সামাজিক রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক জীবনে মধ্যযুগীয় শহরগুলোর প্রভাব আলোচনা কর।

admin


ভূমিকা : মধ্যযুগে নতুন ভাবে উদ্ভব ও বিকাশকারী নগর গুলো সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে সুদুর প্রসারি প্রভাব বিস্তার করে। মানব সভ্যতার ইতিহাস মধ্যযুগের শহর গুলোর কাছে নানা দিক দিয়ে ঋণী। মধ্যযুগে সামন্ত প্রথা ও ম্যানর প্রথা যখন চারদিকে ছড়িয়ে পরতে থাকে তখন একই সাথে মানুষের প্রয়োজনে সমান্তরালভাবে নগর সভ্যতাও বিকশিত হয়। যা ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণে বিশেষ অবদান রাখে। ভূমিদাসরা তাদের বংশানুক্রমিক দাস অবস্থা থেকে মুক্তি পায় -


সামাজিক রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক জীবনে মধ্যযুগীয় শহরগুলোর প্রভাব আলোচনা কর।


মধ্যযুগীয় শহরের প্রভাব : নিম্নে মধ্যযুগীয় ইউরোপের ইতিহাসে সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে শহরের প্রভাব আলোচনা করা হলো :


১. দুইটি নতুন শ্রেণির উদ্ভব : মধ্যযুগীয় শহর সমূহ সমাজে দুটি নতুন শ্রেণির সূচনা করে বুর্জোয়া, ব্যবসায়ী, ব্যাংকার পুঁজিপতি, শিল্পপতিসহ অভিজাত শ্রেণি এবং দক্ষ ও অদক্ষ শ্রমিকসহ শ্রমজীবী শ্রেণিমধ্যযুগে অধিকাংশ অর্থনৈতিক ও সামাজিক কর্মকাণ্ড এমনকি রাজনৈতিক ইতিহাসও এ দুটি শ্রেণি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতো। শ্রমজীবী শ্রেণি থেকে পরবর্তীতে পলেতারিয়েত শ্রেণির উদ্ভব হয়। বুর্জোয়া হতে তৃতীয় শ্রেণি অর্থাৎ Thirdestate লক্ষ্য করি- যা সাধারণ মানুষের ভাগ্য নির্ধারণে বিশেষ ভূমিকা পালন করে ।


২. সামন্ত প্রথার অবসান : সামন্ততন্ত্র ও ম্যানর প্রথা অবসানে শহরের উদ্ভব বিশেষ ভূমিকা পালন করে। এটা মধ্যযুগে সামন্ত প্রভু ও ভূমিদাসের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব ছিল তার অবসান ঘটাতে সক্ষম হয়। এটা মধ্যযুগের নির্যাতিত, অবহেলিত, অত্যাচারিত ভূমিদাসদেরকে দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হবার পথ প্রশস্ত করে। এ সময় ভূসম্পতি আর পদমর্যাদা ও ক্ষমতার মাপকাঠি হিসেবে বিবেচিত হয়নি। জায়গীরের পরিবর্তে এ সময় অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্যের উপর সামাজিক পদমর্যাদা ও প্রতিপত্তি নির্ভরশীল হয়ে পড়ে।


৩. ভূমিদাসের স্বাধীনতা লাভ : ভূমিদাসদের জন্য শহরগুলো স্বাধীনতার স্বর্ণস্থলে পরিণত হয়। কারণ শহরের বিকাশের ফলে ভূমিদাস প্রথার পতন ঘটে। এবং ভূমিদাসরা ম্যানর ও সামন্ততন্ত্রের বাধনে আবদ্ধ থাকে না। অর্থের প্রয়োজনে সহজেই তারা নিজেদের উৎপাদিত দ্রব্য খোলা বাজারে বিক্রয় করতে পারত। শহরগুলো দুর্গ বা সন্ন্যাসী আশ্রম ছিল না। শহর ছিল উদ্বৃত্ত কৃষি দ্রব্য বিক্রির স্থান এবং শিল্প মালিকের পুঁজি লেনদেনের বাজার।


৪. রাজনৈতিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা : সমৃদ্ধশালী শহরে উন্নত প্রশাসনিক ব্যবস্থা প্রচলিত হয় এবং সাফল্যজনক বিভিন্ন রাজনৈতিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। এর মাধ্যমে প্রতিনিধিত্বমূলক রাজনৈতিক ব্যবস্থা চালু হয়। সমৃদ্ধশালী ও জনবহুল নগরগুলোতে সাফল্যজনকভাবে তাদের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে এবং তারা রাজাকে এসব প্রতিষ্ঠানের গুরুত্ব উপলব্ধি করাতে সক্ষম হয় ।


৫. জাতীয় রাজতন্ত্রের অভ্যুদয় : শহরসমূহ জাতীয় রাজতন্ত্রের উত্তরণে বিশেষ অবদান রাখে, ব্যবসায়ী, বণিক, মহাজন শ্রেণি। উপলব্ধি করেছিল যে সুসংহত ও দৃঢ় কেন্দ্রীয় ক্ষমতাই একমাত্র তাদের শ্রেণি স্বার্থ ও শোষণের পথ নিরাপদ রাখতে পারে। তাই তারা রাজাকে কেন্দ্রিক ক্ষমতা পুনরুদ্ধারে সাহায্য করে। এই শ্রেণি নিয়মিতভাবে সৈন্যসামন্ত দিয়ে, ভরণ পোষণ দিয়ে রাজাকে সামন্ত সামরিক নির্ভরতা হতে মুক্ত হতে সাহায্য করে। এভাবে রাজা মধ্যবিত্ত শ্রেণির সাহায্যে রাজকীয় ক্ষমতা পুনরুদ্ধারে সক্ষম হয়।


৬. আন্তঃশহর যোগাযোগ : মধ্যযুগের শহরগুলো আন্তঃশহর যোগাযোগের ক্ষেত্রে দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। শহরের নাগরিক প্রতিষ্ঠানগুলো রাষ্ট্রীয় কার্য পরিচালনা করত এবং বিদেশি শহরের সাথে চুক্তি করতো। ১১৬৭ সালে উত্তর ইতালি পোপের সাহায্যে জার্মান আগ্রাসন হতে মুক্ত হয় এবং লোম্বার্ড লীগ গঠন করে। ১২৪১ সালে পারস্পরিক যোগাযোগ ও সমর্থনের জন্য হামবুর্গ ও হেনসিয়াটিক লীগ গঠন করে- যা শহর গুলোর মধ্যে আন্তঃসম্পর্ক তৈরিতে সাহায্য করে।


৭. বাণিজ্যবাদ : অর্থনৈতিক দিক দিয়ে মধ্যযুগের শহর একটি পরিবর্তনের সূচনা করে। এটা মধ্যযুগীয় অর্থনীতির সাথে আধুনিক অর্থব্যবস্থার মধ্যে সেতু নির্মাণ করে। মধ্যযুগে শহরগুলো নিজ নিজ আরোপিত শুষ্ক বিধি-নিষেধের মধ্যে একটি স্বাধীন অর্থনৈতিক ইউনিট গড়ে তোলে। এখান থেকেই জন্ম নেয় বাণিজ্যবাদ ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও ক্রয় বিক্রয় পদ্ধতি।


৮. শিল্প ও ব্যবসা- বাণিজ্যের কেন্দ্র : মধ্যযুগের শহর ছিল শিল্প ও ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্রস্থল। শহরে অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের অভিজ্ঞতা বিভিন্ন জাতির অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। তাদের অর্থ ও ওজন এবং পরিমাপ ব্যবস্থা অনেক জাতির কাছে উদাহরণে পরিণত হয়। এ সব দ্রব্য বিনিয়োগের পরিবর্তে নগদ অর্থের ব্যবহার শুরু হয়।


৯. ব্যাংকিং ব্যবস্থার সূচনা : মধ্যযুগের শহর সমূহে বাণিজ্যের উন্নতির ফলে বড় বড় মহাজন ও ব্যবসায়ী ক্রমে ব্যাংক ব্যবস্থা গড়ে তোলে এবং তা এ সময়ে চালু হয়। মিডিসিদের ছিল আন্তর্জাতিক ব্যাংকিং। ইউরোপের অন্যান্য স্থানেও এ ব্যাংকের শাখা চালু ছিল। ফ্রান্সের শহরেও ব্যাংকগুলো পোপের রাজস্ব লেনদেন করত।


১০. সংস্কৃতির উন্নতি : সংস্কৃতির উন্নয়নে শহরগুলো বিরাট অবদান রাখে। সংস্কৃতির ক্ষেত্রে শহরগুলো দূতের ন্যায় কাজ করে। ব্যবসা-বাণিজ্যের বিনিময়ের সঙ্গে বিভিন্ন দেশের সংস্কৃতি শহর হতে শহরে স্থানান্তরিত হয়। এ সময় গ্রিক ও রোমের সংস্কৃতির পর্যালোচনা ও চর্চা শুরু হয়।


১১. বিজ্ঞান ও চিত্রকলা : শহর বিকাশের ফলে বুর্জোয়া শ্রেণির সৃষ্টি হয়। তারা বিজ্ঞান, চিত্র, কলা, সাহিত্য শিক্ষার ক্ষেত্রে পৃষ্ঠ পোষকতা দান করে। ধর্মীয় প্রভাব থেকে মুক্ত জ্যোতির্বিদ্যা, গণিত, বিজ্ঞান, জ্যামিতি, চিকিৎসা বিজ্ঞানে তাদের অগ্রগতি ছিল প্রবল। তারা এসবের বিকাশের জন্য বহু স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও ধর্মীয় উপাসনালয় স্থাপন করে। বুর্জোয়া শ্রেণির পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে বিজ্ঞানীরাও নিজ নিজ ক্ষেত্রে উন্নতি সাধন করে। ফলে এসবের মাধ্যমে সংস্কৃতির বিকাশ ও উন্নতি সাধিত হয়।


উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, মধ্যযুগে ইউরোপে শহরগুলোর প্রভাব ছিল অপরিসীম। ব্যবসার প্রসার, শহরের উত্থানের ফলে কিছু লোকের হাতে অর্থ জমা হয়। তারা সমাজে মধ্যবিত্ত শ্রেণিতে পরিণত হয়। এক পর্যায়ে সমাজ ও রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন দেখা দিল শহরকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে সরকার ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা। ফলে ক্রমেই মানুষ ও সমাজের চিত্র পাল্টে যেতে থাকে।


#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Now
Ok, Go it!