রেঁনেসার ফলাফল আলোচনা কর।

admin


ভূমিকা : মধ্যযুগের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী অধ্যায় হলো রেঁনেসা। যার মাধ্যমে মানুষ তার মুক্ত ও স্বাধীন চিন্তার বিকাশ ও ব্যক্ত করার সুযোগ পায়। রেঁনেসার উদ্ভাবনে মানুষ আর খ্রিস্টান গীর্জার সংকীর্ণ গণ্ডিতে আবদ্ধ না থেকে জ্ঞান বিজ্ঞানের অবাধ অনুশীলনে অভ্যস্ত হয়। অজানাকে জানার জন্য এবং দুয়েকে অনুধাবনের জন্য গোঁড়ামি বর্জিত বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে সব কিছু বিচার-বিশ্লেষণ করতে শেখে। কাজেই পঞ্চদশ শতাব্দি শুরু হওয়া রেঁনেসার ফলাফলও ছিলো সুদূরপ্রসারী।


রেঁনেসার ফলাফল আলোচনা কর।

রেঁনেসার ফলাফল আলোচনা : রেঁনেসার ফলাফল ছিল সুদুর প্রসারি। এটা সমগ্র মানব সভ্যতা আলোড়িত করে। নিম্নে রেঁনেসার ফলাফল আলোচিত হলো -


১. মুক্ত চিন্তাশক্তির উদ্ভবন : রেঁনেসার ফলে মুক্ত ও স্বাধীন চিন্তাশক্তির উদ্ভব ঘটে। মানুষ তার নিজ নিজ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত থেকে জ্ঞান ও শিক্ষা আহরণ করতে থাকে। ফলে মানুষ ধীরে ধীরে রাজনীতি ধর্মনীতি, সমাজনীতি, সাহিত্য, দর্শন, বিজ্ঞান, কলা, ভাস্কর, চিকিৎসা বিজ্ঞান প্রভৃতিতে উন্নতি লাভ করতে সক্ষম হয়।


২. মানবতাবাদের বিকাশ : রেঁনেসার প্রধান ফলাফলের দিক হলো, রেঁনেসার মাধ্যমে মানবতাবাদের বিকাশ সাধিত হয়। স্বয়ং মানুষ এবং মানুষের পার্থিব জীবনের ও পারিপার্শ্বিকতার উপর গুরুত্ব দান মানবতাবাদের মূল কথা। মধ্যযুগে যেখানে পরকালকে ইহকালের উর্ধ্বে স্থান দেওয়া হয়েছিল যেখানে মানুষের যাবতীয় ক্রিয়াকর্ম ছিলো পরকালিক মোক্ষ। কিন্তু রেঁনেসার মাধ্যমে মানবতাবাদের বিকাশের মাধ্যমে মানুষ ও তার ক্রিয়াকর্মের প্রাধান্য পায়। সমাজে মানুষের মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয় ।


৩. নতুন জীবনাদর্শ : রেঁনেসা মানব সভ্যতার ইতিহাসে এক নতুন জীবনাদর্শ নিয়ে আসে। মধ্যযুগে মানুষের জীবন আদর্শ ছিলো আধ্যাত্বিক ও পরকালিন শান্তিলাভের আশা। যেখানে মানুষের বিশ্বাস ছিলো ইহকালের সব কিছু ত্যাগ করার মাধ্যমে পরকালিক মুক্তি লাভ করা যায়। রেঁনেসা মানুষের এই ভ্রান্ত ধারণা মিথ্যা প্রতিপন্ন করে এবং একই সাথে রেঁনেসা মানুষকে বাস্তবমুখী করে তোলে।


৪. ভৌগোলিক জ্ঞান লাভ : মধ্যযুগে ইউরোপের কিছু দুঃসাহসিক নাবিক পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চল জয়ের সংকল্প করে। সাথে সাথে তারা কিছু অঞ্চল সম্পর্কে জ্ঞান লাভও করে। তাদের চিত্রাকর্ষক ভ্রমণকাহিনী অন্যান্য নাবিকদেরকে উৎসাহী করে তোলে। ফলে রেঁনেসার মাধ্যমে ভৌগোলিক জ্ঞান লাভ সহজ হয়। এ সময় ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্যও মানুষ এক স্থান থেকে অন্যত্র পাড়ি জমায়। যা ভৌগোলিক জ্ঞান লাভে সহায়তা করে।


৫. রাজনৈতিক ফলাফল : রেঁনেসার রাজনৈতিক ফলাফল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ইতালিতে রেঁনেসা শুরু হলেও তা আর এ উপদ্বীপে সীমাবদ্ধ থাকেনি। ইংল্যান্ড, জার্মান, গ্রীক, রোম, ডেনমার্ক প্রভৃতি অঞ্চলেও বিস্তার লাভ করে। তাছাড়া মুসলমানরা স্পেন দখল করে নিলে আরবীয় উন্নত সভ্যতা ও সংস্কৃতি ইউরোপে প্রবেশ করলে রেঁনেসার যাত্রাপথ আরো সুগম হয়। ফলে রাজনীতির ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন সূচিত হয়। যেখানে খ্রিস্টান শাসন বিদ্যমান ছিলো সেখানে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়।


৬. জ্ঞান-বিজ্ঞানের উন্নয়ন : রেঁনেসার শুরুই হয়েছে জ্ঞান বিজ্ঞানের উন্নয়ন দিয়ে। রেঁনেসার মাধ্যমে জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিকাশ হলে, ইউরোপের প্রধান প্রধান শহরে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হয়। গ্রীক ও রোমান পান্ডুলিপিগুলো স্থানীয় ভাষায় অনুবাদ করা হয়। ইউরোপ, রোম ও গ্রীসের সাথে নতুন করে সম্পর্ক স্থাপিত হয়।


৭. ধর্মীয় ফলাফল : মধ্যযুগে রাজাগণ নিজেদেরকে ঈশ্বরের মনোনিত প্রতিনিধি ভাবতেন। আবার পোপ দাবি করতেন তারা ঈশ্বরের প্রতিনিধি। ফলে সাধারণ জনগণ ছিলো সর্ববিষয়ে উপেক্ষিত। কৃষক, ভূমিদাসদের তো কোনো মানবিক মর্যাদা ছিলো না। গীর্জা ও মঠ ছিলো রাষ্ট্রের মধ্যে আর একটি শোষণ যন্ত্র। রেঁনেসার ফলে মানুষ ধর্ম সংস্কারে উদ্বুদ্ধ হয়। ফলে খ্রিস্টান ধর্মে ব্যাপক পরিবর্তন আসে।


৮. ধর্মের বিভক্তি : মধ্যযুগে পোপ ছিলো খ্রিস্টান ধর্মের অবিসংবাদিত নেতা। কিন্তু সপ্তদশ শতকে মার্টিন লুথার পোপের কতিপয় অনুশাসন ও কার্যক্রমকে অস্ট্রিয়ান বলে আক্রমণ করেন। ফলে পোপ ও লুথারের মধ্যে দ্বন্দ দানা বেঁধে ওঠে। পোপ সমঝোতায় না আসায় লুথার পোপের নেতৃত্ব অস্বীকার করে। এতে খ্রিস্টান ধর্ম দুভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। এক অংশ রোমান ক্যাথলিক। যারা পোপের নেতৃত্বে অটুট থাকে। অন্য অংশ প্রটেস্ট্যান্ট, যারা পোপের নেতৃত্ব অস্বীকার করে। 


৯. বুর্জোয়া অগ্রগতি : রেঁনেসা সামগ্রিকভাবে বুর্জোয়া অগ্রগতিতে সাহায্য করে। পোপ তার দ্বিখন্ডিত ক্ষমতা দিয়ে আর বুর্জোয়ার যাত্রাপথ রোধ করতে পারে না। অপরদিকে বিভিন্ন প্রটেস্ট্যান্ট ধর্মগুরুর ধর্ম মতের যে ব্যাখ্যা প্রচার করে তা প্রকারান্তে বুর্জোয়া কার্যাবলিকে সমর্থন করে। এর ফলে রেঁনেসার মাধ্যমে বুর্জোয়া শ্রেণির প্রভাব বেড়ে যায় ।


১০. ব্যবসায়ীদের প্রভাব বৃদ্ধি : রেঁনেসার মাধ্যমে চিন্তা ও কর্মের স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠিত হলে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রতি বিরূপতা হ্রাস পায় এবং এর মাধ্যমে ব্যবসায়ী শ্রেণি নিরাপদে নিজ নিজ ব্যবসায় আত্মনিয়োগ করে পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করে। মানবতাবাদে মনের বিকাশ ও রুচির উৎকর্ষতাকে বংশ পরিচয়ের উর্ধ্বে স্থান দেয়। জন্ম ঠিকানা নয় বরং মানবিক গুণাবলিই আভিজাত্যের লক্ষণ হিসেবে স্বীকৃত হয়। এর মাধ্যমে ব্যবসায় শ্রেণি নানা বিষয়ে পৃষ্ঠপোষকতা দান করলে বিজ্ঞানী, সাহিত্যিকরা সাফল্য লাভ করে। ফলে জ্ঞানের বিস্তার সহজ হয়।


উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, রেঁনেসা মধ্যযুগীয় অন্ধকার থেকে ইউরোপীয় সমাজকে আলোর দিকে নিয়ে আসে। রেঁনেসার ফলে মানব মনে ধর্ম নিরপেক্ষতা, শিক্ষা, জ্ঞান-বিজ্ঞান সাধনা ঐতিহাসিক গবেষণায় যে চেতনা জাগ্রত হয় বলা যায় সেই চেতনাটি মানবসভ্যতাকে আজকের পর্যায়ে নিয়ে আসে।



#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Now
Ok, Go it!