মঠতন্ত্রের সংজ্ঞা দাও। মঠতন্ত্র বিকাশের কারণ পর্যালোচনা কর।

admin

 

ভূমিকা : মধ্যযুগে ইউরোপের ইতিহাসে মঠতন্ত্র একটি আলোচিত বিষয়। খ্রিস্ট ধর্মের প্রচার ও প্রসারে যেসব প্রতিষ্ঠান বিশেষ ভূমিকা রাখে তার মধ্যে অন্যতম ছিল মঠ বা সংঘ। আর এ মঠকে কেন্দ্র করে মধ্যে যুগে সন্ন্যাসবাদীদের যে বিশেষ জীবনযাপন ও কর্ম পদ্ধতি গড়ে উঠেছিল তাই ইতিহাসে মঠতন্ত্র নামে পরিচিত। মঠতন্ত্র সন্ন্যাসবাদ নামেও অধিক পরিচিত। যাজকতন্ত্রের মতই একটি ভিন্ন সংগঠন হিসেবে মঠতন্ত্র গড়ে উঠেছিল। প্রকৃত প্রস্তাবে মঠ বা সন্ন্যাসবাদ ছিল ধর্মকেন্দ্রিক একটি জীবন দর্শন।


মঠতন্ত্রের সংজ্ঞা দাও। মঠতন্ত্র বিকাশের কারণ পর্যালোচনা কর।


মঠতন্ত্রের সংজ্ঞা : সাধারণ অর্থে মঠ বা সন্ন্যাসবাদ বলতে মঠ বা সন্ন্যাসবাদের সম্পর্কিত এমন একটি জীবন ব্যবস্থাকে বোঝায় যারা নির্জন স্থানে জীবন যাপন করে এবং তারা নিজেরা আরাধনা ও ধ্যান সাধনা-প্রার্থনায় নিমগ্ন রাখে।


ঐতিহাসিকভাবে, মঠতন্ত্র বা সন্ন্যসবাদ বলতে ধর্মীয় কারণে সংসারত্যাগী ব্যক্তিদের এক ধরনের জীবন পদ্ধতিকে বোঝায়, যা মধ্যযুগে খ্রিস্টধর্মের চার্চে গড়ে উঠেছিল। কঠোর সংযমী ও তপস্যের ফলেই মধ্যযুগে খ্রিস্ট ধর্মে মঠ বা সন্ন্যাসবাদ অনুমৃত হয়েছে।

মঠতন্ত্রে সংসারত্যাগীদের ধারণা ছিল সকল প্রকার কুপ্রবৃত্তির মূলেই রয়েছে বস্তুর প্রতি আসক্তি। তাই বস্তুর সাথে সর্বপ্রকার সম্পর্ক পরিহার করতে হবে। এজন্য কর্মরক্ষার্থে গৃহত্যাগী সন্ন্যাসরা বহু দূরে মরুভূমিতে, দুর্গম পাহাড়ে ও বনে জঙ্গলে আরাধনা ও ধ্যান সাধনায় নিমগ্ন হয়। অবশ্য তারা প্রথম দিকে নির্জনে একাকী বসবাস করলেও শিগ্রই তারা একত্রে বসবাসের উপকারিতা অনুভব করে। এ জন্য তারা বহু আশ্রম ও মঠ নির্মাণ করে। কাজেই এই মঠকে কেন্দ্র করে তাদের যে জীবনাচারণ পরিচালিত হয় তাই মঠতন্ত্র বা সন্ন্যাসবাদ নামে পরিচিত।


মঠতন্ত্র বিকাশের কারণ : নিম্নে মধ্যযুগে ইউরোপে মঠতন্ত্র বিকাশের কারণ উল্লেখ করা হলো-


১. ধ্যান-সাধনার মাধ্যমে আধ্যাত্মিকতা অর্জন : খ্রিস্ট ধর্মের মূল আদর্শ ছিলো মানব কল্যাণ সাধন। অপরের কল্যাণের মাধ্যমে ঈশ্বরের সান্নিধ্য অর্জন করা। এজন্য যীশুখ্রিস্ট তার মহান বাণী মানুষের মধ্যে প্রচার করেন। যীশু ক্রুশবিদ্ধ হলে তার পরবর্তীতে খ্রিস্ট ধর্ম রক্ষার জন্য ধর্মপ্রাণ মানুষ ইহলোকের যাবতীয় মায়া, মমতা, ভালোবাসা ত্যাগ করে গৃহত্যাগী বা সংসার ত্যাগী হয়ে সন্ন্যাস জীবন বেছে নেয়। এর অন্যতম কারণ ছিল ধ্যান-সাধনার মাধ্যমে আধ্যাত্মিকতা অর্জন করে। এজন্য মঠতন্ত্র বিকাশ লাভ করে।


২. সমাজের অবক্ষয় দূর করা : রোমান সম্রাট ও তার অধীনস্তদের সীমাহীন বিলাসবহুল জীবন যাপনের ফলে রোমান সাম্রাজ্যের অবক্ষয় নেমে আসে। তাছাড়া বর্বর আক্রমণ রোমান সাম্রাজ্যকে প্রায় ধ্বংস করে দেয়। বিলাসবহুল জীবন যাপনের জন্য প্রয়োজন ছিল প্রচুর অর্থের এর জন্য সম্রাট কৃষকের উপর অতিরিক্ত কর আরোপ করে। প্রতিবাদ করলেই তারা ভূমিদাস কৃষকের উপর নির্যাতন নিপীড়ন চালায়। এরকম এক সামাজিক পরিস্থিতিতে মঠ তন্ত্রের উদ্ভব ও বিকাশ ঘটে। যা সমাজের অবক্ষয় দূর করার জন্য প্রয়োজন ছিল।


৩. সাধারণ জনগণের আশ্রয়দান : রোমান সাম্রাজ্যের উপর উপর্যুপরি বর্বর জার্মান আক্রমণ চলতে থাকলে সাধারণ মানুষ নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। তারা তাদের জীবন ও সম্পদের সুরক্ষার জন্য নিশ্চিত আশ্রয় খোজে। ফলে এ সময় মঠতন্ত্র তার দরদি হাত সাধারণ মানুষের পাশে বাড়িয়ে দেয়। যেকারণে খুব দ্রুত মঠতন্ত্রের বিকাশ ঘটে।


৪. ধর্ম প্রচার : রোমান চার্চের প্রধান পোপের মূল উদ্দেশ্য ছিল ধর্ম প্রচার করা। এজন্য পোপ মহান গ্রেগরি বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। তবে তারও বহু পূর্বে ধর্ম প্রচারের জন্য খ্রিস্টান ধর্মে বিশ্বাসী গৃহত্যাগী সন্ন্যাসীরা নিজেদের একটি নিশ্চিত আশ্রয়ের জন্য মঠ নির্মাণ করে, যার মাধ্যমে তারা নিশ্চিত ধর্ম প্রচার করতে পারে। কাজেই এই মঠকে কেন্দ্র করে জীবনাচরণ পরিচালিত হয়।


৫. সাধারণ জনগণকে খ্রিস্ট ধর্মে দিক্ষা দান : মঠতন্ত্রের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল সাধারণ মানুষকে খ্রিস্ট ধর্মে দিক্ষা দেওয়া, তার জন্য তারা প্রথমে গ্রামে গ্রামে গিয়ে ধর্ম প্রচার করে। এতে যীশুর মহান বাণী ও তার নৈতিক আদর্শে মানুষ আসক্ত হয়ে খ্রিস্ট ধর্মে দিক্ষা গ্রহণ করে। যার কারণে মঠ প্রথা খুব দ্রুত বিকাশ লাভ করে ।


৬. পাপ থেকে মুক্তি : গৃহত্যাগী সন্ন্যাসদের প্রধান বিশ্বাস ছিল জাগতিক সব কিছুর মূলেই হলো পাপ। আর জাগতিক সকল বস্তুই হলো পাপের উৎস। সমাজ ও রাষ্ট্রের চরম নৈতিক অবক্ষয় থেকে তাদের মধ্যে এ ধারণার জন্ম নেয়। মানুষের পাপের বোঝা পূর্ণ হয়েছে। এবং এই পাপই পৃথিবী ধ্বংস করবে। ফলে পাপমুক্তির জন্য তারা সন্ন্যাস জীবন বেছে নিয়ে মঠতন্ত্রের বিকাশ ঘটায়।


৭. সাধারণ মানুষকে আশ্রয়দান : চার ও পাঁচ শতকে বর্বরদের আক্রমণের ফলেও সন্ন্যাসবাদ গতিশীল হয়ে ওঠে। এমনকি বহু জার্মান উপজাতি রোমানদের উপর অতর্কিত আক্রমণ করে। ফলে দাঙ্গা-হাঙ্গামা ও গোলযোগের মুহূর্তে রক্ষা পাবার উদ্দেশ্যে মানুষ মঠে আশ্রয় গ্রহণ করত।


৮. ব্যয়ভার নির্বাহ : যেকোন কাজের জন্যই প্রয়োজন অর্থের সন্যাসরা একাকী জীবন যাপনের সময় তাদের কেউ সাহায্য সহযোগীতা করেনি। এ জন্যই তারা ঐক্যবদ্ধভাবে থাকার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। গড়ে তোলে মঠ। যার ফলে ধর্ম রক্ষাকারী হিসেবে অনেক ধনী ধর্মপ্রাণ মানুষ মঠে অর্থ ও জমি দান করে। এছাড়া কৃষক তার ফসলের একটি অংশও মঠে প্রদান করে । যার ফলে মঠতন্ত্র বিকাশ লাভ করে।


৯. চার্চের উৎপত্তি : খ্রিস্ট ধর্মের প্রচার ও প্রসার বাড়তে থাকলে তা সংঘবদ্ধ করার প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়। এজন্য গৃহত্যাগী সন্ন্যাসীরা মঠ নির্মাণ করে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে বৃহৎ কোনো প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার প্রয়োজনে মঠতন্ত্রের বিকাশ ঘটতে থাকে। ফলে মঠকে কেন্দ্র করেই চার্চের উৎপত্তি হয়।


উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, খ্রিস্ট ধর্ম রক্ষা ও তার প্রচার প্রসারে আশ্রম, মঠ, বা সন্ন্যাসবাদের ভূমিকা ছিল অপরিসীম। কারণ মঠগুলোই ছিল যাজকদের ধর্ম প্রচারের অন্যতম সহায়ক। মঠকে কেন্দ্র করে যাজকরা অনায়াসে মানুষের মাঝে ধর্মবাণী প্রচার করতে পারে। আশ্রয়হীন কে আশ্রয় দিতে পারে। যে কারণে খুব কম সময়ে মধ্যযুগে মঠতন্ত্র বিকাশ লাভ করে।


#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Now
Ok, Go it!