ভূমিকা : মধ্যযুগে ইউরোপের ইতিহাসে সামন্ত প্রথা ছিল উল্লেখযোগ্য ঘটনা। এই সামন্ত প্রথাকে কেন্দ্র করে একাধিক শ্রেণির উদ্ভব হয়। এ সমাজ ছিল মূলত ভূমি কেন্দ্রীক। কাজেই ভূমিকে কেন্দ্র করেই সামন্ত প্রভুদের উদ্ভব হয়। রাজা তার অধিনস্ত সামন্ত প্রভুদের মধ্যে জমি বিতরণ করাই সামস্ত প্রভুরা একচ্ছত্র অধিকার লাভ করে। সামস্ত যুগের প্রাথমিক পর্যায়ে সামন্ত প্রভুরা সহনশীল থাকলেও যতই সময় যেতে থাকে ততই তাদের মধ্যে অর্থ ও প্রতিপত্তির চাহিদা বাড়তে থাকে। ফরে তারা অধিকাংশ সময়ে শোষণ অত্যাচার ও নির্যাতনকারী হিসেবে পরিচিত পায়।
সামন্ততন্ত্রে সামন্ত প্রভুদের জীবনযাত্রা : সামন্ততন্ত্রের উত্থানের সময় থেকেই সামন্ত প্রভুদের ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য। নিম্নে সামন্ততন্ত্রে সামন্ত প্রভুদের জীবনযাত্রা উল্লেখ করা হলো -
১. অভিজাত শ্রেণি: সামস্ত যুগে অধিকাংশ সামস্ত প্রভুরাই ছিল অভিজাত শ্রেণি। সামন্ত প্রভুরা ছিল সমাজের সবচেয়ে ধনবান, অভিজাত গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। সামন্ত প্রভু আর তার পরিবার পরিজনের একমাত্র রাজা কর্তৃক কেউ আভিজাত্যের পদবী গ্রহণ করলে শুধু তারাই অভিজাত গোষ্ঠীর সদস্য হতে পারত। ভূসম্পতি, অস্ত্রশক্তি ও প্রতিপত্তির বিচারে ডিউক নাইট পর্যন্ত লর্ডরা উর্ধ্বস্তন থেকে নিম্নস্তরে বিন্যস্ত ছিল। প্রতিটি স্তরের অভিজাতই বার বার অভিজাত্যের ব্যাপারে সতর্ক ছিল।
২. ক্ষমতার দ্বন্দ্ব : সামন্ত যুগে প্রত্যেক অভিজাত লর্ড তার নিজের ভূ-সম্পত্তি ও ভূমি দাসের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে চাইত। ক্ষমতা বৃদ্ধির এই প্রতিযোগিতা সামন্ত যুগের ইউরোপকে অশান্ত করে তুলে ছিলো এবং প্রতিবেশি লর্ডদের পারস্পরিক দ্বন্দ্ব মধ্যযুগের ইউরোপে সামরিক ঐক্য গঠনের সম্ভবনাকে বিনষ্ট করেছিল। নিজের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্বের কারণে তারা বহিঃশত্রুর আক্রমণ প্রতিহত করতে ঐক্যবদ্ধ হতে পারেনি।
৩. বিলাসবহুল জীবন যাপন : সামন্ত যুগে সামন্ত প্রভুদের বিশাল সম্পদ তাদেরকে বিলাসী করে তুলেছিল। আর এ সম্পদ অর্জনের মূল উৎস ছিলো কৃষকের শ্রম। তাদের আবাসস্থল ছিল সুরক্ষিত দুর্গসম বিশাল বাসভবনে। যেখানে থাকত বিলাসী আসবাব পত্র। তাদের পোষাক পরিচ্ছদও ছিল বেশ জাঁকজমকপূর্ণ। উৎপাদন প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে হতো বিধায় তারা প্রচুর অবসর পেত। বিভিন্ন আমোদ প্রমোদ, পশু শিকার, যুদ্ধ বিগ্রহে লিপ্ত থেকে অবসর কাটাত।
৪. প্রচুর জমির মালিক : সামন্ত সমাজে রাজা শর্ত সাপেক্ষে তার অধীনস্থ লর্ডদেরকে জমি দান করতেন। এতে লর্ডরা প্রচুর জমির মালিক হতেন। লর্ড বা ভূস্বামী তার ইচ্ছামত জমি অধিগ্রহণ করতে পারতেন। তিনি তার ইচ্ছানুযায়ী তার অধিনস্ত ভ্যাসাল ও নাইটদের মধ্যে জমি বিতরণ করতেন। তবে এই জমি নাইট আর বিতরণ করতে পারবে না। জমির উপর লর্ডদের একচ্ছত্র আধিপত্য বজায় ছিল। বিনিময়ে তারা খর বা খাজনা আদায় করতেন। এছাড়া লর্ডদের অধীনে প্রচুর খাস জমি ছিল।
৫. দায়বদ্ধতা : সামন্ত সমাজে রাজা তার অধিনস্ত লর্ডদের জমি দান করতো, ফলে রাজার প্রতি লর্ডদের অনেক বেশি দায়বদ্ধতা ছিল। লর্ডদের কাছ থেকে রাজা রাজস্ব আদায়, সৈন্য সামন্ত ও রাজ্যের নিরাপত্তা আশা করতেন। তাছাড়াও সামরিক সাহায্য দান, প্রাসাদ নির্মাণ, রাস্তা নির্মাণ, পুল তৈরির জন্য সামন্ত প্রভুরা রাজাকে লোক বল দিয়ে সাহায্য করতেন । এছাড়া সবচেয়ে বড় দায়দায়িত্ব হলে, রাজ্যের মধ্যে যুদ্ধ বেধে গেলে, লর্ডরা প্রয়োজনে স্বশরীরে যুদ্ধে অংশ নিতেও বাধ্য ছিল। রাজা যুদ্ধে বন্ধী হলে তাকে মুক্ত করা অপরিহার্য। তবে লর্ডদের কৃষকের প্রতিও দায়-দায়িত্ব ছিল। যেমন তাদের নিরাপত্তা লর্ড কর্তৃক নির্ধারিত ছিল।
৬. পৃথক ক্ষমতার অধিকারী : সামন্ত সমাজে সামন্ত প্রভুরা পৃথক পৃথক ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। সামন্ত প্রথা চালু হবার পূর্বে রাজার হাতে সমস্ত ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত ছিল। কিন্তু শার্লামেনের মৃত্যুর পর তাদের সংগঠিত সৈন্যবাহিনীর অভাবে লোম্বার্ড ভেন্ডাল, গর্থমেন প্রভৃতি বর্বর বহিঃশত্রুর আক্রমণ প্রতিহত করতে ব্যর্থ হয়। আবার জনগণ নিজেদের নিরাপত্তার জন্য তাদের জমিজমা লর্ড বা সামন্ত প্রভুর নিকট নিজেকে সম্পন্ন করে। ফলে এতে পৃথক পৃথক ক্ষমতাধারী সামন্ত প্রভুর উদ্ভব হয় ।
৭. বহুবিধ কর আদায় : সামন্ত সমাজে প্রভুরা নিজের বিলাসবহুল জীবন যাপন ও রাজাকে খুশি করতে সাধারণ নাইট,ভ্যাসাল, ভিলেইন, ক্রাফটার, কাটারদের থেকে প্রচুর পরিমাণে কর আদায় করতেন। করভারে জর্জরিত সাধারণ কৃষকের অবস্থা শোচনীয় হলেও সামন্ত প্রভুরা সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করতেন না। এমন কি কোনো কৃষক কর পরিশোধ না করতে পারলে সামন্ত প্রভুরা এতো বেশি হিংস্র আচরন করতে যে তারা কৃষকের স্থাবর-অস্থাবর সম্পতিসহ গবাদি পশু সন্তান স্ত্রীসহ সবকিছু নিয়ে যেত। কোনো কৃষকের মৃত্যু হলেও একই আচরণ করত। তারা কৃষকদের থেকে পারিবারিক কর, ধর্মকর, হাটকর, পথকর, আপ্যায়ন কর প্রভৃতি আদায় করত।
৮. বেগার আদায় : সামন্ত সমাজে কৃষকরা নানাবিধ কর প্রদানসহ সামন্ত প্রভুদের নির্দেশে তার জমি বেগার বা বিনা পারিশ্রমিকে শ্রম দিতে বাধ্য ছিল। যাকে কার্তি বলে। লর্ড বা সামন্ত প্রভুরা তাদের জমি চাষাবাদ, ফসলকাটা, রাস্তা তৈরি, পুল নির্মাণের জন্য বিনা পারিশ্রমিকে কৃষকদেরকে কাজ করাতো। তবে তারা কাজে সন্তুষ্ট হলে নামে মাত্র কৃষকদের জমি দান করতেন। এরা ছিল ক্রাফটার বা কাটার ।
৯. সামন্ত প্রভুদের আধিপত্য : সামস্ত সমাজে রাজা ছাড়া সামন্ত প্রভু ও তার পরিবার পরিজন একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করত। বিশেষ করে তাদের প্রধান আধিপত্য ছিল কৃষকদের উপর। কোনো কৃষক সামস্ত প্রভুর অনুমতি ব্যতীত তাদের পুত্র কন্যাদের বিবাহ দিতে পারতনা। নিজের গরু, ঘোড়া ও গবাদি পশু বিক্রি করতে হলে সামন্ত প্রভুদের অনুমতি প্রয়োজন ছিল। ইন্টার উৎসবে লর্ডরা কৃষক থেকে মরগী ও ডিম আদায় করতেন। সামন্ত প্রভু তার জমিতে। সপ্তাহে ২/৩ দিন বেগার খাটাতো। এভাবে তারা কৃষকদের উপর আধিপত্য বিস্তার করে।
১০. নির্যাতনের প্রতিচ্ছবি : সামন্ত সমাজে সামন্ত প্রভুরা ছিল নির্যাতনের প্রতিচ্ছবি, যদিও কোনো কৃষককে নির্যাতন, হত্যা, আঘাত করা, আহত করা ছিল সামন্ত প্রভুদের জন্য বেআইনি তবুও তারা অধিকাংশ সময়ে যে আইন লঙ্ঘন করে কৃষককে শাস্তি প্রদান করতেন। ক্ষেত্র বিশেষ কোনো কৃষককে তারা মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করতো বিশেষ করে কোনো কৃষক কর প্রদানে ব্যর্থ হলে, আনুগত্য প্রদর্শন না করলে তাকে চুনের গুদামে আটকে রাখত সামন্ত প্রভুরা। এভাবে সামন্ত প্রভুরা সাঁমন্ত সমাজে কৃষকদের উপর অমানসিক নির্যাতন চালাতো।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, মধ্যযুগে বর্বর সামন্ত প্রভুরা ছিল একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী। এই সময় সমাজে তারা সর্বোচ্চ মর্যাদার অধিকারী হয়ে বিলাস বহুল জীবন যাপনে মত্ত থাকত। আর যাবতীয় নির্যাতন, অবহেলা, অত্যাচারের শিকার হতো সাধারণ কৃষক। সমগ্র ইউরোপ জুড়ে এর সংখ্যা ছিল মাত্র এক দশমাংশ। তবুও তাদের দ্বারা সামন্ত সমাজের অর্থনীতি নির্ধারিত হতো। এ সমাজে সামন্ত প্রভুর নির্দেশ মানা ছিল কৃষকের অপরিহার্য কর্তব্য।