূর্ণ আস্থাশীল রাখতে চার্চের অধীনে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠেছিল। চার্চ মনে করতো যে, একটি উৎকৃষ্ট খ্রিস্টান জগত গড়ে তুলতে শিক্ষিত যাজক শ্রেণি প্রয়োজন। এ শিক্ষা কেন্দ্রগুলোতেই ধীরে ধীরে বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠে।


১১. নতুন নতুন শহর সৃষ্টি ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা : এগার থেকে বার-তের শতকে মধ্যযুগে ইউরোপকে ব্যাপকহারে নতুন নতুন শহরের বিকাশ ঘটে। নতুন নতুন শহরের বিকাশের কারণে শিক্ষিত নাগরিক সৃষ্টি এবং প্রশাসনিক কাজে তাদেরকে প্রশিক্ষণ প্রদানের প্রয়োজন থেকেও মঠ নামক কেন্দ্রগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হয়। তবে শহরের বৈচিত্র্যে প্রথম দিকে বিশ্ববিদ্যালয় ব্যক্তিগত উদ্যোগে গড়ে উঠলেও তা পরবর্তীতে সরকারিকরণ করা হয়।


উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, মধ্যযুগে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা ছিল এক যুগান্তর ঘটনা। কারণ এর কিছু পূর্বে মানুষ ছিলো অন্ধকারে। জ্ঞান-বিজ্ঞানের আলো মানুষের ছিলো না। যা দ্বারা মানুষের নিজের উন্নতি করতে পারে। কিন্তু মধ্যযুগে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা ও বিকাশে মানুষের জ্ঞানের দ্বার খুলে যায়। বিস্তার ঘটে বিশ্ববিদ্যালয়। যেখানে জড়ো হতে থাকে বিশ্বের মানুষ।


#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Now
Ok, Go it!