ক্রসেড কি? ক্রসেডের কারণ কি ছিল?

admin

 

ভূমিকা : মধ্যযুগটা ছিল বিভিন্ন ঘটনাতে ঘটনাবহুল। এসব ঘটনাবহুল ঘটনার মধ্যে ক্রুসেড ছিল অন্যতম। আক্ষরিক অর্থে ক্রুসেড হলো ধর্ম যুদ্ধ। মধ্যযুগে ক্রমেই ইসলাম ধর্মের বিকাশ সাধিত হলে আরব ভূমি থেকে ইসলাম। গোটা ইউরোপে ছড়িয়ে পরে। মানুষ দলে দলে ইসলামের শান্তির পতাকা তলে সমাবেত হয়। কিন্তু ইসলাম ও মুসলমানদের এই সাফল্য ভালোভাবে নিতে পারেনি খ্রিস্টধর্মাবলম্বিরা। ফলে সূচনা হয় ক্রসেড বা ধর্মযুদ্ধ ।


ক্রসেড কি? ক্রসেডের কারণ কি ছিল?


ক্রসেড : ক্রসেড অর্থ ধর্মযুদ্ধ। আপাতদৃষ্টিতে বলা হয় পবিত্র ভূমি জেরুজালেমকে রক্ষা ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য মধ্যযুগে ইউরোপ ও মুসলমানদের মধ্যে এগারো শতক হতে (১০৯৬-১২৯২) খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সুদীর্ঘ প্রায় ২০০ বছর ব্যাপী যে ভয়াবহ যুদ্ধ সংঘটিত হয় তাই ইতিহাসে ক্রসেড বা ধর্মযুদ্ধ নামে খ্যাত। মধ্যযুগে এই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে সংঘটিত ইউরোপ ও এশিয়ায় আলোড়ন সৃষ্টি করে। এই যুদ্ধের মাধ্যমে দুই সম্প্রদায়ের পরস্পরের প্রতি ঘৃণা, বিদ্বেষ ও দ্বন্দ্ব কলহের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে।


ক্রসেডের কারণ : মূলত ধর্মীয় কারণে ক্রুসেড প্রথম সংঘটিত হলেও তা ক্রমেই অন্যান্য কারণের বহিঃপ্রকাশ। হয়। নিম্নে ক্রসেডের কারণ উল্লেখ করা হলো :


১. জেরুজালেমের পবিত্র ভূমি রক্ষা : যীশু খ্রিষ্টের পবিত্র জন্মভূমি জেরুজালেমকে খ্রিস্টানদের কাছে তা পবিত্র স্থানরূপে বিবেচিত ছিল। কিন্তু খ্রিস্টান ধর্মের বিকাশ ছিল ইউরোপের রোমে। কিন্তু জেরুজালেম ছিল প্রাচ্যে। এজন্য বহু খ্রিস্টান প্রতি বছর তীর্থ যাত্রী ও তীর্থ কর্ম সমাধা করতে জেরুজালেম আসতো। কিন্তু আমিনুল মুমেনিন এর পর খুলাফায়ে রাশেদিন এর পরবর্তী ফাতেমী বংশ জেরুজালেম অধিকারে নিয়ে বহু গীর্জা ধ্বংস করলে খ্রিস্টানদের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি হয় যার ফলে ক্রসেড সংঘটিত হয়।


২. তীর্থ যাত্রায় বাধা প্রদান : হযরত ওমরের (রা) -এর সময়কাল হতে আব্বাসীয় খলিফাগণ পর্যন্ত খ্রিস্টানদের তীর্থ যাত্রায় কোনো বাধা দেয় নি। কারণ তারা ছিলেন ধর্ম সহিষ্ণু। কিন্তু মিশরের ফাতেমী বংশের মুসলিম শাসকগণ ছিলেন কঠোরপন্থি। তারা জেরুজালেম অধিগ্রহণ করে বহু গীর্জা ধ্বংস করেও খ্রিস্টান তীর্থ যাত্রায় বাধা প্রদান করেন। এতে খ্রিস্টানদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। যার ফলশ্রুতি হলো ক্রসেড।


৩. পোপের আধিপত্য বিস্তার : অনেক পূর্ব থেকেই রোমান গীর্জা ও গ্রিক গির্জার আধিপত্য প্রতিষ্ঠার প্রতিযোগিতা ছিল। গ্রিক খ্রিস্টানরা ছিল নাস্তিক। এছাড়া গ্রিক খ্রিস্টানদের উপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠারও ইচ্ছা ছিল। এ সুযোগ গ্রহণ করে ইসলাম ধর্ম গোটা ইউরোপে ব্যাপক প্রসার লাভ করে। এ অবস্থা লগ্নে খ্রিস্টান পোপের মানসিকতাও ক্রুসেডের জন্য দায়ী ছিল।


৪. মুসলীম ভ্রাতৃত্ব : হযরত মুহাম্মদ (স:) এর আদর্শে মুসলিম ধর্মালম্বীরা অসাধারণ ভ্রাতৃত্ববোধে অনুপ্রাণীত হয়। ফলে হযরত ওমরের (রা) এ সময় থেকেই মুসলিম ও ইসলাম ধর্ম ব্যাপকহারে বিস্তার লাভ করে। এর পরবর্তীকালে খোলাফায়ে রাশেদীন ও আব্বাসীয় আমলে ইসলাম ধর্ম ইউরোপে প্রবেশ করে। এছাড়া এই ভ্রাতৃত্বের জন্য মুসলমানরা অধিকাংশ যুদ্ধে অংশ নিয়ে জয় লাভ করে যে কারণে মুসলিম সাম্রাজ্য বেড়ে যায়। কাজেই মুসলমানরা ভ্রাতৃত্বের অনুপ্রেরণায় ক্রসেড অংশ নেয়।


৫. রাজনৈতিক কারণ : রাজনৈতিক কারণ ছিল ক্রুসেডের অন্যতম কারণ। ধর্মযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী অনেকেই ধর্মীয় কারণে যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেনি। অধিকাংশ মুসলিম ও খ্রিস্টান নেতারা এই যুদ্ধের মাধ্যমে রাজ্য দখল ও রাজ্য শাসনের ইচ্ছা ও আকাঙ্খা পোষণ করতেন। অন্যদিকে ৭ শতকে জেরুজালেম মুসলমানদের দখলে আসার পর হতেই তা উদ্ধারের জন্য খ্রিস্টানরা বহুবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। কিন্তু এগার শতকে জেরুজালেম উদ্ধারের আকাঙ্খা জাগে। এ কারণে এগার শতকে ক্রুসেড সংঘটিত হয়।


৬. বাণিজ্যিক বা অর্থনৈতিক কারণ : অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা ক্রুসেডের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ । দশক শতক হতে মুসলমানরা ভূমধ্যসাগরে বাণিজ্যে আধিপত্য লাভ করে। ফলে মুসলমানদের বাণিজ্য দ্রুত বৃদ্ধি পায়। এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ইউরোপীয় ব্যাপক অসুবিধার সম্মুখীন হয়। ইতালির অন্যান্য বিভিন্ন শহর মুসলমানরা দখল করে নিলে ফ্রান্সের সাথে রোম ও ইতালির ব্যবসা প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। তাছাড়া ইউরোপীয়রা মিশরে যে বাণিজ্য প্রসার ঘটিয়েছিল তাও ফাতেমী বংশের কারণে বন্ধ হয়ে যায়। ফলে বাণিজ্যের সংকটে খ্রিস্টানরা ক্রুসেডে অবতীর্ণ হয় ।


৭. সাংস্কৃতিক কারণ : ইসলাম ধর্ম আবির্ভাবের পূর্বে রোমার ও গ্রিক ছিল সভ্যতার বাহক। তারা তাদের শিক্ষা ও সভ্যতার জন্য গর্বিত বোধ করতো। এবং অন্যান্য জাতিকে তারা অজ্ঞ ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন মনে করত। কিন্তু ইসলাম ধর্মের আবির্ভাব ছিল রোমান ও গ্রিক সংস্কৃতি ও সভ্যতার জন্য হুমকি স্বরূপ। কারণ ইসলাম ধর্ম দ্রুত প্রসারের ফলে ইসলামী সংস্কৃতি ও মুসলীম সভ্যতা প্রাচীন গ্রিক ও রোমান সভ্যতা সংস্কৃতি বিনষ্ট করার পাশাপাশি তদস্থলে মুসলিম সভ্যতা সংস্কৃতি বিকাশ লাভ করে। ফলে ক্রসেড অনিবার্য হয়ে পড়ে।


৮. আধিপত্য বিস্তারে প্রতিদ্বন্দ্বিতা : সভ্যতার প্রথম হতেই খ্রিস্ট ধর্ম ও মুসলমান সম্প্রদায় কর্তৃত্ব বিস্তারের দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়। তাদের এই দীর্ঘ সংগ্রামের ফলশ্রুতি হলো ক্রুসেড। এশিয়া, আফ্রিকা, ইউরোপের বহু জায়গায় মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠিত হলে খ্রিস্টানদের মধ্যে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা তীব্র হয়ে ওঠে। অন্যদিকে নিজেদের কর্তৃত্ব সুদৃঢ় করতে মুসলমানরাও তাদের ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। সে কারণে ক্রসেড সংঘটিত হয়।


৯. সামন্ত প্রথা : সামস্ত প্রথাও সামন্ত প্রভুদের আগ্রাসী ভূমিকার জন্য ক্রুসেড সংঘটিত হয়। এগার শতকের মধ্যে ইউরোপে সামন্ত প্রথার ব্যাপক বিকাশ ঘটে। এতে সামান্য জমিও অবশিষ্ট ছিল না যাতে সামন্ত প্রথার বিকাশ হয়। তাই বিপুল সংখ্যক সামন্ত প্রভু ক্রুসেডের আশ্রয়ে প্রাচ্য দেশে সামন্ত প্রথা জারির চেষ্টা করে। কিন্তু প্রাচ্য দেশে মুসলিম শাসন তখন তুঙ্গে । যার ফলে সামন্ত প্রভুদের সাথে মুসলমান শাসকদের দ্বন্দ্ব অনিবার্য হয়ে যায়।


১০. প্রত্যক্ষ কারণ : ক্রসেডের প্রত্যক্ষ কারণ ছিল গ্রিক সম্রাট আলেকসিয়াস ও পোপ দ্বিতীয় আরবানের প্রচারণা। এ সময় মুসলমানগণ বাইডেস্টাইন সাম্রাজ্যের অধীনে এশিয়ার মাইনরের রাজ্য সমূহ দখল করায় আলেকসিয়াস আতংকিত হয়। এ জন্য তিনি পোপ দ্বিতীয় আরবানের সাহায্য আবেদন করেন। এ অবস্থায় মুসলমান শাসকগণ কনস্টান্টিনোপলের কাছাকাছি হলে সম্রাট পোপের সরনাপন্ন হন। পোপ গ্রিক, রোমান, সম্রাট, চার্চের মধ্যে সমন্বয় সাধনের উপযুক্ত সময় মনে করে মুসলমানদের হাত থেকে জেরুজালেম উদ্ধারের জন্য তারা আহবান করে। ফলে ক্রসেডের সূত্রপাত হয়।


উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, ক্রসেডের জন্য যদিও ধর্মীয় কারণ মুখ্যত ছিল, তবুও নানাবিধ কারণে মধ্যযুগে ক্রসেড সংঘটিত হয়। এর মধ্যে অন্যতম কারণ হিসেবে ঐতিহাসিকরা মনে করেন সাম্রাজ্য দখল, পোপের আধিপত্য, বাণিজ্যের সংকট, ধর্মরক্ষার নামে জেরুজালেম উদ্ধারের ব্যর্থ চেষ্টা, সংস্কৃতির মর্যাদা প্রতিষ্ঠা যে কারণে হাজার হাজার মানুষকে ক্রুসেডের বলি হতে হয়েছিল। এজন্য ক্রসেডের জন্য এককভাবে কোনো কারণকে দায়ী করতে ঐতিহাসিকরা নারাজ।


#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Now
Ok, Go it!