রোমান সম্রাট ও পোপতন্ত্রের মধ্যে সংঘাতের কারণ আলোচনা কর।

admin


ভূমিকা : মধ্যযুগে বিরাট ক্ষমতাবান সম্রাট ও পোপতন্ত্রের মধ্যে দ্বন্দ্ব একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। মধ্যযুগে ইউরোপীয় ইতিহাসের সাথে সামন্তবাদ ওতোপ্রতভাবে জড়িত। সামন্তবাদ যখন ক্ষমতার উচ্চাসনে অধিষ্ঠিত ঠিক তখনই ইউরোপবাসী দুটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানকে সর্বময় কর্তৃত্বের অধিকারি বলে মনে করতেন। এর মধ্যে একটি রোমান চার্চ ও অন্যটি রোমান সম্রাট। এ দুটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ক্ষমতার কোনো নির্দিষ্ট পরিধি না থাকায় উভয়ের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। চার্চ মনে করতো সম্রাট ও সম্রাট দেহস্বরূপ এবং পোপ আত্মা। কাজেই দেহ থেকে আত্মাই শ্রেষ্ঠ। ফলে তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। 


রোমান সম্রাট ও পোপতন্ত্রের মধ্যে সংঘাতের কারণ আলোচনা কর।

রোমান সম্রাট ও গোপতন্ত্রের মধ্যে সংঘাতের কারণ : 

নানাবিধ কারণে মধ্যযুগে রোমান সম্রাট ও পোপের মধ্যে সংঘাত দেখা যায়। নিম্নে বিশেষ বিশেষ কারণ ব্যাখা করা হলো : 


১. পোপ কর্তৃক শার্লামেন ও বংশধরদের অভিষেক : রোমান পতনের ৩০০ বছর পর রোমকে কেন্দ্র করে টিউটনদের ফ্রাঙ্ক শাখাটির রাজা শার্লামেন রোমান সাম্রাজ্য পুনর্গঠনে আত্মনিয়োগ করেন। এই বিখ্যাত নরপতি হচ্ছেন। টুস বিজয়ী চার্লস মার্টেনের পৌত্র। তার সাথে যুক্ত ছিলেন টিউটন স্বাধীনতা কাম্য যোদ্ধারা। ৮০০ খ্রিস্টাব্দে পোপ ৩য় লিও তাকে সোনার মুকুট পরিয়ে পবিত্র রোমান সম্রাট হিসেবে ঘোষণা দেন। এ ঘটনায় শার্লামেন বংশধররা ও পোপ কর্তৃক অভিষিক্ত হতো। ফলে এই বিষয়কে অন্যান্য অঞ্চলের রোমান সম্রাট মেনে নিতে পারেনি বলেই পোপ ও সম্রাটের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। 


২. চার্চের ধন সম্পদ বৃদ্ধি : জার্মান বর্বর আক্রমণের সময় থেকে ধর্ম প্রচার ও জনহিতকর কাজের মধ্য দিয়ে চার্চ ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে ওঠে। ধর্মপ্রাণ মানুষ ধনী ব্যক্তিদের দান অনুদান, কৃষক, ভূমিদাসের কর প্রদানের ফলে চার্চের ধনসম্পতি বেশ বৃদ্ধি পায়। রোমান সাম্রাজ্যের পতনের ফলে জনগণের নিরাপত্তা দানকারী মানুষ জমিজমা ও সম্পতি দান করে। চার্চের অধীনেও ছিলো অনেক জমি। গবেষকদের মতে খ্রিস্টান জগতে মোট জমির তিন ভাগের একভাগ ছিলো চার্চের। ফলে চার্চ ধর্মীয় ক্ষমতা ছাড়াও রাজনৈতিক ক্ষমতার অধিকারী হয়ে পড়ে। ফলে সম্রাট এ সমস্ত সক্ষমতা ও সম্পদ ভালোভাবে মেনে নিতে পারেনি। কাজেই দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। 


৩. পোপের নিজস্ব আইন ও বিচার ব্যবস্থা : রোমান সাম্রাজ্য পতনের পর এবং সম্রাটদের দুর্বলতার সুযোগে এবং ক্রমাগত ক্ষমতা বৃদ্ধিকারী পোপতন্ত্র ক্রমেই নিজস্ব আইন-কানুন, শালিস ও বিচারালয় স্থাপন করে। চার্চের নিয়ম ভঙ্গের অপরাধে রাজা-প্রজা এমনকি একটি গোটা দেশকে একঘরে করার ক্ষমতা অর্জন করে রোমান চার্চ। প্রচলিত ধর্মমতের বিরোধিতাকারীদের শাস্তিদানে হোলী ইনকুইজিশন নামক আদালতও তারা গঠন করে। চার্চের এ ক্ষমতা বৃদ্ধি রোমান সম্রাটের সার্বভৌম ক্ষমতাকে সংকটের মুখে ফেলে দেয়। ফলে দ্বন্দ্ব অনিবার্য হয়ে পড়ে। 


৪. সামন্ত স্বাধীনতা : ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স যখন জাতীয় রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে উঠেছিল জার্মান ও ইতালিতে তখন দেখা দিয়েছিলো রাজনৈতিক অধঃপতন। জার্মান নৃপতিরা শার্লামেনের উত্তরাধিকারী হিসেবে নিজেদের সম্রাট মনে করে জার্মান ও ইতালি দুই দেশেই কর্তৃত্ব করতে চাইতেন। তাই তারা কেন্দ্রীয় সরকার গড়ে তুলতে পারেনি। এ সময় পদ মর্যাদা নিয়ে সম্রাট ও পোপদের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়। এ অশান্তি নিয়ে পোপদের দিন ভাল কাটছিল না। এ সময় মুসলমানদের সাথেও বাইজেনন্টাইন যুদ্ধে ব্যস্ত ছিলো। ফলে সম্রাট ও পোপদের সম্পর্ক দিন দিন অবনতি ঘটতে থাকে। 


৫. পোপের সাহায্যে সম্রাটের পদ লাভ : ৮০০ খ্রিস্টের পর শার্লামেনকে পোপ ৩য় লিও সোনার মুকুট পরিয়ে পবিত্র রোমান সম্রাট হিসেবে ঘোষণা দেবার পর হতে এ ধারণা প্রচলিত হয় যে, পোপের অনুমোদন ছাড়া কোনো ব্যক্তিরাই সম্রাট হিসেবে সম্রাট পদে অধিষ্ঠিত হবার ক্ষমতা বা অধিকার নেই। এই সময় জার্মানি থেকে জার্মান রাজাদের মধ্যে রোমে গিয়ে পোপের সাহায্যে সম্রাট ঘোষিত হওয়ার রেওয়াজ প্রচলিত ছিলো। এতে সম্রাটরা ভীষণভাবে বিচলিত হতেন। ও বিরক্ত প্রকাশ করতেন। পরে সম্রাটগণ সুসংহত হবার পর অটোনিয়ম করেছিলেন যে সম্রাটের অনুমোদন ছাড়া কেউ পোপ বলে গণ্য হবেন না। এতে করে পোপ ও সম্রাটের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। 


৬. পোপ সপ্তম গ্রেগরি কর্তৃক সম্রাটের কর্তৃত্ব অস্বীকার : মধ্যযুগে সম্রাট ও পোপতন্ত্রের মধ্যে সংঘর্ষের ক্ষেত্রে পোপ সপ্তম গ্রেগরীর ভূমিকা ছিলো গুরুত্বপূর্ণ। এগার শতকে সপ্তম পোপ হন হিন্ডিব্রোন্ড। এই সময় থেকেই মূলত দ্বন্দ্ব চরম আকার ধারণ করে। সম্রাট ৪র্থ হেনরী ও পোপ সপ্তম গ্রেগরীর এ দ্বন্দ্ব পশ্চিম ইউরোপের খ্রিষ্টিন সমাজকে বিশেষভাবে হতাশায় নিমজ্জিত করে। গ্রেগরী ছিলেন আপোষহীন ও উগ্রপন্থী বৈপ্লবিক সংস্কারক। পোপ ও পোপতন্ত্রের স্বাধীনতা, ক্ষমতা, সম্মান এবং প্রতিষ্ঠান। তিনি ছিলেন আপোষহীন। তিনি নিজেকে ঈশ্বরের প্রতিনিধি ঘোষণা দিয়ে সম্রাটকে নিজের অধীন হিসেবে ঘোষণা দিলে দ্বন্দ্ব চরম আকার ধারণ করে। 


৭. পোপ কর্তৃক সম্রাটকে সমাজচ্যুত ঘোষণা : সম্রাট ও পোপের মধ্যে সংঘর্ষের ইতিহাসে পোপ আলেকজান্ডারের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সম্রাট প্রথম ফ্রেডারিক ছিলেন জার্মান শাসক। তিনি পোপের ক্ষমতা খর্ব করার চেষ্টা করেন। কিন্তু তার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। তিনি ক্ষমতায় থাকাকালে অন্যান্য কার্ডিনালকে উপেক্ষা করে অক্টাভিয়ানকে পোপ ঘোষণা করলে অন্যান্য কার্ডিনাল অগ্রাহ্য করে ৩য় আলেকজান্ডারকে কার্ডিনাল পোপ নিযুক্ত করে। এটা ছিলো চার্চের সর্বোচ্চ আসনে পরিবর্তনের ছোয়া। পোপ নিযুক্ত হয়েই তিনি তার প্রতিদ্বন্দ্বী পোপ প্রার্থী ও সম্রাট প্রথম ফ্রেডারিককে সমাজচ্যুত ঘোষণা করেন। 


৮. পোপের একক অধিশ্বর ঘোষণা : সম্রাট ও পোপতন্ত্রের মধ্যে সংঘর্ষে পোপ ৩য় ইনোমেন্টের ভূমিকা বিশেষভাবে উল্লেখ যোগ্য। তার সময় পোপের ক্ষমতা সবচেয়ে বেশি বৃদ্ধি পেয়েছিলো। চার্চ তার ক্ষমতার সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছেছিল। ১১৯৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি ক্ষমতাসীন হয়েই রোম থেকে বার বার ঘোষনা দেন খ্রিস্টীয় সমাজকে সর্বদা বিনত থাকতে হবে অদ্বিতীয় এক শক্তির নিকট, সে শক্তি নিয়ত প্রকাশিত হয় সেন্ট পিটারের উত্তরসূরি পোপের মধ্য দিয়ে। তিনি বলেন ঈশ্বরের যাবতীয় নির্দেশ আসে পোপের মাধ্যমে কাজেই পোপের বাণী ঈশ্বরের বাণীর প্রতিচ্ছবি। তিনি সম্রাটসহ সকলকে পোপের বাণী মেনে নিতে বাধ্য করেন। 


৯. অযাজকীয় প্রতিষ্ঠানে কর না দিতে নির্দেশ : পোপ বনিফেস ১৯৯৬ খ্রিস্টাব্দে যাজক সম্প্রদায়কে নির্দেশ করেন যে, তারা যেন কোনো অযাজকীয় প্রতিষ্ঠানে কর প্রদান না করে। অষ্টম বনিফেসের এ ঘোষণা ও নির্দেশ সম্রাট ও পোপতন্ত্রের সংঘর্ষের এক উত্তপ্ত অধ্যায়। পোপের নির্দেশের পর সম্রাট প্রথম এডওয়ার্ড পোপের নির্দেশ মান্যকারী কতিপয় যাজককে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করেন। ফলে দ্বন্দ্ব, সংঘাত, সংঘর্ষ চরম আকার ধারন করে । 


১০. সম্রাট ঈশ্বরের প্রতিনিধি : ১৩৬৬ সালে সম্রাট তৃতীয় এডওয়ার্ড পোপকে কর দিতে অস্বীকার করলেন। জার্মানির সামন্তরা বলতে শুরু করলেন যে, সম্রাট সাক্ষাৎ ঈশ্বরের থেকে ক্ষমতা লাভ করে। অপর দিকে পোপরাও নিজেদেরকে ঈশ্বরের প্রতিনিধি মনে করেন। একমাত্র ঈশ্বর ছাড়া কেউ তাদের বিচার করতে পারবে না। এ ধরনের পরস্পরবিরোধী মনোভাবের কারণে দ্বন্দ্ব অনিবার্য হয়ে যায়। 


উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, মধ্যযুগে সম্রাট ও পোপতন্ত্রের দ্বন্দ্ব ও সংঘর্ষ ছিলো একটি স্বরণীয় ঘটনা। প্রথমত ও প্রধানত সার্বভৌম ক্ষমতা ও শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে মধ্যযুগে সম্রাট ও পোপত্তন্ত্রের মধ্যে দ্বন্দ্ব প্রকট হয়ে ওঠে। তবে ১৫ শতকের প্রথম দিকে রেঁনেসা ও ধর্মসংস্কার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে গোপতন্ত্রের অবক্ষয় ও বিলুপ্তি হলে এই দীর্ঘ সংঘর্ষের অবসান ঘটে।

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Now
Ok, Go it!