ভূমিকা : মধ্যযুগে ইউরোপের ইতিহাসে দুটি যুগান্তকারী ঘটনা হলো সামন্তবাদ বা সামন্ততন্ত্র অন্যটি হলো ম্যানর প্রথা। সামন্তবাদ ও ম্যানর প্রথা আক্ষরিক অর্থে প্রায় একই ছিল। কিন্তু সে নিয়ে আধুনিক ঐতিহাসিকদের মধ্যে মত বিরোধ রয়েছে। কারো মতে, সামন্ত প্রথা এবং ম্যানর প্রথা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন দুটি ঘটনা। অপর দিকে কোনো কোনো সমাজতন্ত্রবিধ ঐতিহাসিক মনে করেন সামন্ত প্রথা ও ম্যানর প্রথা একই ঘটনার দুটি রূপমান।
সামন্তবাদের সাথে ম্যানরের সম্পর্ক : মধ্যযুগে ইউরোপের ইতিহাসে বিস্তারকারী সামস্ত প্রথা ও ম্যানর প্রথার বৈশিষ্ট্যগত সম্পর্ক আলোচনা করা হলো :
১. স্বতন্ত্র ব্যবস্থা : সাধারণভাবে সামন্তবাদ ও ম্যানর প্রথা পরস্পর নির্ভরশীল নয়। বস্তুত এই দুইটি প্রথা পৃথক বা স্বতন্ত্রভাবে গড়ে উঠেছিল। তবে সমাজ পরিচালনার এই দুটি প্রথার সাথে পারস্পরিক সম্পর্ক ছিল অটুট। কারণ সামন্ত প্রথা যে কৃষিকে ভিত্তি করে বিস্তার লাভ করে সেই কৃষির কেন্দ্রবিন্দু ছিল ম্যানর প্রথা। ফলে পৃথক বা স্বতন্ত্রভাবে এই দুই প্রথা গড়ে উঠলেও তারা পরস্পর সম্পর্কযুক্ত ছিল।
২. সময় বা ব্যাপ্তিকাল : ম্যানরীয় ব্যবস্থা খ্রিস্টীয় নবম শতক শেষ হবার পূর্বেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু সামন্তবাদ একাদশ শতক শেষ হবার পর চুড়ান্ত রূপ লাভ করে। ইংল্যান্ডে ম্যানর প্রথার বিকাশ কাল ছিল ৮০০-১২০০ খ্রিস্টাব্দ এবং ব্যবস্থাটি সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছিল ১২০০-১৩০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে। ১৩০০-১৫০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে এ প্রথা ক্রমান্বয়ে বিলুপ্তির দিকে এগিয়ে যায়। ১৫০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে ম্যানর প্রথা অপ্রয়োজনীয়ভাবে টিকে থাকে। অপরদিকে এগার শতকে ম্যানর প্রথার সাথে সমান তালে তাল মিলিয়ে সামন্তবাদ বিস্তার লাভ করে।
৩. সামাজিক আশ্রয় ও নিরাপত্তার কেন্দ্রস্থল : জার্মানরা উপর্যুপরি রোমান সাম্রাজ্য আক্রমণ করলে দুর্বল রোমান রাজারা সাধারণ জনগণ ও কৃষকদের জান ও সম্পদ এমনকি তাদের ফসলের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হলে মানুষ একজন শক্তিশালী শাসকের আশ্রয় প্রার্থী হয়। সেদিক দিয়ে স্থানীয় ম্যানর ও সামন্ত প্রভুরা ছিলো উত্তম আশ্রয় ও নিরাপত্তা দাতা। ফলে সাধারণ জনগণ তাদের জমি লর্ডদের নিকট সমর্পণের মাধ্যমে আশ্রয় ও নিরাপত্তা লাভ করে।
৪. বংশ পরম্পরায়ু জমি চাষ : সামন্তবাদ ও ম্যানর প্রথা উভয় ব্যবস্থাতেই কৃষক ছিল অবহেলিত। এরা ছিল বংশানুক্রমিক নিচু জাত। ফলে এ সমাজে ভূমিদাসের উদ্ভব হয়। এই ভূমিদাস ম্যানর ও সামন্ত উভয় সমাজে ভূমিদাস বিদ্যমান ছিল যারা বংশানুক্রমে জমি চাষ করত। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তারা এ অবস্থার উন্নতি কোনো সমাজেই করতে পারত না। এমনকি উভয় প্রথাতেই ভূমিদাসের সন্তান ভূমিদাস হতো।
৫. কৃষক শোষণের হাতিয়ার সামন্তবাদ : ম্যানর প্রথা উভয়ই ছিল কৃষক শোষণের প্রধান হাতিয়ার। সামন্ত ও ম্যানর উভয় প্রধাতে কৃষকের কোনো ব্যক্তিগত জমি ছিল না। এই দুই প্রথা দ্বারা নানা অজুহাতে কৃষক থেকে কর ও খাজনা আদায় করা হতো। খাজনা এবং করের মাত্রা এতো বেশি ছিল যে কৃষক তার উৎপন্ন ফসলের ৮০% ভাগ কর প্রদানে শেষ করত। অনেক সময় ভালো ফসল না ফললে কৃষকের পক্ষে তা পরিশোধ করা কঠিন ছিল। কিন্তু সামন্ততন্ত্র কিংবা ম্যানর প্রথার এদিক দিয়ে কোনো কথায় কৃষক ছাড় দেয়নি। বরং সন্তান-সন্ততি, স্ত্রী ও গবাদি পশু নিয়ে কর পরিশোধ করত।
৬. বিনা পারিশ্রমিকে শ্রম অর্জন : সামন্ততন্ত্র এবং ম্যানর প্রথা উভয় ব্যবস্থাতে বিনা পারিশ্রমিকে শ্রম আদায় করা হতো। সামন্ততন্ত্রে সামন্ত প্রভুরা সপ্তাহে ২/৩ দিন বিনা পারিশ্রমিকে কৃষকদেরকে দিয়ে নিজস্ব জমি চাষ করিয়ে নিত। এছাড়া রাস্তা নির্মাণ বন উজার, পুল তৈরি, খাল বা পুকুর খনন করানো হতো পারিশ্রমিক ছাড়া। কেউ কাজ করতে অপারগতা দেখালে তাকে নির্যাতনের শিকার হতে হতো। মুখ বুজে সহ্য করা ছাড়া অন্য কোনো উপায় ছিল না। অনুরূপভাবে ম্যানর প্রধাতেও উক্ত কাজগুলো করানো হতো বিনা পারিশ্রমিকে। তাছাড়াও বিনা অনুমতিতে ম্যানর ও সামন্ত এলাকা থেকে কেউ বাইরে যেতে পারত না। সুতরাং দেখা যায় যে, সামন্ততন্ত্র ও ম্যানর প্রথা অধিকাংশ দিক দিয়েই সম্পর্ক যুক্ত ছিল। অর্থাৎ একই বিষয়ের দুটি ভিন্ন রূপ মান।
ম্যানর প্রশাসনিক ব্যবস্থা : ম্যানর ছিল গ্রাম কেন্দ্রিক একটি অর্থনৈতিক সংগঠন। তাই এর প্রশাসনিক কাঠামোও ছিল গ্রাম নির্ভর নিয়ে ম্যানর প্রধার প্রশাসন ব্যবস্থা উল্লেখ করা হলো।
১. লর্ড : ম্যানর প্রথায় লর্ড ছিলেন প্রধান প্রশাসক। তার বসবাসও ছিল ম্যানরের মধ্যে। তবে তিনি নিজে সরাসরি প্রশাসন পরিচালনা করতেন না। ম্যানর প্রশাসন পরিচালনার জন্য স্টুয়ার্ড, বাইলিফ, রিভি উপাধিকারী কয়েকজন কর্মকর্তা নিয়োগ করা হতো। এদের মধ্যে সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী বা ক্ষমতাবান ছিলেন স্টুয়ার্ড। যিনি লর্ডের পক্ষ থেকে ম্যানরের সকল সম্পতি দেখাশোনা করতেন বাণিজ্য তত্ত্বাবধায়ন করতেন, লর্ডের আইন আদালতের উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করতেন। আদালতের বিচারকার্য পরিচালনা করতেন ম্যানরে। সকলের উপর অবস্থান করত লর্ড নিজে। যিনি অভিজাত হিসেবেই বিবেচিত ছিলেন।
২. স্টুয়ার্ড : ম্যানর প্রশাসনে দ্বিতীয় প্রশাসন ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন স্টুয়ার্ড। ম্যানর লর্ড কর্তৃত্ব তিনি বিশেষ ক্ষমতাধারী ছিলেন। তিনি কোনো অন্যায় করলে সাধারণ কৃষক ও ভূমিদাস তার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ আদালতে দায়ের করতে পারতো না। স্টুয়ার্ড মূলত ম্যানরের সব সম্পতি দেখাশোনাসহ বাণিজ্যের তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন। তিনি ছিলেন আইন উপদেষ্টা, বিচার ব্যবস্থার কাজ। স্টুয়ার্ডের মাধ্যমে লর্ড আধামুক্ত মানুষের উপর আইন প্রতিষ্ঠা করেন।
৩. স্টুয়ার্ড আইন ও আদালত : ম্যানরে স্টুয়ার্ডের একটি সুসংগঠিত ও সুপ্রতিষ্ঠিত আইন ও আদালত ব্যবস্থা বিদ্যমান ছিল। স্টুয়ার্ড নিজে বিচারকার্য পরিচালনা করতেন। স্টুয়ার্ডের আদালতে বিচার অনুযায়ী ছোট খাট অপরাধের জন্য লর্ডকে জরিমানা প্রদান করতেও হতো। কিন্তু অন্যের সম্পত্তি দখল, অনধিকার প্রবেশ, অগ্নিসংযোগ, হত্যাকাণ্ড ও দস্যুতার জন্য স্টুয়ার্ড কর্তৃক শাস্তি ছিল মৃত্যুদণ্ড। স্টুয়ার্ড তত্ত্বাবধায়কের দায়িত্ব পালনের জন্য ম্যানরের সার্বিক পরিস্থিতি বোঝার জন্য ম্যানরে ম্যানরে ঘুরে বেড়াত। কোনো স্টুয়ার্ডের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করা।
৪. বাইলিফ : ম্যানর প্রথায় প্রধান ক্ষমতাবান লর্ড ও প্রধান তত্ত্বাবধায়ক স্টুয়ার্ড ছাড়াও বাইলিফ ছিলেন লর্ডের প্রতিনিধি হিসেবে। তিনি লর্ড কর্তৃক নিযুক্ত কর্মকর্তা ছিলেন। ডিমেইনের চাষাবাদ তত্ত্বাবধায়ন করা, খাজনা ও কর আদায়, জরিমানা, ভাড়া প্রভৃতি আদায় করা এবং ম্যানরের আয় ব্যয়ের হিসাব রাখা এমনকি কৃষকের কাজ পরিদর্শন করাও ছিল তার দায়িত্ব। ফসল কাটার জন্য বাইলিফ কৃষকদেরকে প্রথমে লর্ডের জমিতে ফসল কাটার জন্য নিযুক্ত করত। এতে কৃষকের ফসল নষ্ট হলেও প্রথমে লর্ডের ফসল কাটা আবশ্যক ছিল। তিনি একাজে কৃষকদের বাধ্য করতেন।
৫. রিভি : রিভি পদটি ছিল গ্রামবাসীর মুখপাত্র স্বরূপে। এ পদটি ছিল অনেকটা মধ্যস্থতাকারী পদ। তিনি হতেন কৃষকের পছন্দের ব্যক্তি। কৃষকের সুযোগ সুবিধার প্রতি তিনি লক্ষ্য রাখতেন এবং বিভিন্ন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কৃষকের অভিযোগ আদালত ও সামন্ত প্রভুর কাছে পৌঁছে দিতেন। চাষযোগ্য জমিবণ্টন ও উৎপাদন দোরকিত বাইলিফ সাহায্য করতেন। সময় মত বর্গচাষীকে বীজ, লাঙ্গল ইত্যাদি কৃষি উপকরণের যোগান দেওয়া নিশ্চিত করার ব্যাপারে তিনি লর্ডের নিকট দায়ী থাকতেন ।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, মধ্যযুগে সমগ্র ইউরোপ জুড়ে যে সামন্ততন্ত্র ও ম্যানর প্রথা গড়ে উঠেছিল তা ছিল প্রায় একই ধাঁচের। কারণ সামন্তবাদ ও ম্যানর প্রথার প্রশাসনিক কার্যক্রম ও ব্যবস্থা প্রায় একই ছিল। তাছাড়া এই দুই প্রথার মধ্যে স্থান ও সময়ের বেশ কোনো পার্থক্য ছিল না। ম্যানরে লর্ড তার কাজ এবং খাজনা কর যথাসময়ে আদায়ের জন্য বিভিন্ন ব্যক্তিকে নিয়োজিত রেখে তার প্রশাসনিক কার্য সম্পাদন করতেন।