মধ্যযুগের অর্থনীতিতে কৃষির অবদান ব্যাখা কর।

admin

 

ভূমিকা : মধ্যযুগে কৃষির বিকাশ ছিলো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বিশেষ করে ১০০০ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে ভূস্বামী ও কৃষক প্রজার সম্পর্কে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের পাশাপাশি ভূমিকর্ষণ, সার প্রয়োগ, উন্নত ব্যবস্থা, কৃষি যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জামের ব্যবহার । বিভিন্ন ধরনের শস্য উৎপাদন ও আনুপাতিক হারে পশুপালন ও কৃষি কাজের সম্প্রসারণ মধ্যযুগের অর্থনীতিতে বিশেষ অবদান রাখে। আধুনিক কালের তুলনায় মধ্যযুগে কৃষি উৎপাদন কম ছিলো তাতে কোনো সন্দেহ নেই । কিন্তু তবুও মধ্যযুগের সমাজের ভিত ছিলো কৃষি ব্যবস্থা।


মধ্যযুগের অর্থনীতিতে কৃষির অবদান ব্যাখা কর।


মধ্যযুগের অর্থনীতিতে কৃষির অবদান : অর্থ এবং খাদ্য ছাড়া জীবন অসাড়। তাই মধ্যযুগে অর্থনীতি সচল রাখতে এবং খাদ্যের যোগান দিতে কৃষি ছিলো প্রধান মাধ্যম। নিম্নে মধ্যযুগে অর্থনীতিতে কৃষির অবদান উল্লেখ করা হলো :


১. প্রধান জীবিকা : মধ্যযুগে মানুষের প্রধান জীবিকা ছিলো কৃষি। এরও আগে মানুষ কৃষি ছাড়া অন্য কিছু কল্পনাও করতে পারত না। মধ্যযুগে সামন্ততন্ত্র এবং ম্যানর প্রথা শুধুমাত্র কৃষিকেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছিলো। ম্যানর প্রথা ছিলো গ্রাম কেন্দ্রিক কৃষিভিত্তিক অর্থনৈতিক সংগঠন। সামন্তযুগে কৃষিকে কেন্দ্র করে যে অর্থব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল তাই ম্যানর প্রথা। ম্যানর প্রথা ছিলো একটি অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান। এর মাধ্যমেই কৃষক তার জীবিকা নির্বাহ করত ।


২. জমি তৈরি ও চাষাবাদ : আধুনিক কালের কৃষির সাথে মধ্যযুগের কৃষির তুলনা কোনভাবেই হয় না। কারণ তখন জমিতে উন্নত বীজ ও সার ব্যবহার সম্ভব ছিলো না। এর মধ্যে অনুন্নত ভূমি কর্ষণ ব্যবস্থাও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। গোবর জাতীয় জৈব সার সর্বত্র পাওয়া যেত না। দুই একবার চাষ করে জমি উর্বরতার জন্য ফেলে রাখতে হতো। ফলে পর্যাপ্ত জমি ও চাষাবাদের জন্য ব্যবহার করা যেত না। জমি চাষে শুধুমাত্র লাঙ্গল দ্বারা গরু দিয়ে হাল চাষ করা হতো। এভাবেই কৃষি ও উৎপাদন কাজ সম্পূর্ণ করা হতো।


৩. জমির উর্বরতা বৃদ্ধির চেষ্টা : জমির উর্বরতা বৃদ্ধির জন্য মধ্যযুগে সাধারণ দুটি পদ্ধতি অবলম্বন করা হতো।


(ক) পরপর কয়েক বছর জমি চাষ করার পর তার উর্বরতার জন্য কিছু কাল পতিত রাখা হতো। সাধারনত পাহাড়ি অঞ্চলে এ প্রথা চালু ছিলো।


(খ) ক্ষেতের অংশ বিশেষ পর্যায়ক্রমে ২/৩ বছর হতে ৩/৪ বছর পর্যন্ত চাষ না করে ফেলে রাখা হতো। এই পদ্ধতি সাধারণত সমতল ভূমিতে অনুসৃত হয়। এ পদ্ধতি জিরেণ পদ্ধতি নামে পরিচিত ছিলো। এতে নামেমাত্র কৃষির উৎপাদন বাড়ত। যা মোট উৎপাদনের সাথে যুক্ত হয়। এভাবে জমির উর্বরতা বৃদ্ধির চেষ্টা অব্যাহত থাকে।


৪. ফসল উৎপাদনে যন্ত্রপাতির ব্যবহার : মধ্যযুগে কৃষির উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য মধ্যযুগীয় যন্ত্রপাতি ও প্রকৃতির উপর নির্ভর করতে হতো। এ সময় হতে কৃষি কাজে সরঞ্জাম ব্যবহারেও পরিবর্তন আসে। ফসল উৎপাদনে কর্ষণ পদ্ধতির পরিবর্তন দেখা যায়। কর্ষণের জন্য লাঙ্গলের সাথে হালকা লোহা জাতীয় যন্ত্র ব্যবহার করা হতো। লাঙ্গল থেকে সহজ সাধ্য ছিলো। এছাড়াও আগাছা পরিষ্কারে নিড়ানী, ফসল কাটতে কাস্তে ব্যবহার হতো। জমির প্রয়োজনে সার ও সেচ ব্যবস্থা ও জল নিষ্কাশনের পদ্ধতি অভাবনীয় উন্নতি হয়। যা মধ্যযুগের অর্থনীতিকে সচল করে।


৫. উন্নত জলসেচ ও নিষ্কাশন পদ্ধতি : ইউরোপের বিভিন্ন দেশে পশুচারণভূমি ও কৃষি ক্ষেত্রে জলসেচের ব্যবস্থা ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে এবং এক্ষেত্রে ইতালি ছিলো পথ প্রদর্শক। ১১৩৮ খ্রিস্টাব্দে মিলানের নিকটকর্তী, স্থানে জলধারা তৈরি হয় এবং ১২৫০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে পো নদীর উত্তরে প্রায় সব অঞ্চলেই সুষ্ঠু জলসেচ ব্যবস্থা চালু হয়। পার্মা, মোডেনা এবং বোলোন্যার কৃষি ভূমিতে চৌদ্দ শতকের ব্যাপক জল সেচের বন্দোবস্ত হয়। এছাড়াও অতিরিক্ত জলে যেন ফসল নষ্ট হয়ে না যায় সেজন্য পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করা হয়।


৬. শস্যাদি ব্যবহার উপযোগী করা : কৃষি উন্নতির সাথে সাথে মধ্যযুগে শস্যাদি ব্যবহার উপযোগী করে তোলার বিষয়টিও ছিলো বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। বাতাসচালিত ও জলস্রোত চালিত জাঁতা কল দ্বারা শস্য চূর্ণ করার পদ্ধতি চালু হয় বার ও তের শতকে ইউরোপের সর্বত্র। এই পদ্ধতির ফলে মানুষের শ্রম ভিন্ন কাজে ব্যবহার করা সম্ভবপর হয়েছিলো।


৭. অনুকূল আবহাওয়া ও জলবায়ু : মধ্যযুগে ইউরোপে কৃষি ও অর্থনীতির উন্নয়নের অন্যতম প্রধান কারণ ছিলো। অনুকূল আবহাওয়া ও জলবায়ু। উত্তমভাবে চাষ ও কর্ষণ করে জলসেচের মাধ্যমে চাষ করলে ভালো ফসল ফলত। যা দ্বারা কৃষক তার প্রয়োজন মিটিয়ে স্থানীয় বাজারে উদ্বৃত্ত অংশ বাজারে বিক্রি করতে পারতো। এর ফলে ধীরে ধীরে স্থানীয় বাজারগুলোই বাণিজ্য বাজারে পরিণত হয়।


৮. বিভিন্ন ধরনের ফসল উৎপাদন : কৃষি অর্থব্যবস্থাকে চাঙ্গা করতে তের শতকে কৃষি উৎপাদনের ধরন বদলে যেতে থাকে। বিভিন্ন ধরনের সবজি ও নানা প্রকার ডাল চাষে মানুষের আগ্রহ বৃদ্ধি পায়। ইতালি ও দক্ষিণ ফ্রান্স ছাড়াও জার্মান, ইংল্যান্ড প্রভৃতি স্থানে আঙ্গুর ও আপেল চাষ শুরু হয়। এছাড়াও ইউরোপের বিভিন্ন স্থানে পিচফল, চেরী, নাশপাতি ও আপেল জাতীয় ফসলের উৎপাদন ও চাহিদা বেড়ে যায়। ফলে অর্থনীতিও সচল হতে থাকে।


৯. কৃষি কেন্দ্রিক ব্যবসা : মধ্যযুগে ব্যবসার সূচনাই হয় কৃষিকে কেন্দ্র করে। শ্রমের বিনিময়ে ভূমিদাসরা মুক্ত হয়ে নিজস্ব জমিতে ইচ্ছামত চাষ করে ফসলের উৎপাদন বাড়াতে থাকে। ফলে উৎপন্ন ফসলের উদ্বৃত্ত তারা বাজারে বিক্রি করে প্রবৃদ্ধি অর্জন করে । ফলে ধীরে ধীরে কৃষি উৎপাদন ও কৃষি কেন্দ্রিক ব্যবসা-বাণিজ্য বেড়ে যায়।


১০. বাজার ও বাণিজ্য : মধ্যযুগে ধীরে ধীরে কৃষি কেন্দ্রিক ব্যবসার উন্নতি ঘটলে ধীরে ধীরে তা বাজার ব্যবস্থায় স্কুপ নেয়। স্থানীয় বাজারগুলো আন্তর্জাতিক রূপ লাভ করে। বাজার ও বাণিজ্যকে কেন্দ্র করে শহর ও নগর গড়ে ওঠে একই সাথে সুষ্ঠু বাণিজ্যের জন্য গড়ে ওঠে সংগঠন।


উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, মধ্যযুগে সামন্ত ও ম্যানর প্রথা কিছুটা দুর্বল হলে কৃষি ব্যবস্থার উন্নতি সাধিত হয়। যা ঐ সময়ের মানুষের জীবন যাত্রার মানকে পাল্টে দেয়। মানুষ যেকোন উন্নয়নের দিকে ঝুঁকে পড়ে। মধ্যযুগে এ পর্বে কৃষিকে কেন্দ্র করে সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনের মান ও উন্নতি ঘটে। জীবন-আচরণে পরিবর্তন আসে।


#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Now
Ok, Go it!