ম্যানর প্রথার প্রধান প্রধান বৈশিষ্ট্য ব্যাখ্যা কর।

admin


ভূমিকা : মধ্যযুগে ম্যানর প্রথা ছিল ইতিহাসের এক যুগান্তকারী অধ্যায়। ম্যানর প্রথা ছিল মূলত: ভূমি ও কৃষিভিত্তিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। অন্যভাবে একে সংজ্ঞায়িত করলে বলা যায় ম্যানর প্রথা হচ্ছে সামন্তবাদ বা সামন্তযুগের কৃষিভিত্তিক সমাজের একটি অর্থনৈতিক সংগঠন। অর্থাৎ মধ্যযুগে সামন্ততান্ত্রিক কৃষি ভিত্তিক সমাজে ম্যানর ছিল একটি যুগান্তকারী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা যার মাধ্যমে কৃষিকাজ ও উৎপাদন ব্যবস্থা অব্যাহত ছিল। কাজেই ম্যানর প্রথা নানা দিক দিয়ে বৈশিষ্ট্য মন্ডিত ছিল।


ম্যানর প্রথার প্রধান প্রধান বৈশিষ্ট্য ব্যাখ্যা কর।

ম্যানর প্রথার বৈশিষ্ট্য : ম্যানর প্রথার বৈশিষ্ট্য মূলত সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কিছু কিছু ক্ষেত্রে ধর্মীয় বৈশিষ্টগুলো খুজে পাওয়া যায়। নিম্নে ম্যানর প্রথার বৈশিষ্ট্য আলোচনা করা হলো :


১. ম্যানর প্রথা গ্রাম কেন্দ্রিক : ম্যানরের "কেন্দ্র ছিল গ্রাম। ম্যানরের মধ্যে ইতস্তত বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকত খামার বাড়ি। কৃষকেরা এ সমস্ত খামার বাড়িগুলোতে করতেন না, তারা সাধারণত রাস্তার কাছাকাছি দলবদ্ধভাবে কোনো কুঠিরে বাস করতেন। প্রত্যেকটি কুঠিরের পাশে ছিল সবজি বাগানের জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ স্থান ও হাস মুরগীর জন্য উঠান, খড়ের গাদা ও আস্তাবল যা একমাত্র গ্রামের সাথে মিলে যায়।


২. স্বয়ং সম্পূর্ণ অর্থনীতি : ম্যানর প্রথা ছিলো সম্পূর্ণভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান। মানুষের জীবন ধারনের প্রায় সবকিছুই এর মধ্যে উৎপাদিত হতো। তবে কৃষক তার উৎপাদিত ফসলের কোনো অংশই অন্য ম্যানরে নিতে পারত অর্থাৎ বিক্রি বা হস্তান্তরের বিষয় ছিল অনুপস্থিত। ম্যানরের মধ্যে উৎপাদিত দ্রব্য সামগ্রি ম্যানররাই ভোগ করত। এমনকি সামন্ত প্রভুর বা লর্ডের নির্দেশ ছাড়া কেউ ম্যানরের বাইরে বা কেউ ম্যানরে প্রবেশ করতে পারত না। ম্যানরের মধ্যেই ছিল আটাকল, তাঁত বুনন, রুটি কারখানা ইত্যাদি । তাছাড়া কামার, কুমার, মুচি প্রভৃতি ম্যানরে গড়ে উঠেছিল।


৩. অভিজাত শ্রেণি : ম্যানর প্রথার আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো শ্রেণি বিভক্ত সমাজ ব্যবস্থা। সমাজে সর্বোচ্চ মর্যাদার অধিকারী ছিলেন লর্ড, সামন্ত প্রভু ও তার সমগোত্রীয়রা। এরাই ছিল ম্যানর সমাজের শাসক ও অভিজাত শ্রেণি। তবে সমগ্র ম্যানরজুড়ে এদের সংখ্যা ছিল হাতে গোনা কিন্তু তারাই ছিল সর্বোচ্চ সুবিধাভোগী। সাধারণ কৃষক ও ভূমিদাসরা লর্ডদের নির্দেশ মানতে বাধ্য ছিল। কেউ আনুগত্য প্রকাশ না করলে তাকে নির্মম নির্যাতনের শিকার হতে হতো। রাজার অনুমতি ব্যতীত কেউ তাদের এই উপাধি গ্রহণ করতে পারত না ।


৪. মুক্ত শ্রেণিঃ ম্যানরের দ্বিতীয় শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত যারা ছিল এরা হলো মুক্ত মানুষ। কৃষক ও কারিগরের একটি অংশ ছিল মুক্ত মানুষ বা শ্রেণি। এরা নিজেরা সরাসরি লর্ডের জন্য শ্রম না দিয়ে লর্ডদের জন্য শ্রম দিতে নিজস্ব অর্থে ক্রীতদাস বা শ্রমিক নিয়োগ করত। লর্ডদের নির্দেশে মুক্ত মানুষের অনেকেই আদালত পরিচালনাসহ অন্যান্য দায়িত্ব পালন করতেন। সমাজে এদর অবস্থা বেশ মর্যাদারই ছিলো।


৫. ভূমিদাস : ম্যানর সমাজে তৃতীয় শ্রেণিভুক্ত ছিলেন ভূমিদাস। ভূমিদাসত্ব ছিল বংশানুক্রমিক। অর্থাৎ ভূমিদাসের সন্তানও ভূমিদাস। ভূমিদাসদের জীবন ছিল দুর্বিসহ। সমাজের সবচেয়ে নিঃগৃহীত অবহেলিত ও নির্যাতিত ছিল ভূমিদাস। এরা আদালতে লর্ড বা মুক্ত মানুষের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ করতে পারত না। লর্ডের অনুমতি ব্যতীত এরা বাইরে যেতে পারত না । এমনকি কোনো ভূমিদাস মুক্ত শ্রেণির রমণী হলেও তার সন্তানও ভূমিদাস হতে বাধ্য হতো।


৬. লর্ড বা সামন্ত প্রভুদের নির্যাতন : সামন্ত যুগে ম্যানর সমাজে লর্ডরা ছিল সর্বোচ্চ মর্যাদার অধিকারী। ফলে কোনো ভূমিদাস তার অবাধ্য হলে, কর প্রদানে ব্যর্থ হলে, আনুগত্য প্রদর্শন না করলে তাকে চরম নির্যাতনের শিকার হতে হতো। তাছাড়াও ভূমিদাসদের প্রতি লর্ডরা অসন্তুষ্ট হলে তাদেরকে ভূমি থেকে উৎখাত করা হতো। আবার ক্ষেত্র বিশেষ অন্যায় আচরণ করলে ভূমিদাসদেরকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হতো। তুলনামূলক কম অপরাধীদেরকে বিভিন্ন প্রকার গুদামে আটক রাখা হতো। এভাবে ম্যানর সমাজে কৃষক ও ভূমিদাসদের উপর নির্মম নির্যাতন করা হতো।


৭. ভূমি ব্যবস্থা : গ্রামের বিস্তৃত অংশ ছিল ভূমি। এ ভূমির মধ্যে অনাবাদি জমির চেয়ে আবাদি জমির গুরুত্ব ছিল সবচেয়ে বেশি। ম্যানের সামস্ত ভূমিকে ৬ ভাগে ভাগে করা হয়।

১. লর্ডের সরাসরি কর্তৃত্বাধীন খাস জমি।

২. লর্ডের খাস জমির নিকটস্থ জমি বা খাস জমির অংশ বিশেষ।

৩. রায়তী ভূমি

৪. ভূর্ণ ভূমি

৫. বনাঞ্চল

৬. যাজকের সম্পতি যা যাজকগণ ভোগ করতেন। লর্ড একটি ম্যানরের উৎকৃষ্ট জমির ১/৩ থেকে ২/৫ অংশ পর্যন্ত নিজস্ব অধিকারে রাখতেন।


৮. লর্ডের প্রতি অনুগত জীবন : ম্যানর প্রথা এমন একটি ব্যবস্থা যেখানে ম্যানরের সকল জনগোষ্ঠীকেই একমাত্র লর্ডের অধীনে সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিকভাবে অনুগত থাকতে হতে হতো। আর এ জন্যই অনেকে বলেন যে, প্রভু অর্থাৎ লর্ডের অর্থনৈতিক প্রয়োজনেই ম্যানর প্রথা গড়ে উঠেছিল। যেখানে সমস্ত কৃষক ও ভূমিদাস, এককথায় নিম্নস্ত সকলে লর্ডের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করত।


৯. ম্যানরের ভিত্তিক লর্ডের বাসস্থান : ম্যানরের আয়তন বড় হলে লর্ডের বাসস্থান হতো দুর্গবিশেষ, গ্রামের সাথে এর দেয়াল থাকতো। আর ম্যানর যদি ছোট হতো তবে থাকতো ম্যানর হাউজ। ম্যানর হাউজের নির্বাহকৃত লর্ডের খাস জমির কাছে থাকতো মাটির ঢিবি।


১০. গ্রামের চার্চ ও যাজক : ম্যানর সমাজের আর একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো গ্রাম্য চার্চ। এসব চার্চের অধীনে থাকতো যাজকগণ। চার্চ সংলগ্ন স্থানেই থাকত যাজকদের আবাসস্থল ও সমাধিস্থল। যাজকদের আবাদি জমি গ্রামবাসিরা বিনা পারিশ্রমিকে চাষ করে দিতো। কারণ তারা এ কাজকে পূণ্য মনে করতো। এমনকি কৃষক তার উৎপাদিত ফসলের একটা অংশ ধর্মকর হিসেবে চার্চে দান করত। যার মালিক যাজকগণ।


১১. কর ও খাজনা আদায় : ম্যানর ছিল সামন্ত প্রভুর খাজনা আদায়ের মূল ভান্ডার। কারণ চাষি তার জমি চাষের জন্য সামন্ত প্রভুকে চাষযোগ্য কর ও একটি ভূমি কর প্রদানে বাধ্য থাকত। এছাড়া চারণভূমি কর, ধর্মকর, পথ ও হাট কর প্রভৃতি প্রদানে বাধ্য হতো। পিতার মৃত্যুর পর সন্তান পিতার সমুদয় সম্পতির কর পরিশোধেও বাধ্য হতো। এভাবে খাজনা ও কর আদায় করা হতো।


উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, ম্যানর প্রথাতে উপরিউক্ত বৈশিষ্ট্যগুলো বিদ্যমান- যা ম্যানর সমাজের প্রকৃত চিত্র তুলে ধরে। কারণ বৈশিষ্ট্যের মধ্যেই সমাজের পরিচয় পাওয়া যায়। ম্যানর সমাজে আর একটি বৈশিষ্ট্য হলো। প্রত্যেকটি ম্যানরে একটি জলের ধারা বয়ে যেতো- যা গ্রামের পুকুরের সাথে সংযুক্ত ছিল। লর্ডের প্রকৃত ভূ-খন্ড থাকত এর কাছেই। এটি অবশ্যই উৎকৃষ্ট জমি হতে হতো।


#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Now
Ok, Go it!