ম্যানের প্রথায় কৃষি ও কৃষকের অবস্থা আলোচনা কর।

admin


ভূমিকা : ম্যানর সমাজে কৃষি এবং কৃষকই ছিল মূল গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মূলত কৃষি ও কৃষককে কেন্দ্র করে ম্যানর প্রথা গড়ে ওঠে। কারণ ম্যানর প্রথা ছিল গ্রাম কেন্দিক কৃষিভিত্তিক অর্থনৈতিক সংগঠন। মধ্যযুগে সামন্ততান্ত্রিক সমাজে ম্যানর ছিলো একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। অর্থাৎ ম্যানর প্রথা এমন একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ও সামাজিক অবস্থা। যার মূল কেন্দ্র বিন্দুই ছিল ভূমি ও কৃষক। কাজেই ম্যানর প্রথাতে কৃষি ও কৃষক ছিল অন্যতম অ্যালোচ্য বিষয়।


ম্যানের প্রথায় কৃষি ও কৃষকের অবস্থা আলোচনা কর।

ম্যানর প্রথায় কৃষি ও কৃষকের অবস্থা : ম্যানর প্রথায় কৃষি ও কৃষক ছিল অন্যতম প্রধান গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। নিম্নে ম্যানর প্রথায় কৃষি ও কৃষকের সঠিক অবস্থা আলোচনা করা হলো :


১. অবহেলিত কৃষক সমাজ : ম্যানর প্রথার মূল কেন্দ্রবিন্দু ছিল কৃষি ও কৃষক। কিন্তু কৃষক ও তাদের চাষাবাদ পদ্ধতি দুটোই ছিল অবহেলিত। প্রথম দিকে ম্যানর প্রথায় কৃষি পদ্ধতি ছিল সম্পূর্ণ আদিম ধরনের এবং চাষাবাদ সম্পর্কে তাদের জ্ঞান ছিল সীমিত। উন্নত জ্ঞান ও কৃষি প্রযুক্তির অভাবে কৃষকরা অত্যন্ত অমসৃণ উপকরণ ব্যবহার করতে বাধ্য হতো।


২. কৃষক ও কৃষিযন্ত্র পাতি : ম্যানর প্রথায় জমি চাষ করতে কৃষকরা যে যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে তা অত্যন্ত অমসৃণ আদিম যুগের যন্ত্রের অভাবে তারা ভলোভাবে জমি চাষ করতে পারত না। ফলে ফসল ভালো হতোনা। কৃষকদের প্রধান চাষযোগ্য যন্ত্র ছিল লাঙ্গল। লাঙ্গল ছিলো ভারি ঢাকাযুক্ত কাঠের তৈরি যা টানতে প্রায় ৮ টি পশুর প্রয়োজন হতো। মাটি গুড়ো করতে অমসৃণ মই ব্যবহার করা হতো। মাটির উর্বরতা সম্পর্কেও তাদের কোনো জ্ঞান ছিল না। কৃত্রিম সার ও বৈজ্ঞানিক কোনো প্রযুক্তি না থাকায় জমি কম সময়ে অনুর্বর হয়ে যেত।


৩. হাল চাষে পশু ব্যবহার : সতের শতকের পূর্বেও তারা জানত না কিভাবে পশু খাদ্য চাষ করতে হয়। ফলে পশু খাদ্যের অভাবে গৃহপালিত শাবকের অবস্থা হতো দুর্বল। কৃষি কাজে কৃষকরা হাল চাষ করতে ঘোড়ার পরিবর্তে গরুই বেশি ব্যবহার করত। কেননা এগুলো লালন-পালন অপেক্ষাকৃত সহজ। অনেক সময় পশুর বিকল্প হিসেবে নারী ও পুরুষ উভয়ে ম্যানর সমাজে মাঠে লাঙ্গল টানত। এভাবে হাল চাষ সম্পূর্ণ করে জমি চাষযোগ্য করা হতো।


৪. আবাদযোগ্য জমির উর্বরতা আনয়ন : ম্যানর প্রথায় যেহেতু চাষই ছিল অর্থনীতির মূল একক তাই জমির উর্বরতা ফিরিয়ে আনতে গ্রীকরা ত্রিধা ব্যবস্থা, রোমান ও জার্মানরা দ্বিধা ব্যবস্থা প্রবর্তন করে। তারা আবাদযোগ্য জমিকে দুইভাগে অথবা তিনভাগে ভাগ করে রদবদল করে ফসল ফলাতো এবং এভাবে ক্রমান্বয়ে একটি অংশকে সবসময় পতিত রেখে দিত। অর্থাৎ এক বছরের বসন্ত কালীন আবাদ ভূমি পরের বছর শরৎকালে চাষ করা হতো। এভাবে জমি চাষ করলে জমির উর্বরতা ফিরে আসাসহ ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি পেত।


৫. পারিশ্রমিক জীবন : সামন্ত প্রভুর নানাবিধ ব্যয় নির্বাহ করতে হতো কৃষকদেরকে। কোনো কারণে কৃষক অর্থ প্রদানে ব্যর্থ হলে এসব কৃষকের জমি বাজেয়াপ্ত হতো। তাছাড়া যুদ্ধ বিগ্রহ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, খরা ইত্যাদি বন্য পশুর আক্ৰমণ, দুর্ভিক্ষ ইত্যাদি সবকিছুই কৃষকদেরকে বিশেষভাবে জড়িত করত। সর্বপরি বেঁচে থাকার তাগিদে কৃষকদেরকে প্রচুর হাড় ভাঙ্গা পরিশ্রম করতে হতো। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত তাদেরকে পরিশ্রম করেই বেচে থাকতে হতো।


৬. লর্ড ভক্তি : ম্যানর ছিল সব দিক দিয়ে স্বয়ংসম্পূর্ণ। তাই খাদ্য দ্রব্য বিশেষ করে গম, বার্লি, পিচফল, আপেল ইত্যাদি। পোষাক পরিচ্ছদ, আসবাবপত্রসহ জীবিকার সব দ্রব্যই ম্যানরে উৎপাদিত হতো যা কৃষকগণ বিনা মূল্যে লর্ড বা স্বামীকে ভক্তি ও আনুগত্য প্রকাশে দিতে বাধ্য হতো। কারণ ম্যানরে উৎপাদিত সামগ্রিতে লর্ডদের একচ্ছত্র অধিকার ছিল। তাই ম্যানরে প্রতিটি কৃষক স্বয়ং সম্পূর্ণ হলেও কৃষকদের অবস্থা তেমন ভালো ছিল না। ফলে লর্ড ও সামন্ত প্রভুর নির্যাতনে তারা ছিল বিপর্যস্ত


৭. বংশপরম্পরায় জমি চাষ : ম্যানর প্রথার সর্বনিম্ন পর্যায়ে ছিল ভূমিদাস। এই ভূমিদাসরাই ছিল মূলত কৃষক। কৃষকরা বংশ পরম্পরায় জমি চাষ করতে বাধ্য ছিল। অর্থাৎ ভূমি দাসের সন্তানও ভূমি দাস ছিল। তারা কোনো লর্ড বা মুক্ত মানুষের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগ দায়ের করতে পারত না। তাছাড়াও জমি চাষে লর্ড যদি কৃষকের উপর অসন্তুষ্ট হতো তবে তাকে জমি থেকে উৎখাত করে দিতো। ভূমিদাস কৃষকের জীবন ছিল দুর্বিহ। কোনো কৃষকের সাথে মুক্ত শ্রেণি রমনীর বিবাহ হলেও তার সন্তান বংশানুক্রমিক ভূমিদাস কৃষকে পরিণত হতো।


৮. ম্যানর প্রথায় কৃষকের নির্যাতন : ম্যানর প্রথায় সর্বোচ্চ অবহেলিত, নির্যাতিত, অত্যাচারের শিকার হতো কৃষক শ্রেণি যথাসময়ে কর ও বিনা পারিশ্রমিকে জমি চাষ করে দিয়েও তারা নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা পেত না। সামান্য ত্রুটিতে তাদের উপর নেমে আসত পৈশাচিক নির্যাতন। এছাড়া শিকার করত লর্ড অথচ শিকারি ধাওয়া দিয়ে আনতে হতো কৃষকের। এতে কৃষকের উঠতি ফসল নষ্ট হলেও তা মুখ বন্ধ করে সহ্য করতে হতো। কিছু বলার অধিকার ছিল না। এভাবে নির্যাতন সহ্য করে তাদের দিনযাপন করতে হতো।


৯. ম্যানর প্রথায় কৃষকের আনন্দ উৎসব : ম্যানর প্রথায় মাত্রাহীন ও নির্মম নির্যাতন অবহেলা সহ্য করেও তারা মাঝে মাঝে আনন্দ উৎসবে মেতে উঠত। তাছাড়া একগুয়েমি জীবন থেকে মুক্তি লাভের জন্য তারা মোরগ-মুরগীর লড়াই, ষাড়ের লড়াই, কুস্তিগিরি ও বিভিন্ন খেলার আয়োজন করত। গ্রামে একজন কুস্তিগিরির সম্মান ছিল। এসব আয়োজনে তারা নাচ, গান, সুরা পান করে আনন্দ উৎসব করত। মাঝে মাঝে তারা তাদের সামন্ত প্রভুকে সন্তুষ্ট করতে তাদেরকে নিমন্ত্রণ জানাতো।


১০. গ্রাম্য চার্চ, যাজক ও ধর্মপালন : ম্যানর প্রথায় গ্রাম্য কৃষক ছিলো অত্যন্ত সহজ সরল। গ্রাম বা ম্যানরকে কেন্দ্র করে এক একটি চার্চ ছিল। চার্চের দায়িত্বে থাকতেন যাজকগণ। চার্চ সংলগ্ন স্থানেই ছিল যাজকদের বাসস্থান ও আবাসস্থল। যাজকদের সম্মানে ও ধর্মীয় বিশ্বাসে কৃষকরা বিনা পারিশ্রমিকে তাদের জমিচাষ কেরে দিতো। কারণ কৃষকরা একাজকে পূণ্য মনে করত। এর ফলে জমিও সম্পদের মালিক হতো যাজক নিজে।


উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, উপরিউক্ত আলোচনা থেকে ম্যানর প্রথায় কৃষি এবং কৃষকের যে জীবন চিত্রের সন্ধান পাওয়া যায় তা ইতিবাচক থেকে নেতিবাচকই বেশি ছিল। নির্মম নির্যাতন, অবহেলা, অত্যাচার সহ্যকরে জীবনে বেঁচে থাকার তাগিদে তারা নিজের জীবনকে বয়ে চলত। সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক হলো তাদের অবস্থান ছিল বংশানুক্রমিক। যে অবস্থা থেকে তারা কোনো দিন নিজেকে মুক্ত ও উন্নতি করতে পারত না। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত।


#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Now
Ok, Go it!