মধ্যযুগে ইউরোপে শহরের বিকাশ আলোচনা কর।

admin

 

ভূমিকা : মধ্যযুগের শহর উত্থানে ব্যবসা-বাণিজ্যেরও জনসংখ্যার যেমন ভূমিকা ছিল ঠিক তেমনি শহর বিকাশেও উক্ত উপাদান গুলোর ভূমিকা বিদ্যমান ছিল। ইউরোপে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে তাদের চাহিদাও বেড়ে যায়। যার ফলে জীবন জীবিকা পায় নতুন মাত্রা। প্রয়োজনের তাগিদে তারা উৎপাদনে এগিয়ে এসে শিল্পের প্রসার, ঘটায়। আর তখনই যেসব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শহর গড়ে উঠেছিল তা দ্রুত বিকাশের পথ লাভ করে। বার শতকে রোমান সাম্রাজ্যধীন নিউনিয়া, বার্লিন, জেমোয়ার, ভেনিস বেলেগান ইত্যাদি শহর বিশালাকার ধারণ করে। এছাড়াও অন্যান্য শহর বিকাশে কয়েকটি কারণ খুঁজে পাওয়া যায়।


মধ্যযুগে ইউরোপে শহরের বিকাশ আলোচনা কর।


মধ্যযুগের ইউরোপীয় শহরের বিকাশ :

নিয়ে মধ্যযুগে ইউরোপের শহর বিকাশের চিত্র তুলে ধরা হলো :


১. হেনসিয়াটিক লীগ : তের শতকে হেনসিয়াটিক লীগ নামে একটি বিশাল ব্যবসায়ী সংগঠন গড়ে ওঠে। উত্তর জার্মানিতে প্রতিষ্ঠিত এ প্রতিষ্ঠানে প্রায় ৭০ টি শহর ছিল। এই প্রতিষ্ঠানের কাজ ছিল নিয়ন্ত্রণাধীন শহরে বাণিজ্যের নিরাপত্তা দান ও বৈদেশিক বাণিজ্যে একচেটিয়া অধিকার দান। শহরগুলোর নিরাপত্তার জন্য এরা নৌ-বাহিনী গড়ে তোলে। আর নিরাপদ বাণিজ্যের কারণে শহরগুলোতে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটে যা শহর বিকাশে সহায়তা করে।


২. ব্যবসায়ী সংগঠন : বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড বেড়ে যাওয়ায় শহরগুলোতে কারিগরি ও ব্যবসায়ীরা স্থানীয়ভাবে বসবাস শুরু করে। তখন তারা পাস্পরিক ও ব্যবসায়ী স্বার্থে গিল্ড (guild) নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলে। গিল্ড ছিল দু- প্রকার। একটি ব্যবসায়ীদের অন্যটি কারিগরদের। এর কাজ ছিল বাজার নিয়ন্ত্রণ, শৃঙ্খলা রক্ষা, শহরের প্রতিরক্ষা, বেকারদের কর্মদানসহ ব্যবসার সকল ধরনের সমস্যা সমাধান- যা শহর বিকাশে সহায়তা করে।


৩. কারিগরি সংগঠন ও প্রযুক্তির অগ্রগতি : শহর উদ্ভাবনের সাথে সাথে কারিগরি শ্রেণি ঐক্যবদ্ধ হয়ে নিজেদের স্বার্থে সংগঠন গড়ে তোলে। কারিগরি শ্রেণি ক্রমেই প্রযুক্তির দিকেও অগ্রসর হয়। যেমন ঢাক বহুল ঘোড়ার গাড়ি ব্যবহার, কাগজ, বারুদ, কম্পাস, উলের মিল ইত্যাদি অর্থনীতিকে সম্পদশালী করে তোলে। যা শহর বিকাশে অগ্রগতির দিকে নিয়ে যায় ।


৪. মুদ্রা ও ব্যাংকিং ব্যবস্থা : মধ্যযুগের এক পর্যায়ে ব্যবসায়ীরা মুদ্রা প্রচলন শুরু করে আর মুদ্রা ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠে ব্যাংকিং ব্যবস্থা- যা জনগণকে এনে দেয় আর্থিক নিরাপত্তা। এ ব্যবস্থা শহর বিকাশে সহায়তা করে। ব্যবসায় যখন নতুন মুদ্রা ও ব্যাংকিং ব্যবস্থার প্রচলন হয় ব্যবসায় এক নতুন দিগন্তের উন্মোচন হয়। ব্যবসা ক্রমাগত উন্নতি সাধন করে। ব্যবসায়ীরা ব্যবসা করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। নতুন নতুন এলাকা আবিষ্কার করে। ফলে ক্রমাগত শহরের বিস্তার ঘটতে থাকে।


৫. দুর্গ-নির্মাণ : শহর বিকাশে দুর্গ বিশেষ ভূমিকা পালন করে। দুর্গের নিরাপত্তার জন্য সামন্ত প্রভুরা সৈন্য সামন্ত দুর্গে জড়ো করতো। এসব বর্ণ বা দুর্গে বসবাসের জন্য কারিগরগত সামন্ত প্রভুদেরকে প্রথম দিকে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ। প্রদান করত। তাই অনেক লর্ড তার নিজ এলাকায় অর্থের স্বার্থে কারিগরদেরকে আমন্ত্রণ জানাত। একই সাথে তারা নতুন নতুন দুর্গ নির্মাণ করত। যাতে মুনাফা অর্জন করা যায়। ফলে খুব দ্রুত সময়ে শহর বিকশিত হয় ।


৬. যুদ্ধবিগ্রহ ও ইজারা প্রথা : সামস্ত যুগে নগরের সামন্ত প্রভুদের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব লেগেই থাকত। যে সমস্ত সামন্তব্যারণ যুদ্ধ বিগ্রহ, বিলাস ব্যাসনের জন্য অর্থ ব্যয় করে অভাবগ্রস্ত হয়ে পড়ত, তারা অর্থের বিনিময়ে নগরের এলাকা ইজারা দিতো এবং একই সাথে ব্যবসায়িদের কিছু সুযোগ সুবিধা প্রদান করতো। এতে ব্যবসায়ীরা স্বাধীনতা ভোগ করত। এ সমস্ত জায়গায় তারা বাজার গড়ে তুলত। বিশেষ করে তারা নদী তীরবর্তী এলাকাগুলো ব্যবসায়িরা বেয়ে নিত। ফলে নদী অঞ্চলে শহর সবচেয়ে দ্রুত বিকাশ লাভ করে।


৭. রাজনৈতিক চেতনার বিকাশ : স্বাধীন ব্যবসায়ীরা নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ প্রদান ছাড়া অন্য কোনো কর বা ব্রিজ বন্ধু নদী কর, বিক্রি কর প্রভৃতি দিতে হতো না। ব্যবসায়ীদের মধ্যে দ্বন্দ্ব মীমাংসা ও পুলিশি মামলা পরিচালনার দায়িত্ব ব্যবসায়ীদের মধ্যে থাকত। এভাবে ব্যবসায়ীদের মধ্যে ধীরে ধীরে একটি রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার লাভ করে শহর গুলো সামন্ত প্রভুদের প্রভাব মুক্ত হয়ে টাউন কাউন্সিল গঠন করা হয়। মেয়র ছিলেন এর প্রধান যিনি সাধারণ ব্যবসায়ী। কর্তৃক নির্বাচিত হতেন এই কাউন্সিল প্রতিরক্ষা, জনহিতকর কার্যাবলি ও শিল্প, বাণিজ্য সংক্রান্ত কার্য পরিচালনা করতো।


৮. ক্রুসেড যোগদান : শহর বিকাশ ও ধর্মীয় উদ্দীপনায় উদ্দিপ্ত হয়ে বহু লর্ড এগার থেকে তের শতকে ক্রুসেডে যোগ দান করে। কিন্তু তাদের অর্থের যোগান দেয় ব্যবসায়ী। বিনিময়ে তারা জমি ও ইজারা পেত। কিন্তু ক্রুসেড থেকে ফিরে কোনো লর্ড জমি ফেরত নিতে পারত না। ফলে গড়ে ওঠা শহর গুলো ব্যবসায়ীদের মধ্যে স্থায়ীভাবে চলে যায়। এভাবে বহু শহর সামন্ত প্রভুদের থেকে মুক্ত হয়ে যায়। এ সময় রাজকীয় শক্তি সামন্ত প্রভুদের দমন করতে বণিক সমাজকে সাহায্য করতে থাকে।


৯. ধর্মীয় নেতাদের প্রভাব : মধ্যযুগে চার্চ ছিল ধর্মের প্রধান কেন্দ্রস্থল এবং এর প্রধান ছিল যাজক নিজে। এ সমস্ত যাজকের মধ্যে কোনো কোনো যাজক নৈতিক দিক দিয়ে উন্নত ছিল। তারা চার্চে আসা সাধারণ মানুষকে প্রকৃত খ্রিস্টান। ধর্মের শিক্ষা দিত। ফলে শহরের মানুষগুলো অল্প সময়ে ধর্মীয় শিক্ষা পায় যা শহর বিকাশে সহায়তা করে।


১০. নগর এসোসিয়েশন গঠন : ব্যবসায়ীগণ শহর শাসনের অধিকার পেলেও তাদের ক্ষমতা ছিল সীমাবদ্ধ। তাই অনেক নতুন শহরে তাদের অধিকার আদায়ের জন্য নগর এসোসিয়েশন গড়ে তোলে। এদেরকে কমিউন বলা হতো। তের শতকে ইতালি ফ্রান্সে অনেক কমিউন প্রতিষ্ঠিত হয়। শহরবাসী বিদ্রোহ করে অধিকার আদায় করে। এভাবে কমিউনের উন্মেষ ঘটে। যা নগর বিকাশ কমিউন দ্বারা উন্নতি সাধিত হয়। এই কমিউনগুলোর অধিকাংশ পুরো দেওয়াল দিয়ে ঘেরা থাকত । এভাবে ধীরে ধীরে কমিউন থেকে নগরের যথেষ্ট উন্নতি ঘটে।


উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, নগর বিকাশে যাদের অবদান সবচেয়ে বেশি ছিল তারা হলো নব মুক্তি পাওয়া ব্যবসায়ি, বণিক ও রাজকীয় শক্তি। ব্যবসা বাণিজ্যের সুবিধার্থেই মূলত লর্ডরাও শহর বিকাশে বাধা দেয়নি। বরং নিজেরাও এর মাধ্যমে স্বার্থ হাসিল করে। ফলে এক প্রকার বিনা বাধার দেশ থেকে দেশান্তরে নব নব নতুন নতুন শহর বিকাশ লাভ করে।


#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Now
Ok, Go it!