রেনেসাঁ কি? রেনেসাঁর বৈশিষ্ট্যগুলো আলোচনা কর।

admin

 

ভূমিকা : “রেঁনেসা" সভ্যতার ইতিহাসে একটি তাৎপর্যপূর্ণ অধ্যায়। মানব সভ্যতাকে মধ্যযুগের অবয়ব থেকে মুক্ত করে আধুনিক সভ্যতায় নিয়ে আসার পিছনে একক ভূমিকা পালন করে রেনেসাঁ। ৪৭৬ খ্রিস্টাব্দে জার্মানি বর্বর কর্তৃক রোম দখলের পর থেকে সভ্যতায় মধ্যযুগের আবির্ভাব হয়। ১৪৫৩ খ্রিস্টাব্দে অটোমান তুর্কি কর্তৃক কনস্টান্টিনোপল (বর্তমান তুরস্ক) দখল ও বিজয়ের মধ্য দিয়ে যে ঘটনা মধ্যযুগের সমাপ্তির সূচনা করে তাই হচ্ছে রেঁনেসা।


রেনেসাঁ কি?রেনেসাঁর বৈশিষ্ট্যগুলো আলোচনা কর।


রেঁনেসা : পঞ্চদশ শতাব্দি থেকে অষ্টাদশ শতাব্দির মধ্যে সংঘটিত একাধিক ঘটনা বুর্জোয়ার যাত্রা পথকে সুগম করেছিলো। এ সমস্ত ঘটনার মধ্যে রেঁনেসা, ধর্মবিপ্লব ও ভৌগোলিক আবিষ্কার অন্যতম ।

পঞ্চদশ শতাব্দির কাছাকাছি সময়ে ইউরোপের চিন্তার রাজ্যে যে বিপ্লব দেখা দেয় তাই শাব্দিক অর্থে রেঁনেসা নামে পরিচিত। মানুষ খ্রিস্টান গীর্জার সংকীর্ণ গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ না থেকে জ্ঞান-বিজ্ঞানের অবাধ অনুশীলনের সূচনা হয়। অজানাকে জানা, দুৰ্জ্জেয়কে অনুধাবন করার গোড়ামি বর্জিত বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে সমস্ত কিছু বিচার-বিশ্লেষণ করার প্রবণতা দেখা দেয়। জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রভুত উন্নতি সাধিত হয়। মানুষের চিন্তাশক্তি, মেধার নিরঙ্কুশ স্ফুরণ ঘটে। আনের ক্ষেত্রে এই বিপ্লব সভ্যতার ইতিহাসে রেঁনেসা নামে পরিচিত।

রেঁনেসা শব্দের অর্থ নবজাগরণ বা নবরুজ্জুদয়। বহু কালের অবহেলিত প্রাচীন গ্রিস এবং রোমের সৃষ্টি ও সাহিত্যকে নব জন্ম দান করার জন্য সমগ্র ইউরোপে এক বিরাট সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে ওঠে। এই আন্দোলনই রেঁনেসা নামে প্রসিদ্ধি লাভ করে। এই সময় গ্রিক ও রোমের সাহিত্যগুলো স্থানীয় ভাষায় অনুবাদের হিড়িক পড়ে যায়। এই সময় ইউরোপের প্রধান প্রধান শহরে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। ইউরোপ রোম ও গ্রিসের সাথে নতুন আঙ্গিকে সম্পর্ক স্থাপন করে। আর ইতিহাসে এই সমস্ত প্রক্রিয়া রেঁনেসা নামে পরিচিত।


রেঁনেসার স্বরূপ বা বৈশিষ্ট্য : রেঁনেসা বা জ্ঞান-বিজ্ঞানের আন্দোলনের ফলে চিন্তা, জ্ঞান, মেধা, ধর্ম সম্পর্কে মতের বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত হয়। মানুষ আধ্যাত্মিক ও আত্মসম্পর্কে সচেতন হয়। রেঁনেসার একাধিক বৈশিষ্ট্যের মধ্যে প্রধান প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো আলোচনা করা হলো :


১. মানবতাবাদের উন্মষ : রেঁনেসার উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্যের মধ্য সবচেয়ে প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো মানবতাবাদের উন্মেষ ও বিকাশ। এ যুগে স্বয়ং মানুষ ও মানুষের পার্থিব জীবন ও পারিপার্শ্বিকতার উপর যথাযথ গুরুত্বদান মানবতাবাদের মূল কথা। মধ্যযুগে পরকালকে ইহকালের ঊর্ধ্বে স্থান দেওয়া হয়েছিলো। মানুষের সমস্ত ক্রিয়া কর্ম ছিলো পরকালীন মোক্ষ। কিন্তু মানবতাবাদে মানুষ হিসেবে মর্যাদা তুলে ধরেছিলো এবং তার ঐহ্যিক জীবন ও ক্রিয়াকে প্রাধান্য দিয়েছিলো।


২. ধর্মীয় স্বাধীনতা : রেঁনেসার ফলে উদ্ভূত মানুষ ধর্মীয় স্বাধীনতা লাভ করে। তারা তাদের চিন্তাধারা, দৃষ্টিভঙ্গি, আলোচনা, সমালোচনা, স্পৃহা, শিক্ষা, মেধা, সংস্কৃতিকে ধর্মীয় নাগপাশ হতে সম্পূর্ণভাবে মুক্ত করে। রেঁনেসার পূর্বে ধর্মীয় জীবনে মানুষ আবদ্ধভাবে ছিলেন। মানুষের চিন্তা, চেতনা, বিবেক, মূল্যবোধ সব কিছু খ্রিস্টান পোপ, যাজক ও ধর্ম দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতো। বাইবেল ছিলো মানুষের জীবনের মূলমন্ত্র। কিন্তু রেঁনেসার মাধ্যমে মানুষ চিন্তার স্বাধীনতা ও ধর্মীয় স্বাধীনতা লাভ করে। তারা পোপ ও যাজক সম্প্রদায়ের বাইরে এসে মুক্তভাবে চিন্তা করতে শেখে।


৩. ধর্মের বিভক্তি : সপ্তদশ শতকে রেঁনেসার ফলে ধর্ম বিপ্লব ও ধর্ম সংস্কারের সূচনা হয়। মধ্যযুগে পোপ ছিল খ্রিস্টান জগতের অবিসংবাদিত নেতা। তিনি নিজেকে ঈশ্বরের প্রতিনিধি মনে করতেন। কিন্তু সপ্তদশ শতাব্দিতে মার্টিন লুথার পোপের কতিপয় অনুশাসনকে অস্বীকার করে তার অনুশাসন ও ক্রিয়াকর্মকে আক্রমণ করে। ফলে পোপের সাথে লুথারের দ্বন্দ্ব অনিবার্য হয়। পোপ সমতায় না আসায় মার্টিন লুথার পোপের নেতৃত্ব অস্বীকার করে। খ্রিস্টান জগৎ দু'ভাগে বিভক্ত হয়। এক "রোমান ক্যাথলিক” যারা পোপের নেতৃত্বে অধীন থাকে এবং "প্রটেস্ট্যান্ট" যারা পোপের নেতৃত্ব অস্বীকার করে। ফলে ধর্মের বিভক্তি চরম আকার ধারন করে।


৪. বুর্জোয়ার অগ্রগতি : প্রটেস্ট্যান্ট সম্প্রদায় কোনো ধর্মীয় নেতার অধীনে নিজেদেরকে ঐক্যবদ্ধ করতে অসমর্থ হন। তাদের মধ্যে একাধিক ধর্মগুরু সৃষ্টি হয় এবং মত পার্থক্য দেখা দেয়। প্রটেস্ট্যান্ট সম্প্রদায় একাধিক সম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়। ধর্মীয় অনৈক্যের দরুন তার দ্বিখণ্ডিত ক্ষমতা দিয়ে পোপ বুর্জোয়া যাত্রাপথকে বন্ধ করতে ব্যর্থ হন। অপর দিকে বিভিন্ন প্রটেস্ট্যান্ট ধর্মগুরুর খ্রিস্টান ধর্মমতের যে প্রচার তা প্রকারান্তে বুর্জোয়া কার্যাবলিকে সমর্থন করে। ওয়েবার বলেন, "প্রটেস্ট্যান্ট ধর্মমতের প্রভাব বুর্জোয়া যাত্রাকে বিশেষভাবে সাহায্য করেছে।"


৫. চিত্রকলার স্বাধীনতা : প্রাচীন গ্রিক সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ, ধর্মীয় প্রভাব, বর্জিত কৃষ্টি, সংস্কৃতির প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা ও আকর্ষণ বর্ধিত হয়। ফলে কলা, ভাস্করবিদ্যা, সাহিত্য, দর্শন, সংগীত, চিত্রবিদ্যা, অংকবিদ্যা অনুশীলনে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন সূচিত হয়। গ্যগন সাহিত্যসেবীদের মধ্যে ইতালির অধিবাসি বিখ্যাত চিত্রশিল্পী লিওনার্দো দ্যা ভিঞ্চির নাম বিশেষভাবে উল্লেখ যোগ্য। তাছাড়াও মাইকেল এঞ্জেলো, রাফায়েল, টাইটিয়ান চিত্রশিল্পীর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।


৬. সংগীতে বিপ্লব : সকল ধর্মে গীতের বা সুরময় প্রার্থনার চর্চা আছে। মধ্যযুগে এ সংগীত ছিলো কেবলই ধর্মকেন্দ্রিক। রেঁনেসা এ আবদ্ধতা দূর করে মানুষের অন্তর্গত বোধ ও আবেগকে সুর ছন্দে মিলিয়ে তা সংগীতে রূপ দেয়। এক্ষেত্রে বিখ্যাত বিখ্যাত সংগীতের গুরুত্ব বাড়তে থাকে। নতুন নতুন সংগীত শিল্পীর জন্ম হয়। এক্ষেত্রে বিখ্যাত সংগীতে Porsteriana গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।


৭. বিজ্ঞানের অগ্রগতি : ষোড়শ শতকে প্রাকৃত ও গবেষণা মূলক বিজ্ঞান চরম উৎকর্ষতা লাভ করে। আর এ ক্ষেত্রে কপারনিকাস, টলেমী, গ্যালিলিও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তবে মানুষের মনে বিজ্ঞানের মননশীলতর পশ্চাতে ছিলো মানবদরদি পণ্ডিতদের দ্বারা উদ্দীপ্ত নতুন যুক্তিবাদী ও অনুসন্ধানী যুক্তিভঙ্গি।


৮. ভাস্কর্য বিদ্যা : রেঁনেসার যুগের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো ভাষ্কর্য বিদ্যার উৎকর্ষ সাধন। এক্ষেত্রে নিকালো, পিকাসো, ডোনাতেলো, যীবাতা, ডেরোসিও, ইয়ং মাইকেল, অ্যাঞ্জেলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।


৯. দেশীয় সাহিত্য : রেঁনেসার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো ইউরোপের ভিন্ন ভিন্ন দেশে দেশীয় সাহিত্যের সৃষ্টি ও বিকাশ। জাতীয় ভাষা, জাতীয় জ্ঞান, শিক্ষার প্রধান অবলম্বন বিধায় তৎকালিন পণ্ডিতরা দেশীয় সাহিত্য রচনায় আগ্রহ প্রকাশ করে। এক্ষেত্রে ঘ্যাস্তে, পেত্রাক, বোকাসিও, মার্টিন লুথারের নাম উল্লেখযোগ্য।


১০. ব্যবসায়ীদের মর্যাদা বৃদ্ধি : রেঁনেসার মাধ্যমে কুলীন বংশীয় ব্যবসায়ীদের মর্যাদা বৃদ্ধি পায়। মধ্যযুগে যেখানে বংশ ও জাত-পাতের মাধ্যমে মর্যাদা নির্ধারণ হতো, রেঁনেসার মাধ্যমে তার অবসান হয়। ব্যবসায়ীরা মুক্তভাবে ব্যবসার সাথে সাথে জ্ঞান-বিজ্ঞানে পৃষ্ঠপোষকতায় ব্যস্ত থাকে। ফলে ধীরে ধীরে তাদের মর্যাদার উন্নতি ঘটতে থাকে ।


উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, মধ্যযুগের শেষান্তে জ্ঞানের জগতে যে বিপ্লব সাধিত হয়েছিল তাই রেঁনেসা নামে খ্যাঁত। যার প্রধান উদ্দেশ্যই ছিলো মানবতাবাদের বিকাশ ও মানুষের মর্যাদা বৃদ্ধি। এর মাধ্যমে এক দিকে ধর্মীয় গোঁড়ামীও অন্ধবিশ্বাস থেকে মানুষ দূরে সরে যায় অন্যদিকে মানুষও মুক্তভাবে তার চিন্তার জগতে পরিবর্তন আনতে পারে। ফলে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও চিন্তার রাজ্যে বিপ্লব দেখা দেয়, যা রেঁনেসা নামে খ্যাত।


#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Now
Ok, Go it!